সমস্যার জটিল গ্রন্থি এই যে যদিও প্রতি বৎসর বহু বালক পাঠশালা-পাস করিয়া বাহির হয়, অর্থাৎ সাক্ষর হইয়া সামান্য লেখা-পড়া করিতে শিখে, তবুও কয়েক বৎসর পরেই দেখা যায় যে, ইহারা সম্পূর্ণ নিরক্ষর হইয়া গিয়াছে। কারণ অনুসন্ধান করিলে দেখা যায় যে, পাঠশালা-পাসের পর পড়িবার মতো কোনওই পুস্তক তাহারা পায় না। আমার এক স্কুল সাব ইন্সপেক্টর বন্ধুর মুখে শুনিয়াছি যে কৈবর্ত, নমঃশুদ্র ও মুসলমান জেলেদের ছেলেরা যত শীঘ্র পুনরায় নিরক্ষর হয়, অপেক্ষাকৃত দ্ৰশ্রেণিতে ততটা নয়। তাহার মতে কারণ বোধহয় এই যে, তথাকথিত নিম্নশ্রেণির হিন্দুর বাড়িতে রামায়ণ-মহাভারতের প্রচলন কম ও মুসলমানদের জন্য বাঙলায় সরল কোনও ধর্মপুস্তক নাই।
মধ্য ইউরোপের তুলনায় বল্কান শিক্ষায় পশ্চাৎপদ। বন্ধানের গ্রামাঞ্চলে অনুসন্ধান করিয়া আমিও ঠিক এই তত্ত্বই আবিষ্কার করি। বন্ধানের গ্রামাঞ্চলে মেয়েদের লেখাপড়ার সঙ্গে যোগ তাহাদের উপাসনা পুস্তিকার মধ্যবর্তিকায়। পাঠকের অবগতির জন্য নিবেদন করি যে, ক্যাথলিক ক্রিশ্চানরা শাস্ত্রাধিকারে বিশ্বাস করেন। গ্রামের পাদ্রি সাহেবের অনুমতি বিনা যে কেহ বাইবেল পড়িতে পারে না, তাহাদের জন্য বরাদ্দ উপাসনা পুস্তিকা বা প্রেয়ার বুক, যেমন শূদ্র স্ত্রীলোককে বেদাভ্যাস করিতে আমাদের দেশেও নিষেধ ছিল। তাহাদের জন্য রামায়ণ, মহাভারত, ভাগবত, চৈতন্যচরিতামৃত পদাবলি।
প্রত্যেক ক্যাথলিকের একখানা উপাসনা পুস্তিকা অতি অবশ্য থাকে। গ্রামের বুড়ি উপন্যাস পড়ে না, খবরের কাগজ পড়ে না, এমনকি চিঠিপত্র লিখিবার প্রয়োজনও তাহার হয় না। কিন্তু প্রতিদিন সে উপাসনা পুস্তিকা হইতে কিছু না কিছু পড়ে ও রোববারে গির্জায় বেশ খানিকটা অধ্যয়ন করে।
প্রোটেসট্যান্ট দেশগুলোতে বাইবেল পড়া হয়। এই উপাসনা পুস্তিকা ও বাইবেল ইউরোপের কোটি কোটি লোককে পুনরায় নিরক্ষর হইবার পথে জোড়াকাটা।
আমাদের উচিত রামায়ণ-মহাভারতের আরও সস্তা সংস্করণ প্রকাশ করা ও সম্ভব হইলে পাঠশালা পাস-করার সঙ্গে তথাকথিত নিম্নশ্রেণির প্রত্যেক বালককে একখণ্ড রামায়ণ অথবা মহাভারত বিনামূল্যে দেওয়া। আমি কৃত্তিবাসের রামায়ণ ও কাশীরামের মহাভারতের প্রতিই ইঙ্গিত করিতেছি।
কিন্তু প্রশ্ন, তাহাতে লাভ কী? ধর্মচর্চা (?) তো আমরা বিস্তর করিয়াছি, আর না হয় নাই করিলাম। তবে কি দেশের লোককে নিরক্ষরতা হইতে আটকাইবার অন্য কোনও উপায় নাই, অথবা ধর্মপুস্তকের উপর আরও কিছু দেওয়া যায় না।
যায়। এবং সেই উদ্দেশ্যেই খবরের কাগজের শরণাপন্ন হইয়াছি। এই খবরের কাগজই তাহার উপায়।
রামায়ণ-মহাভারত সস্তায় অথবা বিনামূল্যে বিতরণ করিবার মতো অর্থ কোনও গৌরী সেনই দিতে রাজি হইবেন না। কিন্তু তিন দিনের বাসি খবরের কাগজ বিলাইয়া দিতে অনেকেই সম্মত হইবেন। আমাদের কল্পনাটি এইরূপ–প্রথমত বড় ও ছোট শহরে যুবক ও বালক লইয়া একটি প্রতিষ্ঠান করিতে হইবে। ইহাদের কাজ হইবে বাসি দৈনিক সাপ্তাহিক (ও পরে মাসিক) কাগজ জড়ো করা। পরে সেগুলি ডাকযোগে প্রতি পাঠশালায় পাঠানো। যেসব ছেলেরা পাঠশালা-পাস করিয়াছে, বিশেষ তাহাদেরই নিজের নামে দৈনিক ও সাপ্তাহিক পাঠাইতে হইবে। ইহাতে ডাকখরচা লাগিবে। উপস্থিত সে পয়সা তুলিতে হইবে, কিন্তু আমার বিশ্বাস অন্ধরা যেরকম বিনা ডাকখরচায় পড়িবার জিনিস পান, ঠিক সেইরকম যথারীতি আন্দোলন করিলে ও বিশেষত যদি প্রথম দিকে পয়সা খরচ করিয়া কাগজ বিতরণ করিয়া সপ্রমাণ করা যায় যে, পরিকল্পনা বিশেষ প্রাথমিক কেন্দ্রে সফল হইয়াছে, তাহা হইলে ডাকখরচও লাগিবে না।
রোজই যে কাগজ পাঠাইতে হইবে, এমন কোনও কথা নাই। প্রথম দিকে সপ্তাহে একবার অথবা দুইবার পাঠাইলেই চলিবে।
কিন্তু সংবাদপত্র ইহারা পড়িবে কি? এইখানেই আসল মুশকিল। কাজেই দ্বিতীয়ত, পাঠশালার শেষ শ্রেণিতে ছেলেদের পত্রিকা পাঠ শিখাইতে হইবে। গোড়ার দিকে শিক্ষক তাহাদিগকে বিশেষ করিয়া ছেলেদের জন্য যেসব লেখা বাহির হয়, তাহা পড়াইবেন। পরে নানারকম দেশি খবর, খেলার বর্ণনা, জিনিসপত্রের বাজার দর, আইন-আদালতের চাঞ্চল্যকর মামলা, সাহিত্যিক প্রবন্ধ, যুদ্ধের খবর, সম্পাদকীয় আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি ইত্যাদি ইত্যাদি।
যাহারা নৈশ স্কুল চালান প্রথম দিকে তাঁহারা এই প্রচেষ্টা করিলে ভালো হয়। পরে
তৃতীয়ত, গুরু ট্রেনিং স্কুলে শিক্ষকদের শিখাইতে হইবে কী করিয়া খবরের কাগজ পড়িতে ও পড়াইতে হয়। ইহার জন্যও আন্দোলনের প্রয়োজন হইবে।
আমি অতি সংক্ষেপে খসড়াটি নিবেদন করিলাম। আমার বিশ্বাস, খবরের কাগজ পড়িবার শখ সৃষ্টি করা কঠিন কাজ নহে। আর কিছুটা সুখ পাইলেই বালক সপ্তাহে দুইবার দুইখানা কাগজ স্বনামে পাইবার গর্বে নিশ্চয় পড়িবে।
আমাদের সবচেয়ে বড় লাভ হইবে যে, গণআন্দোলনের জন্য আমরা গ্রামবাসীকে প্রস্তুত করিতে পারিব।
পরিকল্পনাটির স্বপক্ষে বিপক্ষে নানা যুক্তিতর্ক আমরা অনেকদিন যাবৎ ভাবিয়াছি ও আমি নিজে বাড়ির চাকরদের কাগজ পড়িতে শিখাইবার চেষ্টা করিয়া সফল হইয়াছি। পাঠকবর্গ এ সম্বন্ধে অনুসন্ধিৎসা প্রকাশ করিলে পরিকল্পনাটি আরও বিস্তৃতভাবে আলোচনা করিতে পারিব।