একথা আমরা আজ আর তুলিব না যে নর্দিক অর্যে বর্ণসংকর আছে কি না ও থাকিলে কী পরিমাণ। আমাদের বক্তব্য যে, রজেনবের্গ প্রমুখ নাৎসিরা যে আর্যামির বন্যায় জর্মন জাতকে ভাসাইয়া দিবার চেষ্টা করিয়াছিলেন তাহা আমাদের অজানা নহে। এ বন্যা আমাদের দেশেও এককালে বহিয়াছিল ও পরবর্তী যুগে আমাদের রাজনীতিকে গণ্ডিভূত করিবার চেষ্টা করিয়াছিল। এ বিষয়ে পূজনীয় দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর ১২৯৭ সনে কী বলিয়াছিলেন উদ্ধৃত করিতেছি। রজেনবের্গের তখনও জন্ম হয় নাই।
ম্যাকসমুলার ভট্টের অভ্যুদয়ের পূর্বে আর্য বলিয়া যে একটি শব্দ অভিধানে আছে তাহা তাঁহারা (অর্থাৎ আর্যামির পাণ্ডারা) জানিতেন কি না সন্দেহ। তাহার পর ম্যাকমুলার যখন উঠিয়া দাঁড়াইয়া পৃথিবীময় আর্যমন্ত্রের বীজ ছড়াইতে আরম্ভ করিলেন তখন তাহার দুই-এক রত্তি ছিটা তাঁহাদের কর্ণকুহরে প্রবিষ্ট হইবামাত্র সেই মুহূর্ত হইতে তাঁহাদের মানসক্ষেত্রে আর্যামির অঙ্কুর গজাইতে আরম্ভ করিল। বিলাত হইতে আর্যমন্ত্রের আমদানি হইল– আর আমাদের দেশশুদ্ধ সমস্ত কৃতবিদ্য যুবক আর্য আর্য বলিয়া ক্ষেপিয়া উঠিলেন; তাহাদের সহস্র কণ্ঠে উদ্গীত আর্য নামের চিৎকার-ধ্বনিতে ইয়ং বেঙ্গলের গাত্রে থর থর কম্প উপস্থিত হইল। ব্রাহ্মণদের ব্রাহ্মণদেব দানোয়া-পাওয়া শবদেহের ন্যায় মৃত্যুশয্যা হইতে সহসা গাত্রোখান করিয়া পৈতা মাজিতে বসিয়া গেলেন এবং ফিরে-ফির্তি কোমর বাঁধিয়া সন্ধ্যা-গায়ত্রী মুখস্থ করিতে আরম্ভ করিলেন।
আমরা যেরূপ একদিন পৈতা মাজিতে ও সন্ধ্যা-গায়ত্রী মুখস্থ করিতে বসিয়া গিয়াছিলাম, রজেনবের্গ সাহেবও সেইরকম নর্দিক নীল চোখকে নীলতর ও সোনালি চুলকে সোনালিতর করার চেষ্টায় মশগুল হইলেন। আমরা যেরকম ভুলিয়াছিলাম যে
কর্তব্যমাচরন কার্যমকর্তব্যমনাচরন।
তিষ্ঠতি প্রকৃতাচারে স বা আর্য ইতি স্মৃতঃ।
অর্থাৎ কর্তব্য আচরণ করিয়া এবং অকর্তব্য অনাচরণ করিয়া যিনি প্রকৃত আচারে দৃঢ়নিষ্ঠ হন তিনি আর্য শব্দের বাচ্য।
রজেনবের্গ প্রমুখ নাৎসিরাও এই মহাবাক্য ভুলিলেন।
আমরা একদিন ভুলিয়াছিলাম বলিয়া আমাদের রাজনীতি সেদিন সম্প্রদায়মুক্ত হইতে পারে নাই। পরবর্তী যুগে আমাদের রাজনৈতিক আন্দোলন আর্যামির হাত হইতে নিষ্কৃতি পায়। এই আবহাওয়ায় আমাদের নাভিশ্বাস উঠে বলিয়াই জিন্না সাহেব যখন বলেন, কংগ্রেস হিন্দু প্রতিষ্ঠান, তখন আমরা আপত্তি জানাই। সাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠানগুলি স্ব স্ব আর্যামি লইয়া থাকুন; কিন্তু সাম্প্রদায়িক দম্ভের উপর প্রতিষ্ঠিত নাৎসি আন্দোলনের ভাগ্যচক্রগতি দেখিয়া যেন পদক্ষেপ করেন।
নাৎসিদের এই দম্ভের চরম প্রকাশ হইল পৃথিবী জয়ের বাসনায়। তাহার পূর্বে জর্মনি জয়ের কার্যে তাহারা নিযুক্ত হইলেন। ইহুদিদের নির্যাতন; নাৎসি সাম্প্রদায়িকতায় যাহারা বিশ্বাস করেন না তাঁহাদের উৎপীড়ন, এমনকি জ্ঞান-বিজ্ঞানের মন্দির হইতে হাইনে, আইনস্টাইন, মানি প্রভৃতি মৃত জীবিত মনষীদের বহিষ্করণ।
বিচক্ষণ জর্মনরা যে ইহার বিরুদ্ধে কিছু বলে নাই এমন নহে। শুধু বিচক্ষণেরাই যে নাৎসি-দর্শনের প্রতিবাদ করিয়াছিলেন তাহা নহে, জর্মনির জনসাধারণও তাহাদের ব্যঙ্গোক্তি আড়ালে অন্তরালে অনেকখানি প্রকাশ করিয়াছিল। একটি ধাঁধার ভিতর দিয়া সে ব্যঙ্গোক্তি, তাহারা বিদেশিদের কাছে প্রকাশ করিত ও তাহাদের নাৎসি তন্ত্রজ্ঞানের পরীক্ষা লইত।
ধাঁধাটি এই—
প্রশ্ন : আদর্শ আর্য কে?
উত্তর : তাহার জন্ম হইবে ফুরারের দেশে, সে বীর প্রস্থে হইবেন গ্যোরিঙের ন্যায়, দৈর্ঘ্যে গ্যোবেলসের ন্যায়, নামে রজেনবের্গের ন্যায়, কার্যক্ষেত্রে ফন রিবেট্রপের ন্যায়। (সকলেই জানেন হিটলারের জন্মভূমি জর্মনি নয়, গ্যোরিঙ ও গ্যোবেলসের একজন মোটা একজন বেঁটে; রজেনবের্গের নামে আছে ইহুদি নামের বোটকা গন্ধ ও রিবেট্রপ শৌকি।)।
তবু স্বীকার করিতে হইবে যে, আর্যামি জর্মনিতে ব্যাপকভাবে ছড়াইয়া পড়িয়াছিল; পরে সে আর্যামির দম্ভ চেকোশ্লোভাকিয়া, অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি প্রভৃতি বিজিত দেশে, এমনকি ইতালির ন্যায় মিত্ররাজ্যে (কাউন্ট চানোর অধুনাপ্রকাশিত রোজনামচা দ্রষ্টব্য) তীব্র অসন্তোষের সৃষ্টি করিয়াছিল। আজ যে রুশেরা বন্ধানে অনেকটা সুবিধা পাইতেছে, তাহার কারণ এই নহে যে বল্কানরা সকলেই ভাবে যে, রুশ তাহাদের পরম মিত্র, বরঞ্চ যুক্তিধারা অনেকটা এইরকম : শত্রুর শত্রু মিত্র না-ও হইতে পারে, কিন্তু মিত্রবৎ।
জর্মনির নাৎসি কর্তারা কী রাজরাজেশ্বরের হালে দিন কাটাইতেন, সে সকলেই জানেন। গাঁজার নেশাটা করিলেন কর্তারা, মাথাধরাটা পাইল জনসাধারণ। তাহারা প্রাণ দিল রুশিয়ার দুস্তর প্রান্তরে ক্ষুধায় শীতকষ্টে অথবা রুশনগরদ্বারে, রাস্তায় গলিতে গুলিতে বিস্ফোটকে; অথবা নরমাদিতে সামনে মিত্রশক্তির ট্যাঙ্ক, কামান, উপরে বোমারু, পিছনে ফরাসি গেরিল্লা মাতা বসুন্ধরা তাহাদের আবেদন শুনিবার পূর্বেই বোমারু জাহাজ মাতার বক্ষস্থল বিদীর্ণ করিয়া দিতেছিল, কিন্তু হায়রে, সেখানেও আশ্রয় কোথায়?
দেশের কথায় বলে, খেলেন দই রমাকান্ত বিকারের বেলা গোবর্ধন। আজ সমস্ত জৰ্মনি জুড়িয়া যে বিকার ও ভবিষ্যতে যে কী সান্নিপাতিক জ্বর হইবে, তাহার কল্পনা করাও আমাদের পক্ষে শক্ত। ইংরেজ, আমেরিকান, রুশ ত্রিদোষ হইয়া জর্মনির গোবর্ধনগুলিকে কোন শ্মশানযাত্রায় লইয়া যাইতেছেন, তাহার খবর কে রাখে।