.
০২.
বিপদ এই যে, চতুর্দিক হইতে রাশি রাশি খবর রোজ খবরের কাগজের অফিসে উপস্থিত হইতেছে, অথচ কাগজের অনটন। অর্থাৎ খবর আছে, কাগজ নাই। কাজেই খবর-কাগজ সমাসটি সিদ্ধ হয় কী প্রকারে? এদিকে আবার দেশহিতৈষীরা নিরক্ষরতা দূর করিবার অন্যান্য উপায় জানিতে চাহিতেছেন। বিষয়টি গভীর-আলোচনার দিক দিয়া দেখিতে গেলে ত্রৈমাসিকের উপযুক্ত; অথচ খবরের কাগজের ভিতর দিয়া হাজার হাজার লোককে সমস্যাটি না জানাইলে প্রতিকারের সম্ভাবনাও নাই।
পণ্ডিতেরা একবাক্যে স্বীকার করিয়াছেন যে, চীন যে জনসাধারণের শিক্ষা-প্রসার ব্যাপারে এত পশ্চাৎপদ তাহার প্রধান কারণ চীনভাষার কাঠিন্য। সে ভাষার বর্ণমালা নাই। প্রত্যেকটি শব্দ একটি বর্ণ। শব্দটি যদি না জানা থাকে তবে উচ্চারণ পর্যন্ত করিবার উপায় নাই; কারণ উচ্চারণ তো করি বর্ণে বর্ণ জুড়িয়া। প্রত্যেকটি শব্দই যখন বর্ণ তখন হাজার হাজার বর্ণনা শিখিয়া চীনা পড়িবার বা লিখিবার উপায় নাই। ৪৭টি স্বরব্যঞ্জন শিখিতে ও শিখাইতে গিয়া আমরা হিমসিম খাইয়া যাই। চীনা সাক্ষররা কী করিয়া হাজার হাজার ও পণ্ডিতেরা কী করিয়া লক্ষ লক্ষ বর্ণ শিখেন সে এক সমস্যার বিষয়। শুনিয়াছি চৌদ্দ বছরের বাঙালি ছেলে যে পরিমাণ বাঙলা জানে ততটুকু চীনা শিখিতে গিয়া নাকি সাধারণ চৈনিকের বয়স ত্রিশে গিয়া দাঁড়ায়। শুধু একটি কথা নিশ্চয়তার সঙ্গে উল্লেখ করিতে পারি। পুনা ফার্গুসন কলেজের অধ্যাপক শ্ৰীযুত বাসুদেব গোখলে (বিখ্যাত গোখলের আত্মীয়) শান্তিনিকেতনে ১৯২৪ সালে চীনা শিখিতে আরম্ভ করেন; পরে জর্মনিতে ডক্টরেট পান। ভদ্রলোক এখনও চীনা ভাষার অক্টোপাস-পাস হইতে বাহির হইতে পারেন নাই। ইতোমধ্যে তাহার সতীর্থরা ফরাসি, জর্মন, ইতালিয়ন নানা ভাষা শিখিয়া বসিয়াছেন। শ্ৰীযুত গোখলের পাণ্ডিত্যে সন্দেহ করিবার কারণ অবশ্য নাই; চীনা ছাত্র এদেশে আসিয়া তাহাকে গুরু স্বীকার করিয়া তাহার নিকট চীনা বৌদ্ধশাস্ত্র পালিশাস্ত্রের সঙ্গে মিশাইয়া পড়িতে শিখে।
সকলেই একবাক্যে স্বীকার করিয়াছেন যে, নতুন বর্ণমালা না চালাইলে চীনের জনসাধারণ কখনও সাক্ষর হইতে পারিবে না। জাপানিদের বর্ণমালা আছে।
বাঙলা বর্ণমালা সংস্কৃত নিয়মে চলে বলিয়া তাহার শ্রেণিবিভাগ সরল ও যুক্তিযুক্ত। ইংরেজি ও অন্যান্য সেমিটিক বর্ণমালার সঙ্গে তুলনা করিলে তথ্যটি স্পষ্ট হইবে। কিন্তু, এইখানেই সমস্যার জগদ্দল কিন্তু উপস্থিত লেখা ও পড়ার সময় বাঙলা বর্ণমালা যে কী অপূর্ব কাঠিন্য সৃষ্টি করে তাহা আমরা ভাবিয়াও দেখি না। দুইটি ইকার কেন, দুইটি উকার কেন উচ্চারণে যখন কোনও প্রভেদ নাই তখন মনে রাখি কী করিয়া, কই যখন লেখা যায় তখন কৈর কী প্রয়োজন? বউ যখন লেখা যায় তখন বৌকে বরণ করিবার কী দরকার? গিআ, গিএর পরিবর্তে কেন গিয়া গিয়ে? এইসব প্রশ্ন শিশুমনকে বিক্ষুব্ধ করে ও সে সমস্ত ব্যাপারটার কোনও হদিস পায় না। কারণ সংস্কৃতে তার হদিস আছে, বাঙলা লিখন-পঠনে নাই। দ্বিতীয়ত অযৌক্তিকতা; কা লিখিতে আকার জুড়ি পশ্চাতে, কিন্তু ইকার জুড়ি অগ্রভাগে, আর ঈকার জুড়ি পশ্চাতে, দুটি উকার জুড়ি নিচে। সর্বাপেক্ষা মারাত্মক ওকার ও ঔকার। প্রথম? লাগাই, তার পর লাগই । ছোট ছেলেকে নিশ্চয়ই পড়িতে শুনিয়াছেন ঘ একারে ঘে; উঁহু ঘ আকারে আ, উঁহু ঘে? ঘা? তখন তাহার মনে পড়ে ওকারের কথা; বলে ঘো ঘোড়া। ঔকার তো আরও চমৎকার। আকার ইকার উ-কার, ঋকার সব কয়টি হয় আগে, নয় পশ্চাতে লাগাইলে যে কী আপত্তি ছিল, তাহা আমি বহু গবেষণা করিয়াও স্থির করিতে পারি নাই। শিশুর পক্ষে সরল হইত, বয়স্ককে পুনর্নিরক্ষরতা হইতে রক্ষা করিত। ইংরেজিতে ব্যাপারটা কানুনমাফিক ও সরল।
তবুও শিশুরা সাধারণত সামলাইয়া লয়, কিন্তু যুক্তাক্ষরে আসিয়া তাহাদের বানচাল হয়।
আমার সব-ইনসপেকটর বন্ধুটি বলিয়াছেন যে, অনুসন্ধান করিলে দেখা যায় কৈবর্ত জেলের ছেলে বেশিরভাগ পাঠশালা পালায় যুক্তাক্ষরের যুগে, দ্বিতীয় ভাগ পড়িবার সময়। যুক্তাক্ষর হইয়াছিল সংস্কৃত বানানের অনুসরণে। নিয়ম এই, কোনও ব্যঞ্জন যদি একা দাঁড়ায় তবে ধরিয়া লইতে হইবে তাহার সঙ্গে অ স্বর যুক্ত আছে। তাহা কর-ভতে তিনটি অ যোগ দিয়া পড়ি। কিন্তু যদি কোনও ব্যঞ্জন স্বরের সাহায্য ছাড়া দাঁড়াইতে চাহে, তবে তাহাকে পরের ব্যঞ্জনের সঙ্গে জুড়িয়া দিতে হইবে– অন্যথায় পূর্ব নিয়মানুসারে অকার লাগিয়া যাইবে। তাই সন্তপ্ত বলিতে তাহার ন আধা অর্থাৎ হসন্ত, প আধা অর্থাৎ হসন্ত। উত্তম প্রস্তাব, কিন্তু বিপদ এই যে, যুক্তাক্ষর হওয়া মাত্রই অনেকেই এমন। চেহারা বদলায় যে, তাহাদিগকে চিনে তখন কার সাধ্য– লাইনো টাইপের অর্থাৎ আনন্দবাজারের ছাপার কথা হইতেছে না, প্রচলিত ছাপা ও লেখার কথাই বলিতেছি। দ্বিতীয় বিপদ, এই আইন সংস্কৃতে অতি প্রাঞ্জলভাবে চলে বটে, বাঙলায় চলে না। লিখিতেছি রামকে অর্থাৎ রা+ম+অ+কে অর্থাৎ রামোকে (কারণ ব্যঞ্জন একা দাঁড়াইলে অ বর্ণ যুক্ত হইবে– অ ছাপায় আলাদা বুঝাইবার উপায় নাই বলিয়া ওকার ব্যবহার। করিয়াছি), অথচ পড়িতেছি এমনভাবে যে ম ও ক যুক্তাক্ষরে লেখা উচিত; যথা রামুকে। সরব নার যে উচ্চারণ করি তাহাতে তো লেখা উচিত সর্ব না; যাক সের যে উচ্চারণ করি তাহাতে লেখা উচিত যাক্ষে অথবা যাক্সে। কখন জাগলি-কখন জাগ্নি; কাঁপলেই=কপ্লেই ইত্যাদি ইত্যাদি।