প্রথমত, কর্মী যুবকগণ মিলিত হইবেন ও কে কে বাসি কাগজ দিতে সম্মত হইবেন তাহার ফর্দ প্রস্তুত করিয়া যে খবরের কাগজ সরবরাহ করে তাহারই দ্বারা তাহাকে কিঞ্চিৎ অর্থ দিয়া কাগজ জমায়েত করিতে হইবে।
দ্বিতীয়ত, স্কুল সব-ইন্সপেক্টর মহোদয়কে আক্রমণ করা। অতি সবিনয়ে তাঁহার সম্মুখে প্ল্যানটি উপস্থিত করিতে হইবে– অতি সবিনয় অতি সভয়। তিনি সাহায্য করিতে প্রস্তুত হইলে অর্ধেক কেল্লা ফতেহ। তাঁহার সহযোগিতায় যে যে পাঠশালায় প্রধানশিক্ষক শুধু বেতন কমাইয়াই (সে কত অল্প আমি জানি, কাজেই ব্যঙ্গ করিতেছি না) সন্তুষ্ট নহেন তাহার ফর্দ করিতে হইবে।
তৃতীয়ত, তাহাদিগকে নিমন্ত্রণ করিয়া শহরে একটি সভা করিয়া বিষয়টি আলোচনা করিতে হইবে।
তখন যে কর্মপদ্ধতি স্থির করা হইবে তাহাতে যত ভুলচুকই থাকুক তাহাই ঠিক। অধমের পদ্ধতির প্রতি তখন যেন কোনও অহেতুক করুণা না দেখানো হয়।
সন্তর্পণে ঝোপ দেখিয়া কোপ মারিতে হইবে, অর্থাৎ তীক্ষ্ণ ট্যাক্ট সহযোগে মাস্টার মহাশয়ের সদয় সহযোগ না পাইলে সব গুড় মাটি হইয়া যাইবে।
যদি সব-ইন্সপেক্টর মহোদয়ের সাহায্য না পাওয়া যায়, তবে বোর্ডের চেয়ার-ভাইস-চেয়ারম্যান তদভাবে কোনও মুরুব্বি মেম্বরের সাহায্য লইয়া কাজ করা যাইতে পারে। কিন্তু আমি নিজে সব-ইন্সপেক্টর মহোদয়গণের প্রতি অবিচল শ্রদ্ধা রাখি। যে সব-ইন্সপেক্টর মহোদয়কে স্মরণ করিয়া প্রথম প্রবন্ধ লিখিয়া ছিলাম, তিনি যেখানেই থাকুন না কেন, এ বিষয়ে আপ্রাণ সাহায্য করিবেন ও আমার অন্ধ বিশ্বাস, তাঁহার মতো জীবন্ত কর্মী বাঙলা দেশে আরও আছেন।
কাহারও সাহায্য না পাইলেও কাজ আরম্ভ করা যায় শুদ্ধ গুরুমহাশয়কে যদি দলে টানা সম্ভবপর হয়। তিনি রাজি হইলে বাকি সবকিছুই সরল।
যাহারা নৈশ বিদ্যালয় চালান তাহাদের পক্ষে কর্মটি তো সরলই।
এতটা কাজ আগাইলে পর কর্মীরা যদি আমাকে পত্র লিখিয়া সুবিধা-অসুবিধার কথা জানান, তবে আমি তাহাদিগকে সোজা উত্তর দিব ও সম্ভব হইলে দুর্বল শরীর সত্ত্বেও সরেজমিন উপস্থিত হইয়া যেটুকু সামান্য সাহায্য সম্ভব তাহা নিবেদন করিব।
কী পড়াইতে হইবে, কোন কায়দা পড়াইতে হইবে, সে আলোচনা বারান্তরে করিব। ইতোমধ্যে এই শীতকালই কাজ আরম্ভ করার পক্ষে প্রশস্ত।
সর্বশেষে আমাদের কাগজের আনন্দমেলা হইতে কিছু উদ্ধৃত করিতেছি।
কামাখ্যাচরণ ভট্টাচার্য (১৪৪১৬) দর্শনা মণিমেলা, নদীয়া গত ১৭ আগস্টের আনন্দবাজারে সত্যপীরের লেখা নিরক্ষরদের অক্ষর পরিচয় করানোর যে প্রবন্ধ বেরিয়েছিল তা তুমি পড়েছ জেনে খুশি হলাম। মণিমেলার অন্যান্য বন্ধুরা ওই লেখাটি পড়ে এদেশের নিরক্ষরতা দূর করবার সহজ কতকগুলি পন্থা ধরে কাজ করার চেষ্টা করবে, এ বিশ্বাস আমি রাখি।
বালক কাজে ঝাপাইয়া পড়িল, তবে আমরা অতশত দুর্ভাবনা করি কেন।
.
উচ্চারণ
০১.
প্রবাদ আছে, বঙ্গদেশে সংস্কৃত উচ্চারণ এককালে এমনই বিকৃত হইয়া পড়িয়াছিল যে, মহারাজা আদিশূর কানাকুজ হইতে শ্রীহর্ষ, ভট্টনারায়ণ (কেহ কেহ বলেন ক্ষিতীশ, মেধাতিথি) ইত্যাদি পাঁচজন ব্রাহ্মণকে এদেশে নিমন্ত্রণ করিয়া আনয়ন করেন। তাহারা এদেশের লোককে শুদ্ধ সংস্কৃত উচ্চারণ কতটা শিখাইতে সমর্থ হইয়াছিলেন জানিবার উপায় নাই। ইহার পর আমাদের জানামতে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ এদেশে আবার সেই চেষ্টা করেন। কিন্তু তাহার চেষ্টাও ব্যর্থ হয়।
ইতোমধ্যে শত শত বছর ধরিয়া বহু বাঙালি বিদ্যার্থী কাশীতে সংস্কৃত শিখিয়া আসিয়াছেন, কিন্তু তাহাদের উচ্চারণও এদেশে প্রভাব বিস্তার করিতে পারে নাই। এমনকি কাশী-প্রত্যাবৃত্ত কোনও কোনও বাঙালি পণ্ডিতকে আমরা খাঁটি বাংলা উচ্চারণে সংস্কৃত পড়িতে শুনিয়াছি। সন্দেহ হইতেছে খাস কাশীতেও বাঙালি চালিত টোলে বাংলা কায়দায় সংস্কৃত উচ্চারণ শিখানো হয়।
বাংলা কায়দায় সংস্কৃত উচ্চারণ ব্যাপারটা যে কতদূর মারাত্মক তাহা একটি সামান্য উদাহরণ হইতেই পাঠক বুঝিতে পারিবেন। প্রায় পঁচিশ বছর পূর্বে ইতালির খ্যাতনামা সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত অধ্যাপক তুচ্চি কলকাতার তকালীন এক বিখ্যাত পণ্ডিতের সঙ্গে শাস্ত্রালোচনা করিতেছিলেন। কথায় কথায় পণ্ডিতশ্রেষ্ঠ ঋষি যাজ্ঞবন্ধ্যের নাম উচ্চারণ করেন। বাঙালি যে কায়দায় করে, সেই কায়দায়ই করিলেন, অনেকটা জাগেগাঁবোল্কোর ন্যায়। তুচ্চি তো কিছুতেই বুঝিতে পারেন না। কাহার কথা হইতেছে। পণ্ডিতের চক্ষুস্থির যে তুচ্চির মতো লোক যাজ্ঞবন্ধ্যের নাম শোনেন নাই। তুষ্টি প্রত্যাশা করিতেছেন যাজ্ঞবন্ধ্যের শুদ্ধ উচ্চারণ অনেকটা Yajnyavalkya-র ন্যায়, শুনিতেছেন Jaggonbolkol. বুঝিবেন কী প্রকারে যে একই ব্যক্তি!
বাঙালির সংস্কৃত উচ্চারণ এতই কর্ণপীড়াদায়ক যে, আমাদের পরিচিত দুইটি পশ্চিম ভারতীয় ছাত্রকে বাধ্য হইয়া কলকাতা কলেজে সংস্কৃত অধ্যয়ন ত্যাগ করিতে হইল। পরশুরামের গল্পেীজী মেঘনাদবধকাব্য উচ্চারণ করিলে আমাদের কর্ণে যে পীড়ার সঞ্চার হইবে, আমাদের সংস্কৃত উচ্চারণ পশ্চিম ও উত্তর ভারতীয়দের সেই রকমই পীড়া দেয়।
বাঙালি সংস্কৃত ব্যঞ্জনের ঞ, ণ, য, অন্তস্থ ব, ষ, স উচ্চারণ করিতে পারে না ও যুক্তাক্ষরের (আত্মা, যক্ষ ইত্যাদি) উচ্চারণে অনেকগুলি ভুল করে। স্বরবর্ণের অ, ঐ, ঔ ভুল উচ্চারণ করে ও সর্বাপেক্ষা মারাত্মক এই যে স্বরের উচ্চারণে দীর্ঘশ্বরের প্রতি ক্ষেপমাত্র করে না। তাহাতে বিশেষ করিয়া মন্দাক্রান্তা পড়িলে মনে হয় ভগবানের অপার করুণা যে, কালিদাস জীবিত নাই।