যুদ্ধের পর যখন ন্যাশনাল হোমের খবরটা বাহির হইল, তখন আরবরা হুঙ্কার দিয়া উঠিল। অতিকষ্টে তাহাদিগকে বুঝান হইল যে, এ বস্তুটি অত্যন্ত নিরীহ তেঁড়া সাপ। জনকয়েক ইহুদি প্যালেস্টাইনে বসবাস করিবার জন্য আসিতেছে, বিস্তর পয়সা সঙ্গে আনিবে, নিজের খাইবে পরিবে, ধর্মচর্চা করিবে, কলচর করিবে, আরবের আপত্তি করিবার কী আছে? ২৬ সেপ্টেম্বরে (৪৫) প্রকাশিত বাইৎসমান সাহেবের এই মর্মে বুলি যে, ইহুদিরা প্যালেস্টাইনে জুইশ মেজরিটি ও জুইশ স্টেট চায়। সেকথা তখনকার দিনের ইংরেজ সরকার মানেন নাই- লেবার পার্টি লাকি প্রভৃতি ইহুদিদের প্রতাপে আজ মানেন।
সে যাহাই হউক, যুদ্ধাবসানে যখন এইসব আলোচনা হইতেছে, তখন হঠাৎ দেখা গেল যে, যেসব ইংরেজ সৈন্য আরবদের সহায়তায়, লরেন্সের ধূর্তামিতে, জেরুজালেমে একটি বুলেটমাত্র খরচ না করিয়া প্রবেশ করিয়াছিল, তাহারা সেখানে থাকিবার পাকাপাকি বন্দোবস্ত করিতেছে।
পৃথিবীর ইতিহাসে ইহা এক স্মরণীয় ও অভিনব বস্তু। ১৯১৪ সালের পূর্বে কোনও রাজা গায়ের জোরে বা অন্য কোনও কায়দায় কোনও দেশ জয় করিলে সে-রাজা দুনিয়ার লোককে ডাকিয়া বলিতেন না যে, তোমরা সকলে আমাকে আশীর্বাদ করিয়া রাজ্যটি সোনার থালাতে করিয়া তুলিয়া দাও, আমি গ্রহণ করিয়া তোমাদিগকে কৃতার্থম্মন্য করিব। এ কায়দাটা আবিষ্কার করিলেন ইংরেজ ও ফরাসি সাম্রাজ্যবাদীরা। লিগ অব নেশনস গড়িয়া তামাম দুনিয়ার দেশপতিদের ডাকিয়া বলা হইল যে, তাহারা যেন ইংরেজকে রাজনৈতিক পূতজলে বাপ্তিস্ম করিয়া প্যালেস্টাইন, ইরাক, মিশরের মেনডেটরি প্রভু বা অছি নিযুক্ত করে। বিশ্বজন যেন স্বস্তিবচন ঝাড়িয়া বলে, তুমি ন্যায়ত ধৰ্মত আইনত দেশটা পাইলে। পৃথিবীর নৈতিক ইতিহাসের ক্রমবিকাশ লইয়া যাহারা নাড়াচাড়া করেন, তাহারা যেন এই পর্যায়ে নতুন পরিচ্ছেদ পাড়েন।
অছি কথাটি শুনিলে আমাদের মতো প্রাচীনপন্থিদের ধর্মপিতা সমাসটি মনে পড়ে। তুর্কি ভাষায় অছি অর্থ জ্যেষ্ঠভ্রাতা। নাবালক শিশুর জন্য যখন অছি নিযুক্ত করা হয় তখন এই কথা অছিকে মানিয়া লইতে হয় যে, সে নিঃস্বার্থভাবে শিশুর তত্ত্বাবধান করিবে। আইনকানুন ভালো জানি না, তবে শুনিয়াছি যে, অছি নিয়োগের পূর্বে দেখিতে হয় যে, ওই শিশুর স্বার্থে যেন অছির লোভ না থাকে– থাকিলে অমিত্ব রদ-বাতিল। লিগের কর্তারা স্বকায়দায় এই প্রশ্নটি জিজ্ঞাসা করিতে বিস্মৃত হইলেন। ইংরেজ তখন বলেন নাই। কিন্তু হালে পরিষ্কার বুঝাইয়া দিয়াছেন যে, প্যালেস্টাইন আইসা পাক আর রহিম নিক, সেখানে ইংরেজ স্বার্থ বরাবর অচল-অটুট থাকিবে– সেখানে বিমানঘাঁটি, পল্টন-গোয়াল থাকিবেই। লিগ-কর্তারা শুধু তম্বি করিয়া অছিদের বলিয়াছিলেন যে, তাহাদিগকে কয়েক বৎসর অন্তর অন্তর শাসিত দেশের কার্য-প্রতিবেদন পেশ করিতে হইবে। সে ব্যঙ্গ-নাট্যের কথা আরেক দিন স্মরণ করাইয়া দিবেন। আসল কথা, বিশেষ লক্ষমান প্রাণীকে মোড়শোপচারে কদলীবৃক্ষের অছি নিযুক্ত করা হইল।
সেই অছিত্বের আওতায় তার পর উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিম হইতে ঝাঁকে ঝাঁকে ইহুদি বুলবুলির পাল আসিয়া আরবের গমক্ষেতে পড়িল। কিন্তু ছেলে ঘুমাইল না, পাড়া জুড়াইল না। আরবরা এক হাতে ঠেকায় ইংরেজকে, আরেক হাতে মারে ইহুদিকে। কিন্তু তৎসত্ত্বেও প্রশ্ন ঠেকাইতে পারিল না। খাজনা দেব কিসে? শ্মশান হইতে মশান হইতে ঝোড়ো হাওয়ায় হা হা করিয়া তখন উত্তর আসিল, আবু দিয়া, ইজ্জত দিয়া, ইমান দিয়া, বুকের রক্ত দিয়া। (কর্তার ভূত, লিপিকা, রবীন্দ্রনাথ)
কিন্তু সে সমস্যা অর্থনৈতিক। বুলবুলিরা কি সঙ্গে কিছুই আনে নাই? তাহার আলোচনা আরেকদিন হইবে।
.
০২.
ইহুদিদের পক্ষে যাহারা যুক্তিতর্ক উপস্থিত করেন, তাঁহাদের প্রধান সাফাই এই যে, ইহুদিরা প্যালেস্টাইনে আসিবার সময় প্রচুর অর্থ সঙ্গে আনিয়াছে ও এখনও মাসে মাসে সমস্ত পৃথিবীর ইহুদি ধনপতিরা সে দেশে টাকা-পয়সা ও অন্যান্য নানা তৈজসপত্র পাঠাইতেছেন।
কথাটা সম্পূর্ণ সত্য। কিন্তু তলাইয়া দেখিবার মতো। উপনিষদের ঋষি বলেন, হিরন্ময় পাত্র মধ্যে সত্য লুক্কায়িত আছেন। অধিকাংশ লোক সেই পাত্র দেখিয়াই আনন্দে আত্মহারা হয়, বলে না, হে পূষণ, পাত্রটি উন্মোচন করিয়া দেখাও ভিতরে কী আছে।
শ্রীহট্ট বা উত্তর আসামের ভিতর দিয়া যাইবার সময় দেখিবেন, দুই দিকে ঘন সবুজ টিলার গায়ে গায়ে সারি সারি, কাটাছটা, সযত্নে বর্ধিত চায়ের গাছ। মাঝে মাঝে সরস সতেজ গোলমোহরের গাছ, শ্যামাঙ্গী কুলি মেয়েরা কাজ করিতেছে, দূরে ছবির মতো সুন্দর কলকারখানা, ঝকঝকে তকতকে সায়েবদের বাঙলো, ক্লব হৌস, গলফ লিনক। এমনকি দূর হইতে কুলিদের ব্যারাকগুলি পর্যন্ত সুন্দর দেখায়।
ইংরেজ আমাদের চোখে আঙুল দিয়া বলে, দেখ, দেশের ধনদৌলত কীরকম বাড়াইয়াছি।
ইহুদিরা যে অর্থ আনিল, তাহা দিয়া চাষের অনুপযুক্ত কোনও কোনও জলাভূমির জলকর্দম নিকাশ করিয়া সোনা ফলাইয়াছে। কিন্তু আসামের চা-বাগিচায় ও এইসব স্বর্ণভূমিতে পার্থক্য এই যে, যদি আসামের চা-বাগানে কুলিরা এক বেলা খাইবার মতো পয়সা রোজগার করিতে পারে, প্যালেস্টাইনের স্বর্ণভূমিতে আরব চাষা-মজুরকে কাজ করিতে দেওয়া হয় না। ট্রাক্টর পাঠাইয়াছে মার্কিন ইহুদিরা, চালাইতেছে জর্মন ইহুদিরা, ফসল কাটিতেছে পোল ইহুদিরা, বাজারে লইয়া যাইতেছে অস্ট্রিয়ান ইহুদিরা। আরব অপাঙক্তেয়। কিন্তু তাহারা আপত্তি-ওজর জানায় না, বলে, নিষ্কর্মা জমি যদি কাজে লাগাইতে পারো, তাহলে আমার আপত্তি কী?