আমি বলিলাম, বিলক্ষণ, আমরা লড়াই করিয়া দেশের স্বাধীনতা জিতিতে না পারি, কিন্তু মস্কোর কৌন্সিল-ঘরে আমাদের বক্তৃতা জলতরঙ্গ রুধিবে কে, হরে মুরারে।
কিন্তু সেকথা উপস্থিত ধামাচাপা থাকুক; গোঁফে তেল দিবার সময় এখনও হয় নাই।
আমার জর্মন বন্ধুর যুক্তিতে মার্কিনিংরাজ বিশ্বাস করে। তাহাদের মাথায় ঢুকিয়াছে যে, জর্মন জিঙ্গো যেরকম পাগলা হিটলারকে কার্য উদ্ধারের জন্য দলে নিয়াছিল, জাতধর্ম, কৌলীন্য আভিজাত্য বিসর্জন দিয়া, ঠিক সেইরকম তাহারা লাল হইয়া স্টালিনকে হিটলারের তখতে বসাইয়া দুনিয়ার বাদশাহি করিবে অর্থাৎ নাৎসি গুণ্ডামির বদলে স্টালিনি গুণ্ডামি চালাইবে। দুই গুণ্ডামিই মার্কিনিংরাজের পক্ষে মারাত্মক, মহতী বিনষ্টি। সেই মহাপ্রলয় হইতে রক্ষা পাইবার একমাত্র উপায় জর্মন জিঙ্গোকে বোঝানো যে, তাহারা লাল হইয়া কেন মস্কো দরবারে কুর্নিশ দিতে যাইবে। মার্কিনিংরাজ সাহায্য করিতে প্রস্তুত, জিঙ্গোরা লাল রক্তস্রোতের উপর ভরাপালে মস্কো পৌঁছিবে রাজবেশে। উপস্থিত কোনওগতিকে রুশকে ঠেকাইয়া রাখ; জর্মনি যেন মনের দুঃখে লাল গেরুয়া। পরিয়া বিবাগী হইয়া মস্কো তপোবনে চলিয়া না যায়। অর্থাৎ সেই অতি প্রাচীন চেম্বেরলিন নীতি যতক্ষণ রুশে-জর্মনে লড়াই চলে আমাদের পৌষ মাস, দুই দুশমনে মিলিলেই আমাদের সর্বনাশ।
যদি বলা হয়, এক কাজ করো না কেন, নাৎসিদের শক্তি সম্পূর্ণ বিনষ্ট করিয়া রাজ্যশাসন দেশের জনগণের হাতে ছাড়িয়া দাও। তাহারা যে লাল হইয়া যাইবেই, এ স্বতঃসিদ্ধ পাইলে কোথায়?
মার্কিনিংরাজ বিজ্ঞের ন্যায় মৃদুহাস্য করিয়া বলে, ইতিহাস পড়ো। বাইমার রিপাবলিক যখন জর্মন জনগণকে ভেট দেওয়া হইল তখন তাহারা করিল কী? কোথায় না বাদশাহি মসলন্দে বসিয়া শাহেনশাহিগিরি করিবে তাহা নয়, সেই কাইজারকে তাহার জমিদারির আমদানি কিস্তি খিলাপ না করিয়া হামেহাল পাঠাইল– এদিকে নিজে খাইতে পায় না। মুচি-মেথরকে বলা হইল, রাজা তো হইতে পারিবে না, সিংহাসন নাই, প্রেসিডেন্ট হ, তা নয়, ডাকিয়া আনিল সেই যুঙ্কার পালের গোদা হিন্ডেনবুর্গটিকে। তার পর সেই পাগলা জগাইকে। সে ব্যাটা কালাপাহাড় জাতে অস্ট্রিয়ান হইল জার্মান। মোদ্দা কথা এই, জর্মন আপামর জনসাধারণ যা, যুঙ্কারও তা, নাৎসিও তা। সব শিয়ালের এক রা। বরঞ্চ কট্টর নাৎসিরা ভালো। শক্তির উপাসক। জাতবর্ণহীন স্টালিনি নেড়া-নেড়িদের বিরুদ্ধে ইহাদের কোনও না কোনও দিন শভিনিজম-কারণ খাওয়াইয়া লড়ানো যাইবে। আপামর জনসাধারণ তো কাছাখোলা, লাল গেরুয়া পরিয়া ধেই ধেই করিয়া স্টালিনি সংকীর্তন নাচিবার গাইবার জন্য তৈয়ার হইয়া আছে। তাই জেবিক-হলস্টাইনে নাৎসি জিয়াও আর গোরাদের কড়া বারণ করিয়া দাও যেন জর্মন জনগণের সঙ্গে রাখি না বাঁধে (নন-ফ্রেটারনাইজেশন)। গোরাদেরই-বা বিশ্বাস কী? দুষ্টলোকে বলিতে আরম্ভ করিয়াছে, তাহাদেরও নাকি গোলাপি আমেজ লাগিয়াছে।
ঠিক এইখানটায় মার্কিনিংরাজের সঙ্গে আমার মত মিলে না। আমার বিশ্বাস, জর্মন জনসাধারণ আপন মুক্তি আপন ঐতিহ্যের ভিতর দিয়া খুঁজিয়া পাইতে চায়। স্টালিন-দত্ত গুরুমন্ত্র জপিয়া নয়। আমার মনে আছে ১৯৩২ সালে যখন জর্মনিতে নাৎসি-কম্যুনিস্টে জোর সঁড়ের লড়াই চলিতেছিল তখন নাৎসিরা পথেঘাটে একে অন্যকে অভিবাদন করিত হাইল হিটলার বলিয়া, কম্যুনিস্টরা হাইল মস্কো বলিয়া। গুণীদের বলিতে শুনিয়াছি এই মস্কো-মার্কা বিদেশি ভদকা জর্মন বিয়ার ঐতিহ্য-গর্বিত জনসাধারণ আদপেই পছন্দ করিত না। কে জানে হয়তো এই কথা স্মরণ করিয়াই রুশরা আজ বার্লিনাঞ্চলে জোর করিয়া জর্মনদের হাইল মস্কো বলাইতেছে না। অবান্তর হইলেও একটি কথা বলিবার লোভ হইতেছে। আমাদের দেশি কম্যুনিস্টরা কিন্তু মস্কোবাগে না তাকাইয়া কোনও কর্মই করেন না, কোনও বাক্যই বলেন না। স্টালিন যদি জর্মনির সঙ্গে বন্ধুত্ব করেন তা-ও ভালো, যদি লড়েন তা-ও ভালো, যদি ফিনল্যান্ডের কান মলেন তা-ও ভালো, যদি ফি কমুনিস্টদের তত্ত্বতাবাশ না করিয়া পাসিকিভির সঙ্গে দোস্তি করেন তাও ভালো, ইরান তেল দিল না বলিয়া যদি তাকে ধমক দেন তবে তা-ও ভালো, গ্রিক দেশসেবীদের গাছে চড়াইয়া যদি মই কাড়িয়া লন তবে তা-ও ভালো। কারণ বাতুশকা (ছোট বাপা) স্টালিন সর্ব-বিশারদ, ভগবানের (রাম রাম!) ন্যায় সর্বজ্ঞ। বিরিঞ্চিবাবার ন্যায় তিনি চন্দ্রসূর্য ওয়েল না করিলে আকাশ পাতালের বন্দোবস্ত ভণ্ডুল হইয়া যাইবার নিদারুণ সম্ভাবনা। অতএব হাইল মস্কো। আমাদের এ ধর্ম পছন্দ হয় না। আতাতুর্ক পছন্দ করিতেন না বলিয়াই নব্যতুর্কের স্কন্ধ মক্কাবাগ হইতে ফিরাইয়া আঙ্কারাবাগে স্কু টাইট করিয়া দিয়াছিলেন।
কথা হইতেছিল যে, জর্মন জনসাধারণ আপন মুক্তি আপন ঐতিহ্যের ভিতর দিয়া খুঁজিয়া লইতে চায়। তাই যদি হয় তবে বাইমার রিপাবলিকের বানচাল হইল কী করিয়া?
.
০৩.
সোশ্যাল ডিমোক্রেটদের হাতে রাজ্যচালনার ভার সমর্পণ করাই যে প্রশস্ত ইহা বিচক্ষণ ব্যক্তি মাত্রই স্বীকার করিবেন। তাহার কারণ আমরা পূর্বেই নিবেদন করিয়াছি। বাইমার রিপাবলিককে সাফল্যমণ্ডিত করিবার আপ্রাণ চেষ্টা করিয়াছিলেন সোশ্যাল ডিমোক্রেটরা। জর্মনির খ্যাতনামা পণ্ডিত অধ্যাপক, গুণীজ্ঞানী–এক কথায় যাহারা জর্মনির গর্বশ্বরূপ, তাহারা প্রায় সকলেই ছিলেন বাইমারের পিছনে, সোশ্যাল ডিমোক্রেটরূপে। আমরা বিশেষ করিয়া ইহাদের চিনিতাম, কারণ ইহাদের ভিতর আর্যামি গোঁড়ামি ভণ্ডামি ছিল না।