দোষ গাইতে চাই যদি তো তাল করা
যায় বিন্দুকে;
মোটের উপর শিলঙ ভালোই যাই না
বলুক নিন্দুকে।
এ ছবি মোটের উপর নয়, খণ্ডেও ভালো। প্রিমিয়ের-রাত্রে দেবকীবাবু রিগেলে উপস্থিত ছিলেন। –রায় পিথৌরা
.
সপ্তপর্ণী
কয়েক দিন হল আনন্দবাজার পত্রিকার দোল সংখ্যা বেরিয়েছে। শ্ৰীযুত প্রবোধচন্দ্র সেন এ কাগজে বাংলা সাহিত্যের অতীত ও ভবিষ্যৎ শীর্ষক একটি সুচিন্তিত এবং বহু তথ্যপূর্ণ প্রবন্ধ লিখেছেন। হিন্দি-ইংরেজি বনাম বাঙলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে যারা কৌতূহলী তাঁদের সকলকে আমি এই প্রবন্ধটি পড়তে অনুরোধ করি- তারা লাভবান হবেন।
আমার আলোচনায় জানা-অজানাতে প্রবোধচন্দ্রের অনেক যুক্তি এসে গিয়েছে এবং আসবে। প্রবোধচন্দ্র না হয়ে অন্য কোনও কাঁচা লেখক হলে আমি আমার লেখাতে পদে পদে তার উদ্ধৃতির ঋণস্বীকার করতুম– কিন্তু এর বেলা সেটার প্রয়োজন নেই, কারণ প্রবোধবাবু লব্ধপ্রতিষ্ঠ পণ্ডিত, তাঁর একমাত্র উদ্দেশ্য বাঙলা ভাষা যেন তার ন্যায্য হক পায় এবং সেই হক সপ্রমাণ করার জন্য কে তাঁর লেখা থেকে কতখানি সাহায্য পেল, সে সম্বন্ধে তিনি সম্পূর্ণ উদাসীন। এবং আমার বিশ্বাস, দরকার হলে তিনিও অন্য লেখকের রচনা থেকে যুক্তি-তর্ক আহরণ করতে কুণ্ঠিত হবেন না। আমার লেখা তাঁকে সাহায্য না-ই করল।
প্রাচ্যে যেসব বড় আন্দোলন হয়ে গিয়েছে, সেসব আন্দোলন শুধু যে তার জন্মভূমিতেই সফল হয়েছে তাই নয়, তার ঢেউ পশ্চিমকেও তার সুপ্তিতে জাগরণ এনে দিয়েছে, সেসব আন্দোলনকে আমরা সচরাচর ধর্মের পর্যায়ে ফেলে নবধর্মের অভ্যুদয় নাম দিয়ে থাকি। ভারতবর্ষে তাই বৌদ্ধ ও জৈনদের দুই বৃহৎ আন্দোলনকে আমরা ধর্মের আখ্যা দিয়েছি; সেমিতি ভূমিতে ঠিক ওইরকমই দুই মহাপুরুষকে কেন্দ্র করে দুটি জোরালো আন্দোলন সৃষ্ট হয় সেগুলোর নাম খ্রিস্টধর্ম এবং ইসলাম।
আজকের দিনে ধর্ম বলতে আমরা প্রধানত বুঝি, মানুষের সঙ্গে ভগবানের সম্পর্ক। পূজা-অর্চনা কিংবা কৃজ্রসাধন-ধ্যানাদি করে কী করে ভগবানকে পাওয়া যায়, ধর্ম সেই পন্থা দেখিয়ে দেয়, এই আমাদের বিশ্বাস। কিন্তু একটুখানি ধর্মের ইতিহাস অধ্যয়ন করলেই দেখতে পাবেন, ভগবানকে পাওয়ার জন্য ধর্ম যতখানি মাথা ঘামিয়েছে তার চেয়ে ঢের ঢের বেশি চেষ্টা করেছে মানুষে মানুষের সম্পর্ক সভ্যতর করার জন্য। ধর্ম চেষ্টা করেছে ধনী-দরিদ্রের পার্থক্য কমাতে, অন্ধআতুরের আশ্রয় নির্মাণ করাতে– এককথায় এমন এক নবীন সমাজ গড়ে তুলতে, যেখানে মানুষ মাৎস্যন্যায় বর্জন করে, একে অন্যের। সহযোগিতায় আপন আপন শক্তির সম্পূর্ণ বিকাশ করতে পারে। বৌদ্ধ এবং জৈনধর্ম এইসব কাজেই মনোযোগ করেছে বেশি– ভগবানের সান্নিধ্য এবং তাঁর সাহায্য সম্বন্ধে সম্পূর্ণ উদাসীন হয়ে।
বিত্তশালী এবং পণ্ডিতের সংখ্যা সংসারে সবসময়েই কম ছিল বলে বড় আন্দোলনকারী মাত্রই এদের উপেক্ষা করে জনগণকে কাছে আনতে- এমনকি ক্ষেপিয়ে তুলতে চেষ্টা করেছেন আপ্রাণ। এবং তাই তাঁরা বিত্তশালী এবং পণ্ডিতের ভাষা উপেক্ষা করে যে ভাষায় কথা বলেছেন, সেটা জনগণের ভাষা। তথাগতের ভাষা তকালীন গ্রাম্য ভাষা পালি এবং মহাবীরের ভাষা অর্ধ-মাগধী। খ্রিস্টের ভাষা হিব্রুর গ্রাম্য সংস্করণ আরামেয়িক এবং মুহম্মদের ভাষা আরবি। আরবি সে যুগে এতই অনাদৃত ছিল যে আরবেরাই আশ্চর্য হল, এ ভাষায় আল্লা তাঁর কুরান প্রকাশ (অবতরণ = নাজিল) করলেন কেন? তার-ই উত্তর কুরানে রয়েছে :
আল্লা স্পষ্ট ভাষায় বলছেন, আরব পয়গম্বর যে আরবি ভাষায় কুরান অবতরণের আধার হবেন সেই তো স্বাভাবিক এবং অন্য যে কোনও ভাষায় (এবং সে যুগে হিব্রু ছিল পণ্ডিতের ভাষা– রায় পিথৌরা) সে কুরান পাঠানো হলে মক্কার লোক নিশ্চয়ই বলত, আমরা তো এর অর্থ বুঝতে পারছিনে।
গণ-আন্দোলনে সবচেয়ে বড় কথা– আপামর জনসাধারণ যেন বক্তার বক্তব্য স্পষ্ট বুঝতে পারে।
তাই মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যের চতুর্দিকে যে আন্দোলন গড়ে উঠল, তার ভাষা বাঙলা, তুকারামের ভাষা মারাঠি (তিনি ব্যঙ্গ করে বলেছেন, সংস্কৃতই কেবল সাধুভাষা? তবে কি মারাঠি চোরের ভাষা), কবীরের ভাষা সে সময়ে প্রচলিত বৈধ হিন্দি এবং তিনিও বলেছেন, সংস্কৃত কূপজল (তার জন্য ব্যাকরণের দড়িলোটার প্রয়োজন), কিন্তু ভাষা (অর্থাৎ চলতি ভাষা) বহুৎ নীর যখন খুশি ঝাঁপ দাও, শান্ত হবে শরীর। রামমোহন, দয়ানন্দ আপন আপন মাতৃভাষায় তাদের বাণী প্রচার করেছিলেন, আর শ্রীরামকৃষ্ণ যে বাঙলা ব্যবহার করে গিয়েছেন, তার চেয়ে সোজা সরল বাঙলা আজ পর্যন্ত কে বলতে পেরেছেন? এমনকি বিদ্যাসাগর মহাশয়ও তার বিপক্ষ দলকে উপদেশ দিয়েছিলেন সংস্কৃতে না লিখে বাঙলায় উত্তর দিতে। তিনি নিজেও সংস্কৃতে লেখেননি, যদিও তিনি সংস্কৃত জানতেন আর সকলের চেয়ে বেশি।
আমার মনে হয়, বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের পতনের অন্যতম কারণ সেদিনই জন্ম নিল, যেদিন বৌদ্ধ ও জৈন পণ্ডিতেরা দেশজ ভাষা ত্যাগ করে সংস্কৃতে শাস্ত্রালোচনা আরম্ভ করলেন। দেশের সঙ্গে যোগসূত্র ছিন্ন হয়ে গেল, ওদিকে সংস্কৃত শাস্ত্রচর্চা করাতে ব্রাহ্মণদের ঐতিহ্য ঢের ঢের বেশি– বৌদ্ধ জৈনদের হার মানতে হল।
পৃথিবীজুড়ে আরও বহু বিরাট আন্দোলন হয়ে গিয়েছে– পণ্ডিতি ভাষাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে, মাতৃভাষার ওপর পরিপূর্ণ নির্ভর করে।