উত্তর ভারতে এই সাধনার দ্বারা পূর্ব ভারতে প্রকাশ হয় আউল, বাউল, মুর্শিদিয়া, সাঁই, জারিগানের ভিতর দিয়া। সেসব গীতের সঙ্কলন এযাবৎ পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে করা হয় নাই। দুইজন গুণী এই কর্মে লিপ্ত আছেন ও রসিকজনের সশ্রদ্ধ কৃতজ্ঞতা সঞ্চয় করিয়াছেন। রাজশাহী কলেজের অধ্যাপক মৌলবি মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন ও শ্রীহট্টের মৌলবি আশরাফ হোসেন বহু পরিশ্রম করিয়া নানা সঙ্কলন প্রকাশ করিয়াছেন। (এই মহান ব্রতে আত্মনিয়োগ করিয়া দ্বিতীয়োক্ত মহাশয় কয়েক মাস পূর্বে আসাম সরকারের নিকট হইতে যে কী উকট প্রতিদান পাইয়াছেন সে সম্বন্ধে আরেকদিন আলোচনা করিবার বাসনা রহিল)।
লালন ফকির, শীতালং শাহ, রাধারমণ, গোলাম হুসেন শাহ, হাসন রাজা, ভেলা শাহ, সৈয়দ জহরুল হোসেন, সৈয়দ শাহ নূর প্রভৃতি সাধক-মণ্ডলীর পরিচয় এইসব সঙ্কলনে পাওয়া যায়। আধ্যাত্মিক জগতে হঁহাদের অধিকার, দৈনন্দিন জীবনের নিম্নতম কঠিন কঠোর অভিজ্ঞতা হইতে আত্মার উচ্চতম রহস্যলোকের প্রতি ঘঁহাদের অভিযান যে কী পরম বিস্ময়জনক, লোমহর্ষক তাহা বর্ণনা করিবার মতো অভিজ্ঞতা তো আমার নাই। গ্রহচন্দ্রে, তারায় তারায় অনন্তের যে সুগম্ভীর বীণাধ্বনি প্লাবন মন্ত্রে মুখরিত, রুদ্রের ত্রিকাল ত্রিকোলস্পর্শী দক্ষিণ হস্তে যে রুদ্রাক্ষ জন্মমৃত্যু সৃষ্টিপ্রলয়ের অন্তহীন চক্রে ঘূর্ণায়মান তাহারই স্পন্দন নমস্য সাধকেরা অনাবিল চৈতন্যগোষ্পদে শতরাগে বিম্বিত করিয়া প্রত্যক্ষ দর্শন করিয়াছেন। পুনরাবৃত্তি করি, প্রত্যক্ষ দর্শন করিয়াছেন, উপনিষদের ঋষি যে প্রকারে দর্শন করিয়াছিলেন, মুতালিজা সুফি পঞ্চেন্দ্রিয়ের অতীত যে ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় যোগে পরমাত্মাকে দর্শন করিয়াছিলেন।
সে রহস্যলোকের ব্যঞ্জনা সাধকেরা দিয়াছেন মধুর কণ্ঠে, ছন্দগানে। রসিকজন শ্রবণমাত্র ভাবরসে আপ্লুত হইয়াছেন। নীরস গদ্যে অরসিকজন তাহার ব্যাখ্যা করিতে গিয়া কেন। বিড়ম্বিত হইবে?
আমাদের পক্ষে শুধু সম্ভব সাধকগণের রসস্রোতধারার ভৌগোলিক উৎপত্তিস্থলের অনুসন্ধান করা। কোন পর্বত-কন্দরে তাহার উৎপত্তি, কোন দেশে প্রদেশের উপর দিয়া তাহার গতি, কোন মহাসমুদ্রে তাহার নিবৃত্তি সে অনুসন্ধান ভূগোল আলোচনার ন্যায়; তাহাতে জ্ঞানবৃদ্ধি হয়, রসাস্বাদনের প্রত্যক্ষ আনন্দ তাহাতে হয় না। গঙ্গার উৎপত্তি-নিলয় জানিয়া তাপিত দেহে গঙ্গাবগাহনজনিত স্নেহসিক্ত শান্তিলাভ হয় না, পুণ্যলাভ তো সুদূরপরাহত।
রসিকজন এই অন্ধের হস্তীদর্শনের ন্যায় বিড়ম্বনাকে লক্ষ করিয়াই বলিয়াছেন,
ফুলের বনে কে ঢুকেছে সোনার জহুরি
নিকষে ঘষয়ে কমল, আ মরি, আ মরি।
স্মৃতিশক্তি ক্ষীণ হইয়া গিয়াছে, তৎসত্ত্বেও মনে পড়িতেছে, পরমহংসদেবও বলিয়াছেন, মদ শুকিলেই নেশা হয় না, চাখিলে নেশা হয় না, এমনকি সর্বাঙ্গে মাখিলেও নেশা হয় না, নেশা করিতে হইলে মদ খাইতে হয়। অর্থাৎ সে রসসায়রে নিমজ্জিত হইতে হয়, পারে দাঁড়াইয়া সে অমৃতের রাসায়নিক বিশ্লেষণ করা পণ্ডিতের পণ্ডশ্রম। তাই বাউল বলিয়াছেন,
যে জন ডুবল, সখী, তার কী আছে বাকি গো?
তখন তো তাহার আর দুঃখ-যন্ত্রণা নাই, সে তো জন্ম-মৃত্যুর অতীত। রাজসিক কবি শ্রীমধুসূদন পর্যন্ত বলিয়াছেন :
মক্ষিকাও গলে না গো সে অমৃত হ্রদে
সৈয়দ শাহনূর গাহিয়াছেন :
রসিক দেখে প্রেম করিয়া যার দিলেতে ফানা,
অরসিকে প্রেম করিলে চোখ থাকিতে কানা।
ওজুদে মজুদ করি লীলার কারখানা,
সৈয়দ শাহনূর কইন দেখলে তনু ফানা ॥
যিনি ব্রহ্মানন্দে আত্মনিলয় (ফানা) করিতে সমর্থ হইয়াছেন, একমাত্র সে-ই রসিকের সঙ্গে প্রেম করিবে। তদভাবে তুমি চক্ষুষ্মন অন্ধ। এই দেহেই (ওজুদ) লীলার কারখানা মজুত। তাহা যদি দেখিতে পারো তবেই তুমি দেহের বন্ধন হইতে মুক্তিলাভ (ফানা) করিবে।
(শব্দতাত্ত্বিক লক্ষ করিবেন ভাষার দিক দিয়াও এই চৌপদী রুবাইয়াৎটি হিন্দু-মুসলিম আধ্যাত্মিক সাধনার কী অপূর্ব সংমিশ্রণে গঠিত– রসিক, প্রেম, লীলা শুদ্ধ সংস্কৃত, চোখ কানা বাঙলা; ফানা ওজুদ মজুদ শুদ্ধ আরবি; কারখানা ফারসি কইন বাঙাল।)
অরসিক, অপ্রেমিককে এইসব সাধক কখনও করজোড়ে নিবেদন করিয়াছেন যেন ভৌগোলিক শব্দতাত্ত্বিক তর্কবিতর্ক করিয়া রসভঙ্গ না করেন, কখনও নিরুপায় হইয়া কাতরকণ্ঠে দিব্যিদিলাসা দিয়াছেন। তাই ক্ষমাভিক্ষা করিয়া অদ্যকার সভার রসভঙ্গ করি, কবিগুরু কৰ্তক নন্দিত সেই হাসন রাজার গীতি সংকলন হাসন-উদাসের সর্বপ্রথম গীতিটি উদ্ধৃত করিয়া এবং তৎপূর্বে এইমাত্র নিবেদন করি যে, সাধারণত বাউলরা পরমাত্মা মহাপুরুষ ও গুরুর বন্দনা সমাপ্ত করিয়া রস সৃষ্টি আরম্ভ করেন। কিন্তু হাসন রাজা অপ্রেমিক, রবাহুতের আগমন ভয়ে আল্লা-রসুল বন্দনার পূর্বেই বলিতেছেন,
আমি করিয়ে মানা, অপ্রেমিকে গান আমার শুনবে না।
কিরা দেই, কসম দেই, আমার বই হাতে নিবে না।
বারে বারে করি মানা বই আমার পড়বে না।
প্রেমের প্রেমিক যে জনা এ সংসারে হবে না।
অপ্রেমিকে গান শুনলে কিছুমাত্র বুঝবে না।
কানার হাতে সোনা দিলে লাল-ধলা চিনবে না।
হাসনরাজায় কসম দেয়, আর দেয় মানা।
আমার গান শুনবে না, যার প্রেম নাই জানা ॥
.
সাক্ষরকে নিরক্ষরতা হইতে রক্ষা করিবার পন্থা
০১.
জনসাধারণের শিক্ষাবিস্তার সমস্যা লইয়া যাহারা তথ্য সংগ্রহ করেন তাঁহাদের মুখে শুনিয়াছি যে, উনবিংশ শতকের প্রথম ভাগে ভারতবর্ষে শতকরা দশজন লিখিতে পড়িতে পারিত ও আজ নাকি দশের পরিবর্তে বারোয় দাঁড়াইয়াছে। স্পষ্টই বোঝা যাইতেছে, শিক্ষাবিস্তারের কর্মটি সদাশয় সরকার সুচারুরূপে সম্পন্ন করেন নাই। কিন্তু এ বিষয়ে আমাদের কর্তব্য রহিয়াছে। স্বরাজপ্রাপ্তি আমরা যেমন সদাশয় সরকারের হাতে সম্পূর্ণ ছাড়িয়া দেই নাই, ঠিক সেইরূপে শিক্ষাবিস্তার সমস্যায় আমাদেরও ভাবিবার ও করিবার আছে। শিক্ষানবিশরাও বলেন যে, আমাদের মতো অর্ধশিক্ষিত লোকের সাহায্য পাইলেও নাকি নিরক্ষর দেশকে সাক্ষর করার পথ সুগম হইবে।