অধিকৃত জর্মনি চালনা সম্বন্ধে নিম্নলিখিত খবর হইতে বোঝা যায়, বরঞ্চ বলা উচিত বোঝা যায় না ইংরেজ-মার্কিনের নীতি কী।
কম্যুনিস্টরা রাজ্যশাসনে কোথাও নাই। বেভেরিয়া ও নিম্নরাইনে দক্ষিণপন্থি ক্যাথলিকরা সর্বময় কর্তা। হামবুর্গ ও হানোফারে পার্টিমতামতহীন বণিক ও দক্ষিণপন্থি আমলারা গুছাইয়া লইতেছেন, যদিও অন্য কেউ কেউ বখরা পাইতেছেন। হেস্মে ও মধ্য রাইনে সোশ্যাল ডেমোক্রেটরা রাজ্য-চালনার পুরোভাগে ও উত্তরপন্থি ক্যাথলিকদের আওতায় বেস্টফালিয়েন ও ওল্ডেনবুর্গে কিছুটা রাজত্ব করিতেছেন। তদুপরি বড় বড় নগরে ইহারাই মেয়র হইয়া বসিয়াছেন।
উৎকৃষ্ট প্রস্তাব। এ রকম পঁচিশ জায়গায় বত্রিশভাজা করিবার কী প্রয়োজন? এরকম দো-আঁসলা, তিন-আঁসলা জানোয়ার পয়দা করিবার এক্সপেরিমেন্ট কেন? ইংলন্ডে একবার টার্কি ও হেন (মুরগি) পক্ষীতে সংমিশ্রণ করাইয়া যখন টার্কিন পাখি পয়দা করা হয়, তখন ফ্রান্স বলিয়াছিল, আমেরিকার এক আস্তাবলে গাধা ও একখানা ভাঙা বাইসিক্ল একসঙ্গে রাখার ফলে ফোর্ড গাড়ির জন্ম হয়েছিল। সাধু সাবধান!
তাই বলিতেছি যে, প্রকৃষ্টতম পন্থা, সোশ্যাল ডেমোক্রেটদের শুধু রাজ্য সমর্পণ করাই নয়, তাঁহাদের সম্পূর্ণ দ্বিধাহীন সাহায্যদান। রুশরা যেমন তাহাদের অধিকৃত অঞ্চলে সোশ্যাল ডেমোক্রেটদের বোকা বানাইতে চাহে, তোমরা তেমনি তাহাদের সফলতার পথে লইয়া চল। জর্মন বড় জাত্যাভিমানী, পারতপক্ষে সে কখনও তাহার জাতীয়তাবোধ ত্যাগ করিতে চাহে না। তাহার দৃঢ় বিশ্বাস, তাহার মুক্তির পথ তাহারই ঐতিহ্যের তাহারই বৈদগ্ধ্যের ভিতর দিয়া। সে বলশির ধামাধরা হইতে চাহে না, তোমাদের গোলাম হইতে চাহে না। তাহাদের যদি স্বাধীনভাবে স্বচ্ছন্দে জীবনযাপন করিতে দাও তবে সে সকল শত্রুকে রোধ করিয়া শান্ত জীবনযাপন করিবেই। সোশ্যাল ডেমোক্রেটরা শান্তি চায়।
আর শেষ কথা তো এই যে, স্বায়ত্তশাসনে সর্বজাতির অধিকার। সোশ্যাল ডেমোক্রেটরা জর্মনজাতির যাহা শ্রেষ্ঠ, যাহা বরণীয় তাহারই প্রতীক।
.
প্যালেস্টাইন
০১.
গোড়ার দিকে ইহুদি-আরবে প্যালেস্টাইন সম্পর্কে তর্ক উপস্থিত হইলেই প্রথম প্রশ্ন এই উঠিত, সে দেশটা কাহার। ইহুদিরা বলিত, এই পবিত্র দেশ আমাদের পিতৃভূমি, মুসা (মোজেস) আমাদিগকে এই দেশে পথ দেখাইয়া আনেন; আমাদের গর্বস্থল রাজা সুলেমন (সলমন), দায়ূদ (ডেভিড) এই দেশে রাজত্ব করিয়াছেন, আমাদের প্রপিতামহ ইব্রাহীমের (আব্রাহামের) কবর এই মাটিতে। এই দেশ আমাদের পুণ্যভূমি, এখন এ দেশকে আমাদের কর্মভূমিতে পরিণত করিতে চাহি। (সত্যেন দত্তের তীর্থসলিলে রাজা সুলেমন ও দায়ুদের গীতি দ্রষ্টব্য)।
উত্তরে আরব বলে, তোমাদের মতো আমরাও সেমিটি, যেসব মহাপুরুষদের নাম করিলে তাহারা আমাদেরও পূর্বপুরুষ। তাঁহাদের গোর আমাদের তীর্থস্থল-দরগাহ। ইহাদের মহৎ কার্যকলাপ কোরানে বর্ণিত হইয়াছে। উপরন্তু জেরুজালেম (বয়ত উল-মুদ্দস পবিত্রালয়) আমাদিগের কাছে মক্কার পরেই সম্মানিত। কিন্তু এসব ধর্ম-সম্বন্ধীয় হার্দিক আলোচনা উপস্থিত স্থগিত রাখো। আসল কথাটা এই, তোমাদের স্বাধীনতা লোপ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই (খ্রিস্টের বহুপূর্বে) তোমরা এ দেশ ত্যাগ করিতে আরম্ভ কর; খ্রিস্টের পর তোমাদের অধিকাংশ জাতভাই খ্রিস্টান হইয়া যায়– তাহারা আজ আমাদের দলে, পরবর্তী যুগে তাহাদিগের অধিকাংশ আবার মুসলমান হইয়া যায় এবং সর্বশেষে ক্রুসেডের আমলে যখন যুদ্ধ, অরাজকতা, ও অনাসৃষ্টির ফলে দেশটা উচ্ছন্ন গেল, তখন তোমরা সকলেই পোড়া দেশকে ছাড়িয়া কারবারে পয়সা করিবার জন্য পৃথিবীর সর্বত্র ছড়াইয়া পড়িলে। আমরা এই দেশের মাটিকে ভালোবাসিতাম সেই মাটিকে আঁকড়াইয়া ধরিয়া আটশত বৎসর কাটাইলাম, এখন পয়সার জোর হইয়াছে বলিয়া আমাদিগকে ভিটা-ছাড়া করিতে চাও? তোমাদের বেশভূষা বিজাতীয়, তোমাদের আচার-ব্যবহার এদেশের প্রাচীন ইহুদি পন্থানুযায়ী নহে (অর্থাৎ যে কয়টি ইহুদি দুর্দিনে। এদেশ ত্যাগ করিয়া যান নাই, তাঁহাদের আচার-ব্যবহারের সঙ্গে আমাদের আজ মিলে বেশি), তোমরা বার্লিন-প্যারিসের নৈতিক চরিত্র ও দুষ্ট রোগ সঙ্গে আনিয়াছ, আর সর্বশেষ কথা, আমাদের দুশমন ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদীদের সঙ্গে তোমরা বন্ধুত্ব করিয়াছ।
এই তর্কাতর্কি আমি ছয় মাসকাল উদয়াস্ত শুনিয়াছি–লিখিতে গেলে একখানা ছোটখাটো বই লেখা যায়। কিন্তু এসব তর্ক আজকাল কম হয়।
১৪-১৮ যুদ্ধের সময় ইংরেজ প্যালেস্টাইনের আরবকে কথা দেয় তখন যেখানে ইহুদির সংখ্যা নগণ্য যে, তোমরা যদি তুর্কির হইয়া না লড়ো তবে যুদ্ধের পর তোমাদিগকে স্বরাজ (সেলফ ডিটারমিনেশন) দিব। সঙ্গে সঙ্গে আরবদের অজানাতে, প্রধানত মার্কিন ইহুদিদিগকে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হইল যে, তাহারা যদি কাইজারকে অর্থসাহায্য করা বন্ধ করিয়া সেই অর্থ ইংরেজকে দেয় ও বিশ্ব-ইহুদি (ওয়ার্লড জিউয়ারি) অন্যান্য সাহায্য প্রদান করে, তবে যুদ্ধের পর ইহুদিদিগকে প্যালেস্টাইনে ন্যাশনাল হোম নির্মাণ করিতে দেওয়া হইবে। (ন্যাশনাল হোম কথাটার বাঙলা আর করিলাম না, ইংরেজিতেই তাহার অর্থ কী, সে লইয়া বাগবিতণ্ডার অন্ত নাই। নিরক্ষর আরব ইংরেজির এক বর্ণ বোঝে না, কিন্তু ন্যাশনাল হোম যে ন্যাশনাল স্টেট নয় সে কথা বুঝাইতে তাহার তৎপরতার অন্ত নাই। বারে বারে আরবি কথাতে শুধু চারিটি ইংরেজি শব্দ শুনিতে পাওয়া যায়, ন্যাশনাল হোম আর ন্যাশনাল স্টেটআমি। যদি ন্যাশনাল হোমের অনুবাদ জাতীয় ভবন বা জাতীয় সদন দিয়া করি, তবে ইহুদিরা আমাকে খুন করবে, আরবরা আমাকে খয়রাতি দিবে।)