খ্যাতনামা, সুরুচিবান এবং শক্তিশালী বাঙালি লেখক কর্তৃক এই প্রথম এবং বলতে গেলে শেষ রগরগে বা সেনশনাল নভেল।
এখনও বহু লোকের বিশ্বাস রগরগে উপন্যাস লেখা অতিশয় অপকর্ম– পাঁচকড়ি দেনরাধম এবং দীনেন্দ্রকুমার রায় কুলোক। আমি এ দলে নেই কিন্তু সে আলোচনা আরেক দিন হবে।
কোনান ডয়েল সত্যকার পণ্ডিত লোক ছিলেন এবং তাঁর একটি অসাধারণ গুণের কথা বহু লোকের অজানা যে তিনি ইংলন্ডের মৃত কি জীবিত যে কোনও সাহিত্যাচার্যের রচনাভঙ্গি, শৈলী এবং ভাষা অনায়াসে অনুকরণ করতে পারতেন। এডগার ওয়ালেসও সুসাহিত্যিক ছিলেন– ইংলন্ডের যে কোনও সাহিত্যসভা তাঁর আশীর্বাদ কিংবা উপস্থিতি পেলে কৃতাৰ্থৰ্মন্য হতেন।
সাহিত্যে রগরগে উপন্যাসেরও বিশেষ স্থান আছে। তবে একথা ভুললে চলবে না, শুষ্ক ইতিহাসকে সরস, সজীব, সার্থক সাহিত্য করতে হলে যে রকম সুসাহিত্যিকের প্রয়োজন, রগরগে উপন্যাসের বেলাতেও তাই। গুপ্তধন রবীন্দ্রনাথ ছাড়া কেউ লিখতে পারতেন না, গোস্ট অব ক্যান্টারভিল লেখা অস্কার ওয়াইলডেই সম্ভবে।
প্রভাত মুখুয্যে যখন রত্নদীপ লেখেন তখন তিনি খ্যাতনামা লেখক। শুধু যে তিনি তখন রবীন্দ্রনাথ, চারু বন্দ্যোপাধ্যায়, মণি গাঙ্গুলী, সত্যেন দত্তের শ্রদ্ধা এবং সাহচর্য পেয়েছিলেন তা-ই নয়, ঋষিকল্প দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর পর্যন্ত তাঁর একটি গল্প পড়ে মুগ্ধ হয়ে আপন দর্শন-দ্বিরদ-দ-স্তম্ভ থেকে নেমে এসে সেই গল্প নিয়ে একটি চমৎকার আলোচনা করেন। সে আলোচনা পড়লে বাঙালি এখনও উপকৃত হবে।
সেই প্রভাত মুখোপাধ্যায় সুসাহিত্যিক-খ্যাতির শিখরে বসে লিখলেন, রত্নদীপ— রগরগে উপন্যাস!
কিন্তু হলে কী হয়–উপন্যাসখানা পড়বার সময় ক্ষণে ক্ষণে সর্বাঙ্গে রোমাঞ্চ এবং শিহরণ হলেও পরিষ্কার ধরা পড়ে মুখোপাধ্যায়ের আসল কৃতিত্ব কোথায়? প্রবঞ্চক যেদিন বউরাণীকে। ভালোবেসে এক নতুন মানুষ হয়ে জন্ম নিল, তখন তার নবজন্মের কাহিনী, তার ভিতরকার ন্যায়-অন্যায়ের দ্বন্দ্ব এবং সর্বশেষে তার নির্ভয়, পরিপূর্ণ স্বার্থত্যাগ-আত্মবিসর্জন প্রভাত মুখোপাধ্যায় বিশ্লেষণ এবং বর্ণন করেছেন এদেশে মনস্তাত্ত্বিক নভেল প্রচলিত হওয়ার বহু পূর্বেশক্তিশালী সাহিত্যিকের জোরদার কলম দিয়ে। আমার মনে হয় সে যুগে রবীন্দ্রনাথ ছাড়া কেউ ওরকম অপরের হৃদয়মনের গভীর অতলে ঢুকে এরকম রত্নদীপ তুলে আনতে পারতেন না।
তাই রত্নদীপ নিছক রগরগে উপন্যাস নয় (তা হলেও আমার মত অনেকের ব্যক্তিগত বা সমষ্টিগত আপত্তি নেই), রত্নদীপ সুসাহিত্য।
***
সেই রত্নদীপ তার আলো-ছায়া ফেলেছে দেহলি-প্রান্তের রুপালি পর্দায়। তবে সে দীপ হিন্দি ভাষার ঘিউ দিয়ে জ্বালানো– হেথাকার বাঙালির এই যা আফসোস।
বয়স হয়েছে; বায়স্কোপ– সিনেমা-মুভি-পিকচার-টকি কথাগুলো এখনও রপ্ত হল না– যেতে দেখলে নাতি-নাতনিরা হাসাহাসি করবে তাই যেতে হয় গা-ঢাকা দিয়ে টাপে-টোপে। দিল্লিতে আমাকে অন্য কেউ বড় একটা চেনে না– অখ্যাত হওয়ার এই একটা মস্ত সুবিধে।
গিয়ে ভালোই করেছিলুম। ছবিখানা অত্যুত্তম না হলেও উত্তম হয়েছে। বেশিরভাগ ছবি আজকাল এতই খারাপ যে, বায়স্কোপে বসে অনেক জোয়ানরাই ঘুমোয় প্রাপ্তবয়স্কদের তো কথাই নেই; এ ছবি ঘুমের দাওয়াইরূপে সেবন করা যায় না। বেশ খাড়া হয়ে বসে দেখতে হয়।
আর ছবির নায়ক অভিনয়ে পাউল মনির পর্যায়ে উঠেছেন– অবশ্য শেষ পর্যন্ত তিনি মুনির মতো বিভিন্ন চরিত্রে একই কৃতিত্ব দেখাতে পারবেন কি না, সে কথা এখনও বলা যায় না বলেই আমার মনে হল। জমিদারবাড়িতে ঢোকার পর নায়ক সবসুদ্ধ হয়তো এক ডজন কথাও বলেছেন কি না সন্দেহ, অথচ এই কথা না-বলার টেকনিকেই তাঁর অভিনয় চরম খোলতাই পেয়েছে। সিনেমা-মৌতাতিরা এ লোকটির ওপর নজর রাখবেন।
বউরাণীও ভালো অভিনয় করেছেন, তবে মাঝে মাঝে মনে হয়েছে তার বস্তৃতান্ত্রিক অভিনয়ে যতখানি দখল, ব্যঞ্জনার ভিতরে গোপন থেকেও আত্মপ্রকাশ করার পদ্ধতি তিনি ততটা ভালো করে আয়ত্ত করতে পারেননি। সেদিক দিয়ে তার সহচরী সুচতুরা। তবে একথাও বলব, বউরাণী দর্শকের চিত্তজয় করতে সমর্থ হয়েছেন।
যতদূর মনে পড়ছে, মূল পুস্তকে বউরাণী লাজুক এবং অতিশয় স্বল্পভাষী। নায়ক কথা বলে না, নায়িকাও স্বল্পভাষী। উপন্যাসে এ জিনিস চলে, ফিলমে চালানো মুশকিল সায়লেন্ট ফিমে এই একটা মস্ত সুবিধে ছিল– তাই বোধহয় বউরাণীকে কিঞ্চিৎ এগ্রেসিভ করে গড়া হয়েছে।
আমার ভালো লাগেনি প্রধান পরিচারিকা আর জমিদার-মাতার অভিনয়। বড় বাড়াবাড়ি বলে মনে হল; তবে শুনেছি এ দেশের অধিকাংশ দর্শকই নাকি বাড়াবাড়ি (ইংরেজিতে যাকে বলে হ্যাঁম্ অ্যাকটিং) পছন্দ করেন।
আগাগোড়া নাটকেই বিস্তর ফাইন টাচেস আছে। তার জন্য প্রসার ডিরেক্টর কাকে প্রশংসা করতে হবে জানিনে। বাঙলা ছবি এ বাবদে এখন ভারতীয় অন্যান্য ছবির চেয়ে অনেক দূরে এগিয়ে আছে।
গোঁফ পরচুলা কিন্তু এখন খারাপ। ক্লোজ-আপের সময় চোখে পীড়া দেয়। শুনেছি, কোনও এক ফিলমে ক্রাইটের দাড়ি-গোঁফের প্রত্যেকটি আলাদা আলাদা করে গঁদ দিয়ে সাঁটা হয়েছিল– অতখানি না করেও দাড়িগোঁফ আরও অনেক স্বাভাবিক করা যায়।
কিন্তু এসব খুঁটিনাটি। রবিবাবু বলেছেন,