কুচবিহারও প্রাতঃস্মরণীয় কেশবচন্দ্রের আত্মীয়তা লাভ করিয়া কৌলীন্যপ্রাপ্ত হইয়াছেন। ইদানীং কুচবিহারে যে গুণ্ডামি হইয়া গেল তাহা লইয়া দেশে আন্দোলন হইয়াছে ও হওয়া উচিত কিন্তু পশ্চিম ভারতে নিত্য নিত্য যে কাণ্ড হয় তাহা শুনিলে বাঙালির চক্ষু স্থির হইয়া যাইবে।
প্রথমত কোনও নেটিভ স্টেটে কোনওপ্রকার স্বায়ত্তশাসন নাই। কোনও কোনও অত্যন্ত প্রগতিশীল রাজ্যে ধারা সভা থাকে। সে সভার প্রধান কর্ম রাজাকে সদুপদেশ দেওয়া। সে ধারাসভার সভাপতি স্টেটের দেওয়ান বা প্রধানমন্ত্রী। রাজা সাধারণত স্টেটের বাহিরে দেশের কোনও বড় শহরে বা ইউরোপের বিলাস-ব্যসনে মগ্ন–আমাদের জমিদাররা যেরূপ কলিকাতায় নানা সৎ কর্মে লিপ্ত থাকেন– প্রধানমন্ত্রী সর্বেসর্বা। তিনি সভাপতি। তাঁহার সম্মুখে দাঁড়াইয়া, তাঁহারই নিন্দা করিবার বুকের পাটা থাকে কয়জনের? রসিক-জনেরা তাই ধারাসভার নাম দিয়াছেন রাধা সভা। রাধা যেরকম শাশুড়ি-ননদির ভয়ে চোখের জল ফেলিতেও সাহস করিতেন না, হঁহাদের সেই অবস্থা।
আমাদের জমিদারেরা যেরকম নায়েব-ডাকিনীর হাতে প্রজাপুত্র সমর্পণ করিয়া আরামে দূরে থাকেন, নেটিভ স্টেটেও তাই। শুধু নায়েবের অত্যাচারের সীমা আছে, কারণ হাজার হউক পুলিশ আছে, ম্যাজিস্ট্রেট আছে। তাহাদিগকে সবসময় রীতিমতো ওয়েলিং না করার ফলে মাঝে মাঝে কল বিগড়াইয়া যায়। নেটিভ স্টেটে সে ভয় নাই। পুলিশ, ম্যাজিস্ট্রেট দেওয়ানের অতিভক্ত বাহন।
দেওয়ান যত বেশি টাকা তুলিতে পারেন, মহারাজ তত খুশি। তিনি দেশে-বিদেশে যে ভূতের খপরে তেল ঢালিতেছেন সে ভূতের তৃষ্ণার শেষ নাই। দরিদ্র প্রজার রক্ত চুষিয়া, হাড় পিষিয়া, মেরুদণ্ড চূর্ণ করিয়া তৈল বাহির করিতেছেন দেওয়ান। আত্মীয়-স্বজন ইয়ার-বক্সি হুঙ্কার দিয়া বিদ্রোহীকে কাবু করিতেছেন; কন্ট্রাক্টে, একচেটিয়া কারবারে অন্যান্য শত উপায়ে উদরপূর্তি করিতেছেন। সিংহাসনে উপবিষ্ট মহারাজা সিংহের অংশ পাইতেছেন। যে দেওয়ান যত বেশি শোষণ করিতে পারে সেই তত কর্মদক্ষ।
প্রজার নৈতিক চরিত্র যে তাহাতে কী পরিমাণ অধঃপাতে যায় বুঝানো অসম্ভব। যেখানে প্রভু স্বৈরাচারী, স্বাধিকারপ্রমত্ত সেখানে মানুষের বাঁচিবার উপায় কী থাকিতে পারে? একমাত্র পদলেহন ছাড়া তাহার অন্য কোনও পন্থা তো জানা নাই। বোম্বাই শহরে যদি দেখেন কেহ অতিরিক্ত বিনয় ভদ্রতা ও সৌজন্য প্রকাশ করিতেছে তবে প্রশ্ন করিলে খুব সম্ভব জানিবেন যে, ভদ্রলোক নেটিভ স্টেটের লোক।
ধর্মসাক্ষী, আমরা কাহারও মনে আঘাত দিতে চাহি না কিন্তু সত্য নিরূপণে অপ্রিয় কথাও বলিতে হয় আমরা নাচার।
আর যদি মহারাজা দেশে থাকেন তবে ব্যাপার আরও পেল্লাই। দেশি-বিদেশি সায়েবসুবোতে সরকারি অতিথিশালা গমগম করিতেছে। নর্তকী আসিয়াছে, বাঈজী আসিয়াছে, গণিকা আসিয়াছে। হাজার মুরগি বাড়াইয়া বলিতেছি না– হাজার মুরগি কাটিয়া তাহারই নির্যাস দিয়া বিশেষ জুস তৈয়ারি হইতেছে– বহুতর ডাক্তার কবিরাজ হাকিম ডাকা হইয়াছে, তাহার বহুতর ইনজেকশন-টনিক, অরিষ্ট-আসব-প্রাণ-মোদক, হালুয়াতরওগণ লইয়া উপস্থিত। বর্দোবার্গেন্তি হইতে আরম্ভ করিয়া জাহাঙ্গির-বাদশাহি ডবল ডেস্টিলড আরক, আফিঙ সবকিছু প্রস্তুত। সে কী বীভৎস শিবহীন দক্ষয়ক্ষ! দেশের অন্যান্য সরকারি কাজকর্ম বন্ধ। উদয়াস্ত বলিব না, অস্তোদয় দেওয়ান সাহেব প্রাসাদে চৰ্কিবাজির মতো তুর্কিনাচ নাচিতেছেন।
কোনও কোনও মহারাজা স্বরাজ্যে ফিরিলেই অরাজকতা আরম্ভ হয়। কলির কী বিচিত্র গতি! যেসব কাণ্ড তখন হয় তাহার বিবরণ খবরের কাগজে ছাপানো অসম্ভব। শুধু ডাক্তারি পুস্তকে তাহার বর্ণনা দেওয়া চলে। লজ্জাহীন উচ্ছল তাণ্ডব নৃত্য তখন যে কী চরমে উঠিতে পারে তাহার বর্ণনা সত্যপীর যতই সত্যপ্রিয় হউন না কেন, দিতে অক্ষম। সদাশয় সরকার বাহাদুরের কাছে এসব কীর্তি অজানা নহে।
এইটুকু বলিলেই যথেষ্ট হইবে, কোনও কোনও স্টেটে সর্ব-সাকুল্য আয়ের অর্ধাপেক্ষা বেশি ব্যয় হয় মেহমানদারি খাতায় অর্থাৎ এইসব ভূতের যজ্ঞে।
আমার একটি রাজপুত শিষ্যের বিবাহ উৎসবে আমাকে যাইতে হইয়াছিল। যাহা দেখিয়াছিলাম ও শুনিয়াছিলাম তাহা অবর্ণনীয়।
দেশের আপামর জনসাধারণের সঙ্গে অবশ্য এইসব অশ্লীলতার যোগ বিশেষ নাই। কিন্তু আরেকটি জিনিস লক্ষ করিয়া আমি সর্বদা মর্মাহত হইয়াছি। নেটিভ স্টেটের বালক-বালিকা ছাত্রছাত্রীদের দাস্যভাব।
এক অতি সম্ভ্রান্ত স্টেটে দেওয়ানের নাতি স্কুলের ছাত্র-মাস্টারের উপর ঠাকুরদাদার অপেক্ষাও কঠিন ডাণ্ডা চালাইত। মাস্টারদের ঘরের পাশে তাহার জন্য বিশেষ বসিবার জায়গা, সেইখানে সেই শাখামৃগ তাহার ইয়ার-বক্সীদের লইয়া অঙ্গদের রায়বার বসাইত। আর কী দাপট! হেডমাস্টারকে শাসায় ঠাকুরদাদাকে বলিয়া তাহাকে আন্দামান অর্থাৎ রাজধানী হইতে দূরে গগ্রামে বদলি করাইবে। মাস্টার বৃদ্ধ– পেনশন-পেয়ালায় চুম্বন দিব-দিব করিতেছেন, ফস্কাইলেই সর্বনাশ। সবকিছু নীরবে সহিয়া যাইতেন।
স্কুল হইতে ছেলেমেয়ে বাছাই করিয়া রাজবাড়িতে রাজপুত্র রাজকন্যাগণের সঙ্গে পড়িবার জন্য লইয়া যাওয়ার রীতি কোনও কোনও স্টেটে আছে।