কিন্তু সর্বাপেক্ষা মারাত্মক ব্যাপার এই যে, লিখিতেছি সূক্ষ্ম, বলিতেছি শুকখ; লিখিতেছি আত্মা বলিতেছি আত্তা; লিখিতেছি উর্ধ, বলিতেছি উর্দো বা উর্ধো–দ ব অথবা ধ ব বৃথাই লেখা হইতেছে। শিশু যখন পড়ে স+উ-ক+ষ+ম, সে উচ্চারণ করিতে চাহে শুদ্ধ সংস্কৃতে যেরকম করা হয়–সূকষম। কিন্তু বেচারাকে চোখের জলে নাকের জলে শুদ্ধ উচ্চারণ লিখিতে হয়। সংস্কৃতে যাহা যুক্তিযুক্ত, বাঙলাতে তাহা খামখেয়ালি।
তাই দেখা গিয়াছে, দ্বিতীয় ভাগ হইতে বেশিরভাগ ছেলে যুক্তাক্ষরের ধাক্কা সহিতে না পারিয়া অক্কা পায়। তাই দেখা গিয়াছে, বয়স্ক সাক্ষর বহুদিন লেখাপড়া চর্চা না করিয়া পুনরায় পড়িতে বা লিখিতে যায়, তখন সেই এককালীন সাক্ষর টক্কর খায় যুক্তাক্ষরে।
আমাদের লিখন ও উচ্চারণের বৈষম্য এত বিকট যে, ইহাই নিরক্ষরতা ও সাক্ষরের নিরক্ষরতায় পুনরায় ফিরিয়া যাওয়ার দ্বিতীয় প্রধান কারণ।
কিন্তু উপায় কী?
অদ্যকার লেখা শেষ করিবার পূর্বে একটি কথা না বলিয়া শান্তি পাইতেছি না। যখন গড়িমসি করিতেছিলাম, এ বিষয় লইয়া আর আলোচনা করিব কি না, তখন হঠাৎ দেখি সোমবারের আনন্দমেলায় একটি বালক– বালক মাত্র– বলিতেছে যে, সে নিরক্ষরকে সাক্ষর করা সম্বন্ধে প্রবন্ধ পাঠ করিয়া কাজে লাগাইবার চেষ্টা করিতেছে।
ভগবানকে অজস্র ধন্যবাদ, আমার শ্রম সার্থক হইয়াছে। বালকটিকে আমার আশীর্বাদ, সে আমাকে মনের জোর দিয়াছে।
.
০৩.
গত আগস্ট*[* ১৯৪৬-এর আগস্ট মাস।] মাসে উপযুক্ত শিরোনামায় দুইটি রচনা নিবেদন করিয়াছিলাম। সত্যপীরের বয়স যখন অতি অল্প, তাহার বালসুলভ চপলতা কেহই লক্ষ করিবে না, এই ভরসায় উপযুক্ত বিষয় লইয়া তখন অত্যধিক বাক্যাড়ম্বর করি নাই। কিন্তু বাঙলা দেশে সহৃদয় পাঠকের অভাব নাই। তাহারা লেখা দুইটি পড়িয়া এযাবৎ অধমকে বহু পত্রাঘাত করিয়াছেন। তুলসীদাসের চৌপদীটি মনে পড়িল :
জো বালক কহে তোতরী বাতা
সুনত মুদিত নেন পিতু অরু মাতা
হসিহহি কূর কুটিল কুবিচারী
জো পরদোষভূষণধারী
বালক যখন আধ আধ কথা বলে, তখন পিতা এবং মাতা মুদ্রিত নয়নে (সন্তোষ সহকারে) সে বাক্য শ্রবণ করেন, কিন্তু কুরকুটিল কুবিচারীরা শুনিয়া হাসে তাহারা তো পরদোষ ভূষণধারী।
(তুলসীজীর রামায়ণখানা হাতের কাছে নাই; সদাশয় সরকারের ন্যায় দুর্ভিক্ষের সময় সঞ্চিত পচা চাউল অর্থাৎ আমার ক্ষীণ স্মৃতিভাণ্ডার হইতে চৌপদীটি ছাড়িলাম– হাজরা লেনের শ্রীমতী ঘোষের সহযোগের উপর নির্ভর করিয়া)।
সহৃদয় পাঠকেরা মুদিত নেন শুনিয়া এখন মুক্তকণ্ঠে আমাকে বহুতর প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিয়াছেন।
আমি বলিয়াছিলাম–
প্রথমত বড় ও ছোট শহরের যুবক ও বালক লইয়া একটি প্রতিষ্ঠান করিতে হইবে। ইহাদের কাজ হইবে বাসি দৈনিক, সাপ্তাহিক (ও পরে) মাসিক কাগজ জড়ো করা। পরে সেগুলি ডাকযোগে প্রতি পাঠশালায় পাঠানো। যেসব ছেলেরা পাঠশালা পাস করিয়াছে, বিশেষ করিয়া তাহাদের নিজের নামে দৈনিক ও সাপ্তাহিক পাঠাইতে হইবে। ইহাতে ডাক-খরচা লাগিবে। উপস্থিত সে পয়সা তুলিতে হইবে কিন্তু আমার বিশ্বাস, অন্ধেরা যেরকম বিনা ডাক-খরচায় পড়িবার জিনিস পান, ঠিক সেই রকমই যথারীতি আন্দোলন করিলে, ও বিশেষত যদি প্রথম দিকে পয়সা খরচ করিয়া কাগজ বিতরণ করিয়া সপ্রমাণ করা যায় যে, পরিকল্পনাটি বিশেষ প্রাথমিক কেন্দ্রে সফল হইয়াছে– ডাক-খরচাও লাগিবে না।
দ্বিতীয়ত, পাঠশালার শেষ শ্রেণিতে ছেলেদিগকে পত্রিকা পাঠ শিখাইতে হইবে। গোড়ার দিকে শিক্ষক তাহাদিগকে বিশেষ করিয়া ছেলেদের জন্য যেসব লেখা বাহির হয় (আনন্দমেলা জাতীয়) তাহা পড়াইবেন। পরে নানারকম দেশি খবর ইত্যাদি ইত্যাদি।
খবরের কাগজের মাধুকরী করা ও তৎপর বণ্টনকর্ম সম্বন্ধে সবিস্তার আলোচনা কেহ কেহ চাহিয়াছেন।
প্রথমেই নিবেদন করি যে, এইপ্রকার সম্পূর্ণ নবীন প্রচেষ্টা আরম্ভ করিবার পূর্বে আটঘাট বাঁধিয়া ফুলগুফে কোনও স্কিম বা প্ল্যান করা ঠিক হইবে না। শহর ও গ্রামের বাতাবরণ বিভিন্ন, কাজেই একই প্ল্যান দুই জায়গায় বলবৎ হইবে না। দ্বিতীয়ত, প্রথম প্রচেষ্টা ডিনেমিক, চলিষ্ণু বা প্রাণবন্ত হইবে অর্থাৎ কাজ করিতে করিতে ভুলত্রুটি সংশোধন করিয়া, অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করিয়া, উনিশ-বিশ ফেরফার করিয়া অগ্রসর হইতে হইবে। সহৃদয় পাঠক যদি কিছু মনে না করেন, তবে বলি যে, আমাদের দেশে সর্বপ্রচেষ্টায় আমরা বিলাতি ফিটফাট তৈয়ারি মডেল খুঁজিয়া তাহার অনুকরণ চেষ্টা করি। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়, আমাদের ট্রেন-জাহাজ, আমাদের রাজনৈতিক আন্দোলন, আমাদের নৃত্যগীতের পুনরুজ্জীবন-প্রচেষ্টা ইস্তেক জাতীয় সঙ্গীত শুনিবার সময় দণ্ডায়মান হওয়া সর্বত্রই অনুকরণ-প্রচেষ্টা, মডেল খোঁজা-বাতাবরণের সঙ্গে মিলাইয়া দেশের অভাব-অভিযোগ সম্বন্ধে সচেতন থাকিয়া চলিষ্ণ ক্রমবর্ধমান শিশু-প্রচেষ্টাকে বলিষ্ণু করিতে শিখি না। আমাকে দোষ দিবেন না। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলি অক্সফোর্ড-কেম্ব্রিজের কীরকম অন্ধানুকরণ করে তাহা দৰ্শাইয়া স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ এই মর্মে অনেকগুলি মর্মন্তুদ সত্য বলিয়াছিলেন।
আমার মনে হয়, উপযুক্ত বাক্যটি স্মরণ রাখিয়া কর্মক্ষেত্রে অবতরণ করা প্রশস্ত।