জর্মনির দুর্দিনে সোশ্যাল ডিমোক্রেটরা আপামর জনসাধারণকে এক পতাকার নিচে সম্মেলিত করিয়া ইনফ্লেশন, বেকারি, নাস্তিক্য, উচ্ছলতা হইতে রক্ষা করিবার চেষ্টা করিয়াছিলেন। পৃথিবী জয় করার উদ্দেশ্যে নতুন সৈন্যবাহিনী প্রস্তুত করার স্বপ্ন তাহারা দেখেন নাই। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় তাঁহারা বলিয়াছিলেন, মানবসংসারে ভালো লোকের দেয়ালি উত্সব চলিতেছে, প্রত্যেক জাতি আপন প্রদীপ উঁচু করিয়া তুলিলে তবে সে উৎসব সমাধা হইবে। পৃথিবীর শান্তি ও মঙ্গল তাহারা কামনা করিয়াছিলেন বলিয়া ঠিক ওই সময়ে (১৯২০) রবীন্দ্রনাথকে তাঁহারা বিপুল সম্বর্ধনা করিয়াছিলেন। জর্মন জনসাধারণ তখন রবীন্দ্রনাথের বাণীতে নিজের মূক আদর্শ প্রকাশ করিয়াছিল। কে না জানে ঠাকুর রবীন্দ্রনাথ ছিলেন বিশ্বপ্রেমের কবি, শান্তির প্রতীক, পদদলিতের পরিত্রাণ।
তথাপি ইংরেজ-ফরাসির ভয় ছিল যে সময়কালে সোশ্যাল ডিমোক্রেটরা বলশিদের সঙ্গে যোগদান করিবে। তাই যখন দেশের শিল্প-বাণিজ্যের উদ্ধার করিবার জন্য সোশ্যাল ডিমোক্রেটরা ইংরেজ-ফরাসি ধনপতিদের সাহায্য চাহিল তাহারা সাফ জবাব দিল। ফলে বেকারি বাড়িল, ব্রনিভ হাল সামলাইতে পারিলেন না। তার পর ফন পাপেন; শ্লাইশার গর্ভাঙ্কের ভিতর দিয়া নাৎসি যবনিকা পতন। ইংরেজের কথা ফলিল না, সোশ্যাল ডিমোক্রেটরা কম্যুনিস্টদের পীড়াপীড়ি সত্ত্বেও নাৎসি অবিচারের বিরুদ্ধে ধর্মঘট করিতে রাজি হইলেন না।
***
সোশ্যাল ডিমক্রেটরাই যে দেশের মেরুদণ্ড তাহার প্রকৃষ্ট প্রমাণ এই যে, রুশেরা তাহাদের অধিকৃত অঞ্চলে ইহাদেরই প্রধান শক্তি স্বীকার করিয়া নিয়াছে। ইহাদেরই সঙ্গে আছেন ক্রিশ্চান ডেমোক্রেটিক পার্টি ও লিবারেল ডিমোক্রেটিক পার্টি। কম্যুনিস্টরাও আছেন, ও বেশ জোর আছেন তাহাতে কোনও সন্দেহ নাই এবং ভিতরে ভিতরে রুশ সরকার যে তাহাদেরই সবচেয়ে বেশি সাহায্য করিবে তাহাতেও বিন্দুমাত্র সন্দেহ নাই। কিন্তু রুশরা জানে যে, সোশ্যাল ডেমোক্রেটরা যদি বাঁকিয়া বসিয়া থাকে, তবে কম্যুনিস্টরা শুধু গায়ের জোরে তাহাদের প্রোগ্রাম চালু করিতে পারিবে না। স্পষ্ট বোঝা যাইতেছে যে, রুশের চাল হইল সোশ্যাল ডেমোক্রেটদের নটমঞ্চের সম্মুখে রাখিয়া দেশের প্রথম দুর্দিনের ধাক্কা তাহাদের দিয়া সহানো। রুশদের যথেষ্ট সাহায্য না পাইয়া যখন ব্যনিভ সরকারের মতো তাহাদের পার্টি-নৌকা বানচাল হইবে তখন কম্যুনিস্টরা আসরে নামিয়া দেশোদ্ধার করিবেন, অর্থাৎ গোটা রুশাধিকৃত অঞ্চলকে ইউএসএস আরের অঙ্গীভূত করিবেন। সে বিপদকালে সোশ্যাল ডিমোক্রেটরা যে কোনও কট্টর লাল-বিরোধী দর্গায় ধরনা দিবে তাহার উপায় নেই, কারণ রুশরা কট্টরদের নির্মমভাবে বিলোপ করিয়াছে ও করিতেছে। রুশরা জানে যে, উপস্থিত সোশাল ডিমোক্রেটদের লোকচক্ষে অপমানিত করার প্রয়োজন তাই তাহাদের সভামঞ্চে আনিবার পূর্বে বেশ করিয়া মুসোলিনি-কায়দায় জোলাপ দেওয়া হইতেছে।
অস্ট্রিয়ায় রুশরা যে গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা করিয়াছে তাহাতেও ওই চাল। বিস্তর সোশ্যাল ডিমোক্রেটদের হরেক রঙের পোর্টফোলিও দেওয়া হইয়াছে, কিন্তু পুলিশ, অর্থ, প্রোপাগান্ডা অভ্যন্তরীণ মন্ত্রীর হাতে ও তিনি কম্যুনিস্ট। অর্থনৈতিক দিক দিয়াও রুশের বালাই কম। যে অঞ্চল দখল করিয়া বসিয়াছে সেখানে খানা-পিনা আছে, তাহার উপর উক্রাইন আছে। সে অঞ্চলের সমস্ত কলকারখানা সরাইয়া রাশিয়ায় লইয়া গেলেও ইহাদের অন্তত অস্থিচর্মসার করিয়া রাখিতে কোনও বিশেষ অসুবিধা হইবে না।
***
মার্কিন-ইংরেজ কিন্তু কিছুতেই মনস্থির করিতে পারিতেছেন না। কর্তাদের বুদ্ধির বহর কতটুকু তাহা নিম্ন খবরটুকু হইতে বিলক্ষণ বোঝা গেল।
জর্মনির কলকজা যদি কাড়িয়া লই (অর্থাৎ ডিসইনডাসট্রিয়ালাইজ) তবে তাহারা না খাইয়া মরিবে, আর যদি না কাড়ি তবে চর্বচোষ্য লালিত হইয়া পুনর্বার মস্তকোত্তোলন করিয়া আমাদিগকে প্রহার করিবে।
এই তথ্যটুকু কি বিজ্ঞের ন্যায় প্রচার করা হইল! ঘোড়াকে দানাপানি না দিলে সে মরিবে, তাহাতে আর নতুন কথা কী? আর দিলে সে গাড়ি টানিতে পারিবে (অর্থাৎ গায়ের জোরে রুশকে ঠেকাইতে পারিবে, কিন্তু মাঝে মাঝে তোমাকে লাথিও মারিবে। গাড়ি যদি চালাইতে চাও, তবে তেজি ঘোড়া কিঞ্চিৎ দুরন্তপনা তো করিবেই। তুমি ভালো লাগাম কেনো না কেন?
দ্বিতীয় উদাহরণ পণ্য!
কাঠের অভাব হইয়াছে বলিয়া বার্লিনের যেসব অঞ্চলে ইংরেজ-মার্কিন প্রবেশ করিয়াছে, সেখান হইতে স্টালিনি সাইনবোর্ড সরানো হইয়াছে। খদ্দের যখন অশ্ব-বিক্রেতাকে বলিল, বাড়ি গিয়া দেখিলাম, তোমার ঘোড়া খোঁড়া, তখন সে বলিল, আপনার বাড়ি তো বাজারের উত্তর দিকে, ওদিকে চলিলে আমার ঘোড়া খোঁড়া হয়ই! খদ্দের বলিল, তোমার যুক্তিটা তোমার ঘোড়ার মতোই খোঁড়া।
তৃতীয় উদাহরণ,
কোনও কোনও জর্মন মেয়ে ইংরেজ সিপাহিদের নিকট হইতে চকলেট লইয়া চম্পট দেয়। আশ্চর্য! কিন্তু আমাদের এতদিন বিশ্বাস ছিল যে, সবদেশের মেয়েরাই এরকম করে। আর মেয়েদেরই-বা দোষ দেই কেন? তোমাদের সন্তুষ্টিকরণ (এপিজমেন্ট) অস্ট্রিয়া-চেকোশ্লোভাকিয়া চকলেট পকেটস্থ করিয়া হিটলার তো এই সেদিন তোমাদের বিশেষ অঙ্গুলি প্রদর্শন করিয়াছিল। রাজনৈতিক স্মৃতিশক্তি ক্ষীণ হয়, কিন্তু এতটা ক্ষীণ।