হিন্দু-মুসলমান জনসাধারণের যুগ্ম চেষ্টায় ভারতবর্ষে গত সাতশত-আটশত বত্সর ধরিয়া যে-কৃষ্টি যে-সভ্যতা নির্মিত হইয়াছে তাহা পৃথিবীর ইতিহাসে অপূর্ব। কি ধর্মে, কি ভাষা নির্মাণে, কি সাহিত্য-সৃষ্টিতে, কি সঙ্গীতে, কি নৃত্যে, কি বিলাস-সামগ্রী নির্মাণে, তৈজসপত্রে– কত বলিব? ইহারা যে প্রাণশক্তির পরিচয় দিয়াছে, দানে-গ্রহণে যে অকৃপণতা দেখাইয়াছে তাহা আবার বিশেষ জোর দিয়া বলি– সমগ্র পৃথিবীর ইতিহাসে অপূর্ব, সমগ্র জগতের কল্পনার অতীত। ভারতের হিন্দু-মুসলমান যাহা করিতে সক্ষম হইয়াছে তাহা পৃথিবীর কোনও দুই ধর্ম কস্মিনকালেও করিতে পারে নাই। এই প্রসঙ্গে ব্যক্তিগত কথা তোলা অনুচিত, কিন্তু যে-বিষয়ে অধম গত পঁচিশ বৎসর সমস্ত শক্তি নিয়োগ করিয়াছে তাহার সম্যক মূল্য বুঝিবার জন্য সে দেশে-বিদেশে সর্বত্র সর্বপ্রকার লোকসঙ্গীত ও অন্যান্য জনপদকলা আকণ্ঠ পান করিয়াছে, আকর্ণ-বিস্ফারিত চক্ষে দেখিয়াছে। সহৃদয় পাঠক ক্ষমা করিবেন, কিন্তু অধর্মের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাজনিত দৃঢ় বিশ্বাস, আমাদের দেশের লোকসঙ্গীতের কাছে ইউরোপের তথা অন্যান্য প্রাচ্যদেশের (চীনের কথা বলিতে পারি না) কোনও লোকসঙ্গীত দাঁড়াইতে পারে না, না, না।
অতএব আমাদের কর্তব্য এই আটশত বৎসরের সর্বপ্রকারের জনপদ-প্রচেষ্টা খুঁটিয়া খুঁটিয়া চিরিয়া চিরিয়া পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে অনুসন্ধান করা, লিপিবদ্ধ করা, কলের গানে রেকর্ড করা, ইতিহাস লেখা ও সর্বশেষে তাহাকে অর্থনৈতিক রাজনৈতিক দৃষ্টিবিন্দু হইতে পর্যবেক্ষণ করিয়া স্কুলে-কলেজে পড়ানো।
আবার বলিতেছি স্কুল-কলেজে পড়ানো। ভারতবর্ষের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক অর্থনৈতিক স্থপতি যদি সুপ্রতিষ্ঠিত করিতে হয় তবে ইহাই হইবে তাহার সুদৃঢ়, অচল-অটল ভিত্তি। শিখর, মিনার কে নির্মাণ করিবেন, কোন দর্শন, কোন শাস্ত্রীয় ধর্ম দিয়া– সে আলোচনা পরে হইবে।
কিন্তু যে কর্মটির প্রতি সহৃদয় পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করিলাম তাহা তো একজন, শতজন, হাজারজনের অক্লান্ত পরিশ্রমেরও বাহিরে। এত লোকসঙ্গীত, স্থপতি, চিত্র, সঙ্গীত, নৃত্য ভারতের গ্রামে গ্রামে গৃহে গৃহে সর্বত্র হজ্যোতি হইয়া মৃতপ্রায়, তাহাকে সংগ্রহ করিবার জন্য নেতৃত্ব করিবেন কে?
আমাদের পরম সৌভাগ্য, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ আমাদিগকে পথ দেখাইয়া গিয়াছেন। বিশ্বের সর্বত্র রাজাধিরাজের সম্মান পাইয়াও এই কবি লালন ফকিরকে উপেক্ষা করেন নাই, হাসন রাজার গান গাহিয়া বিদগ্ধ দার্শনিকমণ্ডলীর সম্মুখে অবতরণ করিলেন।
মম আঁখি হইতে পয়দা আসমান জমীন,
কানেতে করিল পয়দা মুসলমানি দীন
নাকে পয়দা করিয়াছে খুশবয় বদবয়
আমা হইতে সব উৎপত্তি হাসন রাজায় কয়।
(কাশীতে প্রদত্ত দার্শনিক সম্মেলনে রবীন্দ্রনাথের অভিভাষণ দ্রষ্টব্য)।
পণ্ডিত ক্ষিতিমোহন সেনের দৃষ্টি এদিকে পূর্বে আকৃষ্ট হইয়াছিল। রবীন্দ্রনাথের সহৃদয় উৎসাহে তিনি এই কর্মে আরও মনোযোগ করিলেন, বহু অমূল্য লুপ্তধন সঞ্চয় করিলেন। দেশের লোক তাহা প্রকাশের অপেক্ষায় রহিয়াছে। ভগবান তাঁহাকে দীর্ঘজীবন দান করুন।
ভারতবর্ষের লোকসংগীত লইয়া চর্চা করিতে হইলে উত্তর-ভারতীয় অনেকগুলি ভাষা উপভাষার পণ্ডিত হইতে হয় ও এইসব সঙ্গীতের পশ্চাতে যে সংস্কৃত ও ফারসিতে লিখিত ও গীত ভক্তি-সুফি-বেদান্ত-যোগবাদ রহিয়াছে তাহার সম্যক জ্ঞানের প্রয়োজন।
অধমের নাই। বাহির হইতে যেটুকু সামান্য দেখিয়াছি তাহাই নিবেদন করিবার চেষ্টা করিব। সহৃদয় পাঠককে সাবধান করিয়া দিতেছি, আলোচনা অতি অসম্পূর্ণ ও দোষত্রুটিতে কণ্টকিত থাকিবে। এবং ইতোমধ্যে অন্য কেহ যদি আলোচনাটি আরম্ভ করেন তবে অধম তাঁহাকে সশ্রদ্ধ নমস্কার নিবেদন করিয়া পরমানন্দে শ্রোতার আসনে গিয়া বসিবে।
.
০৩.
পূর্বের প্রবন্ধে সামান্য আভাস দিয়াছিলাম যে, ভারতবর্ষীয় লোকসঙ্গীতের মূল্য ও তাৎপর্য সম্যক হৃদয়ঙ্গম করিতে হইলে বেদান্ত, যোগ, ভক্তিবাদ ও সুফিতত্ত্ব সম্বন্ধে কিঞ্চিৎ জ্ঞান থাকার প্রয়োজন।
সুফিবাদ (ভক্তি, যোগ ও mysticism-এর সমন্বয়) ভারতবর্ষে আসে পারস্য হইতে ও এদেশের দর্শন ও ভক্তিরস ইহাকে পরিপুষ্ট করে। কিন্তু এ সম্বন্ধে আলোচনা করিবার পূর্বে আরেকটি বিষয়ের প্রতি পাঠকের দৃষ্টি এক মুহূর্তের জন্য আকর্ষণ করিব।
১৯১৮-র যুদ্ধে যখন ফ্রান্স ও জর্মনি ক্লান্ত, তখন পণ্ডিত-মহলে দ্বিতীয় যুদ্ধ আরম্ভ হইল। সে যুদ্ধ সুফিবাদ লইয়া। একদিকে ফ্রান্সের বিখ্যাত পণ্ডিত মাসিনা, অন্যদিকে জর্মনির তদপেক্ষা বিখ্যাত পণ্ডিত গড়ৎসিহার ও তস্য শিষ্য হতেন। মাসিনো পক্ষ বলিলেন, ইরানের সুফিবাদের উপর ভারতবর্ষীয় কোনও প্রভাব পড়ে নাই, যেটুকু পড়িয়াছে তাহা সুফিবাদ ভারতবর্ষে আসিবার পর। অন্যপক্ষ নানা প্রকার যুক্তিতর্ক দলিলদস্তাবেজ দ্বারা সপ্রমাণ করিবার চেষ্টা করিলেন যে, ভারতবর্ষে আগমনের পূর্বেই অর্থাৎ ইরানের বর্ধিষ্ণু সুফিবাদ বেদান্ত ও যোগরস পুনঃপুন পান করিয়াছে।
তর্কটি পাত্ৰাধার তৈলজাতীয় আপেক্ষিক, নিরর্থক নহে। সুফিবাদ অনুসন্ধান করিলে যদি সপ্রমাণ হয় যে, ভারতবর্ষীয় দর্শনের লাঞ্ছন তাহার উপর রহিয়াছে তাহা হইলে সঙ্গে সঙ্গে আরেকটি গম্ভীর ঐতিহাসিক তত্ত্ব সপ্রমাণ হয়, সেটি এই যে, ভারতীয় ধর্ম ও দর্শন এককালে ইরান পর্যন্ত ব্যাপকভাবে বিস্তৃত ছিল।