রাজা বিদেশে, কাজেই সে স্কুলের বড়া শয়তান যুবরাজের সেখানে সপত্নহীন রাজত্ব। কারণ রাজা ছাড়া যুবরাজকে তম্বি কে করিতে পারে? আর সকলেই দিন শুনিতেছেন, যুবরাজ কবে রাজা হইয়া তাহাদিগকে বড় বড় তঙ্কার নোকরি দিবেন। কাজেই যুবরাজের শিক্ষা অগ্রসর হইতেছে না, অন্য ছেলেমেয়েদের কী সাহস যে-পাঠ যুবরাজ পড়িতে পারেন না তাহা তাহারা পড়িতে পারার দম্ভ করিবে! বাপ-মা ছেলেদের বিশেষ করিয়া বলিয়া দেন যেন তাহারা ওই সব লেখাপড়ার মতো অবান্তর বাহ্যবস্তুর প্রতি মনোযোগ না করে সারবস্তু, যেন যুবরাজকে খুশি রাখা হয়। তিনি বড় হইয়া তাহাদের প্রতি নেকনজর দিলে তাহাদের তখন ভূগোল-ইতিহাসের কী প্রয়োজন? আর লেখাপড়ার ফপরদালালি করিয়া যদি এখন তাহাকে চটায় তবে পরে তাহাদিগকে রক্ষা করিবে কোন জ্যামিতি, কোন ব্যাকরণ? স্মরণ তো রাখিতে হইবে এযুগে চাণক্য প্রবচনের প্রথমার্ধ স্বদেশে পূজ্যতে রাজা খাটে কিন্তু বিদ্বান সর্বত্র পূজ্যতে আর খাটে না।
যুবরাজ বড় হইলে এইসব অকাল-কুষ্মন্ত্রে উজির নাজির কোটাল হয়। তাহাদের না আছে শিক্ষা, না আছে শীল। কুলীনের যে নবধা কুললক্ষণ, সেসব তাবৎ কয়টির সম্পূর্ণ অনুপস্থিতি যদি কোনও ব্যক্তিতে পান তবে বুঝিবেন, তিনি নেটিভ স্টেটের রাজার বাঁদর নাচের পুচ্ছহীন মর্কট, অর্থাৎ সেখানকার হোমরা-চোমরা অথবা বড় কর্মচারী।
কোনও কোনও খবরের কাগজে দেখিলাম, নেটিভ স্টেটগুলিকে মধ্যযুগের সামন্ত রাজ্যের সঙ্গে তুলনা করিয়াছে। তাহাতে মধ্যযুগের সামন্ত রাজ্যের প্রজাদের প্রতি অবিচার করা হইয়াছে। আমি পশ্চিম ভারতের যেটুকু ইতিহাস পড়িয়াছি তাহাতে দেখিয়াছি যে, মধ্যযুগে কোনও রাজা কাণ্ডজ্ঞানহীন উচ্ছলতায় মত্ত হইলে প্রজা বিদ্রোহী হইয়া রাজাকে তাড়াইয়াছে, অথবা অন্য সামন্ত রাজা প্রজাদের অসন্তোষের খবর পাইয়া সে রাজ্য আক্রমণ করিয়া নিজ রাজ্য বৃদ্ধি করিয়াছেন অথবা দিগ্বিজয়ী বলিয়া খ্যাত হইয়াছেন। এখন প্রজাবিদ্রোহেরও উপায় নাই। নানারকম ট্রিটির জোরে মহারাজ বহিঃশক্তি আহ্বান করিয়া দুই মিনিটেই সব বিদ্রোহ ঠাণ্ডা করিয়া দিতে পারেন। প্রজারা কর্মে মগ্ন বলদের মতো একদিকে খায় রাজার মার, অন্যদিকে খায় ট্রিটির মার।
তবু মাঝে মাঝে যখন অত্যাচার অসহ্য হয় তখন অনেক সুবিধাবাদী মকুবির জয়জয়কার আরম্ভ হয়। তাহারই একজনের সঙ্গে আমার বোম্বায়ে আলাপ হয়। তাঁহার পেশা নাকি জর্নালিজম। শুধাইলাম, মহাশয় কোন কাগজে লেখেন? বলিলেন, আজ্ঞে, কোনও কাগজেই লিখি না, না লিখিয়া পয়সা কামাই। আমি বলিলাম, সে কী মহাশয়, কালিদাসের নাই তাই খাচ্ছ ব্যাপার নাকি? বলিলেন, অনেকটা তাই; নেটিভ স্টেটে ফ্রেশ কেলেঙ্কারির খবর পাওয়া মাত্রই সেখানে উপস্থিত হইয়া নানা তদ্বির-তদন্ত করিয়া রাজা বা দেওয়ানের বিপক্ষে প্রমাণ সংগ্রহ করি। তার পর দেওয়ানকে বলি, কত ওগরাবে কও। দেওয়ান বেশ টু পাইস দেয়– অবশ্য অবস্থা বুঝিয়া ব্যবস্থা। তাই আর কেচ্ছাটা লেখার প্রয়োজন হয় না। আর লিখিয়াই-বা হইবে কী? ফি কলম কুড়ি টাকা তো? তাহাতে আমার এক সন্ধ্যার ইয়ের খরচটাই উঠিবে না। জিজ্ঞাসা করিলাম, কিন্তু যাহাদের নানা ভরসা দিয়া প্রমাণ সংগ্রহ করিলেন, সে প্রমাণ দেওয়ানকে যে সমঝাইয়া দিলেন, তাহাদের কী? পাষণ্ড কী বলিল জানেন? আণ্ডা না ভাঙিয়া কি আর মামলেট হয়!
কোনও কোনও নেটিভ স্টেটে প্রজামণ্ডল আছে– শুনিলাম কুচবিহারে নাই। প্ৰজামণ্ডল কংগ্রেসের সঙ্গে যুক্ত হইয়া স্টেটের প্রজাবর্গের উন্নতির চেষ্টা করেন, অত্যাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেন, ধারা সভায় প্রবেশ করেন ও ব্রিটিশ ভারতে ব্যাপক রাজনৈতিক আন্দোলন আরম্ভ হইলে যোগদান করেন। লক্ষ করিয়াছি, যে স্টেটে অবিচার কম সেখানে কংগ্রেসের সঙ্গে যোগ দেওয়া আন্দোলনে জোর কম থাকে। ব্রিটিশ ভারতে আমরা বিদেশি রাজের বিরুদ্ধে যে জোর পাই, ভালো স্টেটে প্রজারা সে জোর পাইবে কোথা হইতে? মন্দ স্টেটে আন্দোলন ভালো চলে, কারণ রাজা বা দেওয়ান তখন বিদেশি শাসনের প্রতীক হইয়া দাঁড়ান।
পশ্চিম ভারতের কংগ্রেস কর্মীরা প্রজামণ্ডলগুলির সঙ্গে সর্বদা যোগসূত্র রক্ষা করেন। পূর্ব ভারতে আমাদের অন্তত খবর রাখা উচিত না হইলে অখণ্ড সম্পূর্ণ ভারতবর্ষের প্রতি রাজনৈতিক সিংহাবলোকন চক্রবালে পরিব্যাপ্ত হয় না।
কোনও কোনও স্টেটে মুসলিম লিগ প্রতিষ্ঠানও আছেন; কর্মীরা মুসলিম স্বার্থ রক্ষা করিবার প্রয়াস করেন। খুব দরকার হয় না, কারণ দেশি স্টেটে হিন্দু-মুসলমানের দলাদলি কম।
এই একটিমাত্র গুণ দেশি রাজ্যে আছে। হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা সেখানে হয় না। কারণ হিন্দু-মুসলমানকে লড়াইয়া সেখানে রাজার কোনও ফায়দা নাই। কোনও কোনও স্টেটে হিন্দু-মুসলমানের হৃদ্যতা দেখিয়া ভারতবর্ষের ভবিষ্যৎ লইয়া মনে মনে সুখস্বর্গ গড়িয়াছি।
উত্তম রাজা যে দেশি রাজ্যে কুত্রাচ নাই, এমন নহে। বরোদার ভূতপূর্ব মহারাজ স্বর্গীয় সয়াজি রাওয়ের মতো প্রজাপালক দেশে-বিদেশে অতি অল্পই জন্মিয়াছেন। কিন্তু তিনিও তো বাল্যকাল কাটাইয়াছিলেন রাখাল ছেলেদের সঙ্গে। তিনি রাজা ছিলেন, কিন্তু কখনও যুবরাজ ছিলেন না–দত্তক পুত্ররূপে রাজা হন। দুই-একটি জনপ্রিয় রাজা যদি-বা স্টেটে জন্মান তবু তাঁহাদের জন্য নেটিভ স্টেট রূপ জঞ্জাল রাখিবার প্রয়োজন নাই।