এতদিন খবর পাইতেছিলাম যে, রমাকান্তগুলিকে ঝাঁকে ঝাঁকে ধরা হইতেছে ও তাহারা যে বিকার হইতে নিষ্কৃতি পাইবে এমন নহে। তাহাদের জন্য বিশেষ গারদ, বিশেষ বিচার, এমনকি বিশেষ হাড়িকাঠও নির্মিত হইতেছে। ফাঁসি অথবা গুলির কর্ম নয়, খাস জর্মন কায়দায় তাহাদিগকে গিলোটিনে গলা দিতে হইবে। আমরা শোক প্রকাশ করিতেছি না, আনন্দিতও হইতেছি না। আমরা ভারতবাসী; কর্মফলে বিশ্বাস করি। দই খাইলে বিকার হইবেই। কিন্তু ইতোমধ্যে হঠাৎ একটি খবর পাইয়া আমরা স্তম্ভিত হইলাম। খবরটি এই জেবিক-হলস্টাইনে নাকি প্রায় সোয়ালক্ষ জর্মন সৈন্য ও অফিসারকে জিয়াইয়া রাখা হইয়াছে। তাহাদের নিরস্ত্র করা হয় নাই। পাছে বিশ্বসুদ্ধ লোক খবর পাইয়া আঁতকাইয়া উঠে, তাই অত্যন্ত সান্ত্বনাপূর্ণ এই খবরটিও সঙ্গে সঙ্গে দেওয়া হইয়াছে যে, তাহাদের রসদ মাত্র দশ রোদ চালাইবার মতো। যে অঞ্চলে এই নোনা ইলিশরা বিরাজ করিতেছেন, সেখানে তাঁহারা সর্বময় কর্তা, এমনকি সে অঞ্চলে যদি তাঁহাদের খানাপিনার অসুবিধা হয়, তবে পার্শ্ববর্তী জর্মনিও সম্ভবত ডেনমার্ক হইতে আহারাদি যোগাড় করিতে পারিবেন। হেমলেটি ভাষায় বলি, ইহারা যে পাঁড় নাৎসি, সেকথা জানাইবার জন্য দৈববাণীর প্রয়োজন নাই।
সঙ্গে সঙ্গে এই খবরও পাইলাম যে, প্রায় ৪৫ মিলিয়ন পাউন্ড খরচা করিয়া (প্রতি বৎসরে না প্রতি তিন বৎসর এ কথাটা রয়টার কাজের হিড়িকে ঘুলাইয়া ফেলিয়াছেন) একটি পাকাঁপোক্ত পোলিশ বাহিনী ইংলন্ডে মজুদ রাখা হইয়াছে। ইহারাও জনবুল মার্কা ষাঁড় লাল রঙের কট্টর দুশমন।
এই যে ইংলন্ডের হাঁড়িতে জিয়ানো যশোরে কই, জেবিক-হলস্টাইনে জমানো পদ্মার নোনা ইলিশ, ইঁহারা লাগিবেন কোন কর্মে কোন পরবে? নতুন রাজনীতির জন্মদিনের দাওয়াতে, না ইউরোপের দ্বিতীয় কাঁপালিক শ্রদ্ধবাসরের ভোজে?
.
০২.
পেটুক ছেলেকে যা কিছু করিতে বলা হউক না কেন, সে আহারাদির আলোচনায় ঠিক পৌঁছিবে। এমনকি একং দশঙের মতো রসকসহীন জিনিস মুখস্থ করিতে বলিলেও সে ঠিক লুচি-মণ্ডায় পৌঁছিবে। কায়দাটা দেখার মতো : একং, দশং, শতং, সহস্র, অযুত; লক্ষ্মী, সরস্বতী, গণেশ, কার্তিক, অগ্রহায়ণ, পৌষ, মাগ (মাঘ) ছেলেপিলে, জ্বর, সর্দি, কাশি; গয়া, বৃন্দাবন, পুরী, রসগোল্লা, সন্দেশ, মিহিদানা, লেডিকিনি ইত্যাদি ইত্যাদি।
গন্তব্যস্থানে পৌঁছিয়াছে, তাহাকে সেখান হইতে নড়ায় কাহার সাধ্য।
ইংরেজ, ফরাসির দৃঢ় বিশ্বাস যে জমনি পেটুক ছেলের মতো। তাহাকে যে কোনও কায়দার সরকার দাও না কেন, সে রাজতন্ত্রই হউক আর গণতন্ত্রই হউক, জর্মনরা ঠিক স্বৈরতন্ত্র ও কুচকাওয়াজতন্ত্রে পৌঁছিবেই। য়ুকার ও রূঢ়ের ধনপতিরা মিলিয়া পৃথিবী জয়ের প্ল্যান আঁটিবেই। ফন পাপেন ও টুসেনে বন্ধুত্ব হইবেই ও পৃথিবী জয়ের জন্য বিদেশি, টুথব্রাশ-গোপওয়ালা, নিরক্ষর উজবুকেরও যদি প্রয়োজন হয় তাহাও সই– যদি সে উজবুক ঠিক ঠিক বক্তৃতা ঝাড়িয়া টেবিল ফাটাইতে পারে ও শান্তিপ্রিয় দেশি-বিদেশির মাথাও এলোপাতাড়ি ফাটাইতে পারে। ইংরেজ-ফরাসি বলে, দেখ না, ১৯১৮-১৯ সালে আমরা জর্মনিকে কীরকম সরেস একখানা বাইমার রিপাবলিক দিয়াছিলাম; কিন্তু সেই একং দশং পড়িতে গিয়া তাহারা ঠিক নাৎসি গুণ্ডামিতে পৌঁছিল। ইহাদের বিশ্বাস নাই, ইহাদের রোম রোম মে বদমায়েশি।
পরাজিত জর্মনিকে লইয়া সমস্যাটা তাহা হইলে এই, তাহাকে স্বাধীনভাবে ছাড়িয়া দেওয়া যায় কি না। যদি না দেওয়া যায় তবে পিটুনি পুলিশ দিয়া তাহাকে আদবকায়দা শিখাইতে হইবে।
১৯৩৯ সালে আমার এক জর্মন বন্ধু আমাকে বলিয়াছিলেন : লড়াই শীঘ্রই লাগিবে। আমরা যদি জিতি, তবে দুনিয়ার রাজত্ব আমাদের হাতে আসিবে আর যদি হারি তাহা হইলেও। কারণ আমাদের পরাজয় অর্থই রাশিয়ার জয়। আমরা তখন লাল হইয়া যাইব। আমাদের প্রতিনিধিরা মস্কোতে যাইবে, সেখানে ভোঁতা রাশিয়ানদের তিন দিনে কাবু করিয়া তামাম ইউএসএসআর আমাদের প্রতিনিধিরাই চালাইবে। রাশিয়ানরা বর্ণবিচার। করেন না, তাহাদের বীজমন্ত্র সর্বোত্তম ব্যক্তি বড়কর্তা হইবে, হউক না সে জর্জিয়ন। যেরকম মুসলমানরা একদিন বলিত, সর্বোত্তম ব্যক্তি খলিফা হইবে, হউক না সে হাবসি। কাজেই কিছুদিনের ভিতরই দেখিতে পাইবে এক জর্মন ক্রেমলিনে বসিয়া দুনিয়া চালাইতেছে। হ্যাঁ, তামাম দুনিয়াটা, কারণ জর্মনি ইউএসএসআরের গুষ্টিতে যদি ঢোকে, তবে বাদবাকি ইউরোপ তিন দিনেই তার খপ্পরে পড়িবে। ইংরেজ, মার্কিন কেউ ঠেকাইতে পারিবে না। তার পর পটপট করিয়া চীন, ভারতবর্ষ, ইরান, ইরাক, মিশর। তার পর? তার পর আর কী? এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা এক অখণ্ড রাজ্য হইলে আমেরিকা-অস্ট্রেলিয়াকে একঘরে করিয়া তিন দিনের ভিতর সমাজের সামনে নাকে খত দেওয়াইব। দেখিবে সব লাল হো জায়েগা, তবে রঞ্জিতি মর্মে নহে।
শুনিয়া বলিয়াছিলাম, তোমার মুখে ফুলচন্দন পড়ুক। তোমার কথাই যদি ফলে, তবে আমরা ভারতবাসীরাই দুনিয়ার রাজত্ব করিব। ভারতবাসীও না, আমরা বাঙালিরাই ক্রেমলিনে বসিয়া নিয়ে নদীর ইলিশ মাছ খাইব ও দুনিয়ার রাজত্ব করিব।
বন্ধু বলিলেন, সে কী কথা? তোমরা বাঙালিরা এমন কী গুণে গুণবান?