বাঙালি যখন আরবি উচ্চারণ করে, তখন এই মারাত্মক অবস্থার পুনরাবৃত্তি হয়। বাঙালি (কি হিন্দু কি মুসলমান) আরবি বর্ণমালার সে, হে, জাল, স্বাদ, দ্বাদ, তৃয়, জয়, আইন, গাইন, কাফ, হামজা, অর্থাৎ বর্ণমালার ৪, ৬, ৯, ১৪, ১৫, ১৬, ১৭, ১৮, ১৯, ২১ ও ২৯ ভুল উচ্চারণ করে ও সংস্কৃতে হ্রস্ব-দীর্ঘ যেমন অবহেলা করিত, সেইরকমই আরবিতেও স্বরের হ্রস্ব-দীর্ঘের কোনও পার্থক্য করে না। কিন্তু শুধু কোরান পাঠের জন্য এক শ্রেণির বিশেষজ্ঞ আছেন। তাহাদিগকে কারী বলে; দ্রাবিড়ে যেমন সামবেদ গাহিবার জন্য এক শ্রেণির বিশেষ আইয়ার– আয়ঙ্গার ব্রাহ্মণ আছেন। বাঙালি কারীরা দীর্ঘ-হ্রস্ব মানেন ও ব্যঞ্জনে শুধু ৪, ৯, ১৫-তে ভুল করেন।
আমরা সংস্কৃত উচ্চারণে ভুল করি তাহার প্রধান কারণ, আমরা আর্য-সভ্যতার শেষ সীমা প্রান্তে বাস করি। (আর্য-সভ্যতা বাঙলা ছাড়াইয়া বর্মায় যাইতে পারে নাই ও বালি-জাভায় বিকশিত হইল বটে, কিন্তু প্রাণধারণ করিতে পারিল না)। আমাদের ধমনিতে আর্য-রক্ত অতি কম বলিয়াই আর্য উচ্চারণ করিতে অক্ষম হই। আমরা যে আরবি উচ্চারণ করিতে পারি না, তাহাও ঠিক সেই কারণেই। আরবি সেমিতি ভাষা, তাহার যেসব কঠিন উচ্চারণ মুখের নানা গোপন কোণ হইতে বহির্গত হয়, তাহা বাল্যকাল হইতে না শুনিলে আয়ত্ত করা প্রায় অসম্ভব।
গত শুক্রবারে রেডিয়োতে কোরান পাঠ ও শনিবারে সংস্কৃত শাস্ত্র পাঠ ও উভয়ের বাঙলা অনুবাদ ও টিপ্পনী শুনিয়া উপরোল্লিখিত চিন্তাধারা মনের ভিতর তরঙ্গ খেলিয়া গেল। রেডিয়োর কোরান পাঠ মুসলমানদের কাছে আদর পাইয়াছে কি না জানি না, কিন্তু তাহারা যে কান দিয়া শুনেন সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। এক বৃহৎ মুসলমান পরিবারে লক্ষ করিয়াছি, বুড়া কর্তারা রেডিয়োটা দুই চক্ষে দেখিতে পারেন না, দুই কানে শুনিতে পারেন না। তাহাদের বিশ্বাস ইসলামে সঙ্গীত অসিদ্ধ ও ওই যন্ত্রটি সেইসব শয়তানি জিনিস লইয়া কারবার করে, ছোকরাদের বিগড়াইয়া দেয়। অথচ শুক্রবার সকালবেলা দেখি গুঁড়িগুড়ি রেডিওঘরের দিকে চলিয়াছেন তাবৎ বুড়াবুড়িরা। আধ ঘণ্টা পূর্ব হইতে কলকাতা ছাড়া অন্য কোনও বেতারকেন্দ্রে রেডিয়ো জুড়িবার উপায় নাই। তার পর মুদ্রিত চক্ষে ভক্তিরসে পরিপূর্ণ হৃদয়ে অতি নীরবে কোরান পাঠ শ্রবণ করেন। অনুবাদ ও টিপ্পনী কেহ শোনেন, কেহ শোনেন না।
এই সব বৃদ্ধ-বৃদ্ধার প্রতি কলকাতা কেন্দ্রের কর্তব্য আছে।
যে কারী সাহেব কোরান পাঠ করিলেন, তাহার উচ্চারণ সাধারণ বাঙালি কারী অপেক্ষা ভালো সন্দেহ নাই। তাঁহার দীর্ঘ-হ্রস্ব দুরস্ত, তাঁহার আইন কাফ হে ঠিক, কিন্তু তাঁর সে জাল ও দ্বাদ (4, ৯, ১৫) বারে বারে দুঃখ দেয়, বিশেষ করিয়া সে ও জাল, কারণ ইজা (যখন) ও সুম্মা (তৎপর) দুইটি কথা আরবিতে এবং সর্বভাষাতেই ঘন ঘন আসে।
কারী সাহেবের বাঙলা উচ্চারণে আরবির গন্ধ পাওয়া যায়– পাদ্রি সাহেবের বাঙলাতে যেরকম ইংরেজি গন্ধ আমাদিগকে পীড়িত করে আমরা বাঙলায় বলি যখন (যখোন), কারী সাহেব বলেন, য্যখ্যন যেন য ও খ-র ভিতরে আরবি আকার বা জবর রহিয়াছে।
শাস্ত্র যিনি পাঠ করিলেন তাহার উচ্চারণ সাধারণ বাঙালি অপেক্ষা শতগুণে ভালো সন্দেহ নাই কিন্তু কোনও মারাঠি বা যুক্তপ্রদেশীয় পণ্ডিত সে উচ্চারণের প্রশংসা করিবেন না। তাহার প্রধান কারণ যে শাস্ত্ৰ-পাঠকের হ্রস্ব-দীর্ঘ যথেষ্ট পরিমাণে হ্রস্ব ও যথেষ্ট পরিমাণে দীর্ঘ নহে। হ্রস্ব-দীর্ঘে তিনি এত সামান্য পৃথক করেন যে, বানান জানা সত্ত্বেও কানে ঠিক ঠিক বাজে না। তাঁহার বাঙলা উচ্চারণও পণ্ডিতি অনেকটা কথক-ঠাকুরদের মতো।
দুইজনেরই অনুবাদ ও টীকা নৈরাশ্যজনক। প্রভু ইসা (খ্রিস্ট) ও হাওয়ারিগণের বর্ণনা বাঙলার মুসলমান কী প্রকারে বুঝিবে, তাহাতে যদি বেশ কিছুদিন ধরিয়া প্যালেস্টাইনের ইতিহাস ও ভূগোল না শোনানো হয়। সকলেই তো শূন্যে ঝুলিতে থাকিবেন ও শাস্ত্র শোনা হইবে বটে, কিন্তু বোঝা বা আলোচনা তো হইবে না।
শাস্ত্ৰ-পাঠক যে ঊর্ধ্বশ্বাসে অনুবাদ ও টীকা করিয়া গেলেন তাহাতে আমার মতো মূর্খ কিছুই বুঝিতে পারিল না। টোলে কৃতবিদ্য ছাত্রকে যে ধরনে দ্রুতগতিতে টীকা শোনানো হয়, ইহার অনেকটা তাই। সাধারণ বাঙালি ধৰ্মতৃষিতকে আরও সরল, আরও সহজ করিয়া না বুঝাইলে টীকাদান পণ্ডশ্রম হইবে।
কারী সাহেব ও শাস্ত্রী মহাশয়ের নিন্দা করা আমাদের উদ্দেশ্য নহে; আমরা জানি তাহারা যে কোনও মসজিদ-মাদ্রাসা, যে কোনও টোল-চতুম্পাঠীতে সম্মান ও আদর পাইবেন– আমরাও দিব। কিন্তু অল ইন্ডিয়া রেডিওর উচিত আরও ভালো আরও উত্তম, এক কথায় সর্বোত্তম কারী সর্বোত্তম শাস্ত্ৰপাঠক আনয়ন করা। ইংরেজিতে বলে, সর্বোত্তম উত্তমের শত্রু।
তাবৎ বাঙলা ও কিছু কিছু বিহার উড়িষ্যা আসামকে সপ্তাহের পর সপ্তাহ যে উচ্চারণ পরিবেশন করা হয় তাহার জন্য রেডিওকর্তার দায়িত্বজ্ঞান ও বিবেকবুদ্ধি অনেক বেশি হওয়া উচিত ও তাহাদিগকে অনেক পরিশ্রম করিয়া সর্বোত্তম কারী-শাস্ত্রী সন্ধান করা উচিত। অথবা অর্থব্যয় করিয়া উপযুক্ত লোক প্রস্তুত করা উচিত।
শুনিয়াছি মিশরের কারী রেফাৎ রমজান মাসে কোরান পাঠের জন্য ১৩০০ টাকা পারিশ্রমিক পান; কাইরো কলকাতা অপেক্ষা ধর্মপ্রাণ একথা কে বলিবে?