সর্বশেষে বক্তব্য, পাঠক যেন না ভাবেন, মন্দ উচ্চারণে আমরাই একা। আর্যসভ্যতার অন্য প্রান্ত অর্থাৎ ইংলন্ডের অবস্থাও তাই। সেখানে বড় বড় পণ্ডিতদের লাতিন উচ্চারণ শুনিলে কানে আঙুল দিতে হয়। তবে ইংলন্ডে উচ্চারণ শুদ্ধ করিবার জন্য জোর আন্দোলন চলিতেছে, এদেশে–থাক সে কথা।
.
০২.
উচ্চারণ সম্বন্ধে আলোচনায় যোগ দিয়াছেন শ্ৰীযুত মুখোপাধ্যায়, কাব্য ব্যাকরণস্মৃতিতীর্থ, সাহিত্যশাস্ত্রী, ভূতপূর্ব অধ্যাপক, সংস্কৃত কলেজ। পাঠক বুঝিতে পারিতেছেন, এহেন পণ্ডিতের সঙ্গে উচ্চারণ সম্বন্ধে আমি আলোচনা করিতে পারি, কিন্তু তর্ক করিবার মতো যুগ্ম মস্তক স্কন্ধে নাই। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে শাস্ত্রী মহাশয়ের শেষ বাক্য আমাদের মতের সঙ্গে মিলিয়া গিয়াছে বলিয়া তর্কাতর্কির বিশেষ প্রয়োজন হইবে না। তাঁহার শেষ বাক্য সকল কথার পর তবুও স্বীকার্য যে, বাঙালির সংস্কৃত উচ্চারণ ত্রুটিপূর্ণ, কিন্তু তাহার পূর্বে সকল কথার মাঝখানে শাস্ত্রী মহাশয় এমন কথাও তুলিয়াছেন যেখানে অধম কিঞ্চিৎ প্রগলভতা প্রকাশ করিবে। শাস্ত্রী মহাশয় এবং অন্যান্য সহৃদয় পত্রপ্রেরকও দর্শাইয়াছেন যে, অবাঙালি সংস্কৃত পণ্ডিত ষ ও খতে পার্থক্য রাখেন না। কিন্তু তাহা হইতে কী সপ্রমাণ হয় ঠিক পরিষ্কারভাবে বুঝাইয়া বলেন নাই। ব্যঞ্জনায় বুঝিতেছি শাস্ত্রী মহাশয়ের বলার উদ্দেশ্য যে, যেহেতুক অবাঙালি পণ্ডিতও ঠিক ঠিক উচ্চারণ করিতে পারেন না, তবে বাঙালিরই-বা দোষ কী?
ইহার উত্তরে বক্তব্য এই যে, মারাঠি, দ্রাবিড় ও কাশীর পণ্ডিত যখন সংস্কৃত উচ্চারণ করেন, তখন প্রাদেশিক বৈশিষ্ট্যবশত কিছু কিছু পার্থক্য তাহাদের উচ্চারণের মধ্যে থাকে। ওইসব পণ্ডিতের একে অন্যের উচ্চারণে যে পার্থক্য তাহা যেন একইরঙের পৃথক পৃথক ফিকা ভাব অথবা গাঢ়। বাঙালির উচ্চারণ যেন সম্পূর্ণ ভিন্ন রঙ। দক্ষিণের আইয়ার হয়তো যতটা দীর্ঘ করিলেন, উত্তরে কাশীবাসী হয়তো ততটা করিলেন না। এবং শেষ পর্যন্ত বাঙালি যে অত্যন্ত পৃথক কিছু উচ্চারণ করে তাহা এই তথ্য হইতে সপ্রমাণ হয় যে, আইয়ার, নষুদ্ৰী, চিতপাবন, দেশ, করাঢ় (এমনকি মহারাষ্ট্রের দেশস্থ ও ঔপনিবেশিক দ্রাবিড়স্থ), উদীচী, ভার্গব, নাগর ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়গণ ও তাঁহাদের শিষ্য ব্রাহ্মণগণও একে অন্যের উচ্চারণের পার্থক্য লইয়া ঈষৎ আলোচনা করিয়া একটি সাধারণ রূপ বা নর্ম (norm) স্বীকার করেন, কিন্তু বাঙালির উচ্চারণ যে সম্পূর্ণ পৃথক এবং পরস্পর-বিরোধিতায় কণ্টকাকীর্ণ সে সম্বন্ধে কোনও সন্দেহ প্রকাশ করেন না।
(ভিন্ন ভিন্ন প্রদেশে উচ্চারণের পার্থক্য হয় প্রধানত দীর্ঘস্বরের দৈর্ঘ্য, হ্রস্বস্বরের হ্রস্বতা, ঝ, ৯, ও ষ লইয়া। সব কয়টির আলোচনা এক কলমে ধরাইবার মতো কলমের জোর অধমের নাই। উপস্থিত য লইয়া আলোচনা করিব, পরে প্রয়োজন হইলে অন্যান্যগুলির হইবে। ষ যে খ নয় সে বিষয়ে তর্ক করিবার কোনও প্রয়োজন নাই। কিন্তু ষ-এর উচ্চারণ কেন খ হইল তাহার আলোচনা করিলে মূল ষ-এর কিঞ্চিৎ নির্দেশ পাওয়া যায়। প্রথম দ্রষ্টব্য ষ স্থলে বিদেশি পণ্ডিত যখন খ বলেন, তখন তাহারা দুই দলে বিভক্ত; কেহ কেহ উচ্চারণ করেন পরিষ্কার খ অর্থাৎ ক বর্গের মহাপ্রাণ খ এবং কেহ কেহ উচ্চারণ করেন ঘর্ষণজাত আরবির খ— কাবুলিরা যেরকম খবর বলে, স্কচরা যেরকম লখ LOCH বলে, জর্মনরা যেরকম BACH বলে। এই দ্বিতীয় খ উচ্চারিত হয় পণ্ডিত যখন ষ-কে শ হইতে পৃথক করিবার জন্য অত্যধিক উল্কণ্ঠিত হইয়া জিহ্বা মূর্ধা হইতে সরাইয়া আরও পশ্চাৎ দিকে ঠেলেন। এই কারণেই আর্যভাষা পশতুতেও তাহা দেখা যায়– কেহ বলে পশুতু, কেহ বলে পখতু, কেহ বলে পেশাওয়ার, কেহ বলে পেখাওয়ার। এই কারণে জর্মনে Becher-এর ch ষ-এর মতো, অথচ Bach-এর ch আরবি খ-এর ন্যায়। ষ-কে এইজাতীয় খ করা অবশ্য ভুল, আমি মাত্র কারণটি ও নজিরগুলো দেখাইলাম। কিন্তু ষ-এর আসল শুদ্ধ উচ্চারণ সম্বন্ধে মতানৈক্য হওয়া অনুচিত। অত্যধিক উল্কণ্ঠিত (উভয়ার্থে) না হইয়া মুখগহ্বরের যে স্থল অর্থাৎ মূর্ধা হইতে ট, ঠ, ড, ঢ ও পরে ওই স্থলে য বলিলে মূর্ধণ্য য বাহির হইবে।)
বাঙালির সংস্কৃত উচ্চারণের কৈফিয়ৎ দিয়াছেন হিন্দুস্থান পার্ক হইতে শ্রীআচার্য। তাহার বক্তব্য কোনও ভাষা আয়ত্ত করিতে হইলে তার সাহিত্য, ব্যাকরণ এবং ধ্বনিতত্ত্বে পারদর্শী হওয়া বাঞ্ছনীয় সন্দেহ নাই। আমাদের মতের সঙ্গে আচার্য মহাশয়ের মতে মিলিল কিন্তু তিনি বলিতেছেন—
কিন্তু জাতীয় অভ্যাসের প্রতিকুলতা নিবন্ধন যদি সেই ভাষার উচ্চারণে অসম্পূর্ণতা থাকিয়া যায়, তাহাতে কোনও পণ্ডিত ব্যক্তির লজ্জা পাওয়ার কোনও কারণ আছে বলিয়া মনে করি না।
আচার্য মহাশয় তাহার চিঠিতে নিজের কোনও উপাধির উল্লেখ করেন নাই, অথচ পত্রখানি গভীর, পাণ্ডিত্যে পূর্ণ। তাই প্রতিবাদ করিতে সাহস পাইতেছি না, অথচ উপরের নীতিটি এতই বিপজ্জনক যে, নিতান্ত অনিচ্ছায় করিতেছি। কারণ যদি এই নীতিই অনুসরণ করিতে হয়, তবে বলিতে হইবে যেহেতু আমরা বাঙালি, আমাদের জাতীয় অভ্যাসের প্রতিকূল হয় তাই আমরা F ও ফয়ের তফাৎ করিব না, th-এর শুদ্ধ উচ্চারণ শিখিব না, কুরান বঙ্গীয় ইসলামি কায়দায় পড়িব, মন্দাক্রান্তার দীর্ঘ না মানিয়া উদয়াস্ত কালিদাসকে জবাই করিব। এই নীতি আরও অনুসরণ করিয়া বলিব, আমরা বাঙালি, বাঙলা ভাষার লিঙ্গ নাই, সংস্কৃত লিখিবার সময় লিঙ্গভেদ করিব না। দ্বিবচন মানিব না; হিন্দি বলিবার সময় একঠো, দুইঠো করিব, গাড়ি আতা হৈ বলিব– এক কথায় জাতীয় অভ্যাসের দোহাই দিয়া বিজাতীয় কোনও ভাষাই তাহার স্বরূপে গ্রহণ করিব না; সুকুমার রায়ের হ য ব র ল-য়ের দর্জির ৩২ ইঞ্চি ফিতা দিয়া মাপিলে যেমন সবকিছু ৩২ ইঞ্চি হইয়া যাইত। আমাদের জাতীয় অভ্যাসের বকযন্ত্রে চোলাই করা সর্ব উচ্চারণ শুদ্ধ একহল হইয়া বাহির হইবে তাহার বর্ণগন্ধ থাকিবে না।