খোজারা অর্ধ-কচ্ছী-উপভাষা ও অর্ধ-গুজরাতিতে উপাসনা করেন– তাহাকে নামাজ বলিলে ভুল বোঝানো হইবে। রমজান মাসে খোঁজারা উপবাস করেন না। হজ করিতে মক্কায় যান না– বর্তমান ইমাম বা গুরু দর্শনে হজের পুণ্যসঞ্চয় বলিয়া বিশ্বাস করেন। গরিব দুঃখীকে জকাত বা ধৰ্মাদেশানুযায়ী ভিক্ষা দেন না, সে অর্থ গুরু দ্বারা প্রচলিত প্রতিষ্ঠানকে দেন। খোজারা পাঁচবারের পরিবর্তে তিনবার উপাসনা করেন এবং সুন্নি ও শিয়া মত হইতে তাঁহাদের ধর্মবিশ্বাসে অন্যান্য বহু অনৈক্য দৃষ্ট হয়।
খোজাদের গিনান বা ধর্মগ্রন্থগুলি পড়িলে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, অ্যাসাসিন মিশনারিরা হিন্দু এবং শিয়া মতবাদের সম্মেলনে এক নতুন ধর্ম সৃষ্টি করিয়া তাহাতে তাবৎ ভারতীয়দিগকে দীক্ষিত করিতে চেষ্টা করেন। এই দৃষ্টান্তটি বিশেষ উল্লেখ করিলাম কারণ ইহা শিয়াদের পক্ষ হইতে করা হইয়াছিল। ইহার পর ভাষা নির্মাণে কাব্য সৃষ্টিতে বিভিন্ন রসবস্তু সম্মেলনে যেসব প্রচেষ্টা হইয়াছিল তাহা অধিকাংশ সুন্নিদের দ্বারা।
গুজরাতে মতিয়া সম্প্রদায়ও বিবাহের সম্বন্ধে ব্রাহ্মণকে নিমন্ত্রণ করেন; কিন্তু মৃত্যুর পর শব কবরস্থ করিবার জন্য মোল্লার কাছে আরজি পেশ করেন। পশ্চিম উপকূলে এইরূপ নানা সংমিশ্রণের চিহ্ন সর্বত্র পাওয়া যায়।
এইসব চেষ্টার ফলেই ১৭৫০ সালে লিখিত গুজরাতের ফারসি ইতিহাস মিরাত-ই অহমদিতে দেখা যায় যে, হিন্দু-মুসলমানে সাম্প্রদায়িক কলহ তখন প্রায় শেষ হইয়া গিয়াছে। লেখক আলি মুহম্মদ খান তাহার হাজার পাতার (মুদ্রিত) পুস্তকে যে দুই একটি কলহের উদাহরণ দিয়াছেন সেগুলি তিনি সাধারণ নিয়মের ব্যত্যয় রূপেই উদ্ধৃত করিয়াছেন।
খোজাদের বর্তমান গুরু হিজ হাইনেস দি আগা খান।
.
ভাই ভাই এক ঠাঁই
০১.
বারান্তরে হিন্দু-মুসলিম শাস্ত্রীয় মিলনের ফলে উপজাত খোঁজা মতবাদের উল্লেখ করিয়াছিলাম। এক্ষণে যেস্থলে উপস্থিত হইয়াছি, তাহার সম্মুখে মিলনের সুধা-শ্যামলিমদিগ্দিগন্ত বিস্তৃত– তাহার পুণ্য পরিক্রমা আরম্ভ করিব, এমন সময় একটি অতি আধুনিক ঘটনার দিকে আমাদের চিত্ত আকৃষ্ট হইয়াছে। কালানুপূর্বের ধারাবাহিকতার প্রতি অত্যধিক নিষ্ঠা প্রদর্শন না করিয়া অসময়ে প্রসঙ্গটির অবতারণা করিব, কারণ বিষয়টি আমাদের দৃষ্টিবিন্দু হইতে অসাময়িক হইলেও অবান্তর নহে।
গত মঙ্গল-শুক্রবারে*[* ১৯৪৫ সালের নভেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহ।] যখন কলিকাতার ছাত্রসমাজ ও বহু বাঙালি-অবাঙালি স্বৈরতন্ত্রের প্রতিবাদ করিয়া আন্তরিক বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন, তখন অনেকেই হয়তো আশা করিবার সাহস রাখেন নাই যে, মুসলমানেরা, বিশেষত মুসলমান ছাত্রসমাজ ইহাতে যোগদান করিবেন। আমরা নিম্নলিখিত সম্পাদকীয় স্তম্ভটি পাঠকের গোচর করিতেছি।
A large number of Muslim students participated in the recent disorders in Calcutta. One of them lost his life, and many received injuries, serious and light. The student of the Islamia College went on strike in sym pathy with their Hindu fellow students and in protest against the firing and lathi charge by the police. The vice-president of the College Union presided over a huge meeting which passed appropriate resolutions. Large numbers of Muslims, other than students, also took part in the demonstrations. Many non-Muslims wonder why these Muslims have taken this attitude. The answer is not difficult to find. It is the Muslim way, the result of over 13 centuries of teaching expressed in the practice of the precepts laid down in the holy Quran and the traditions of the prophet Muhammad : Love your neighbours, side with him that is weak, oppressed or ill-used, serve Allah by serving his creatures; the true Muslim is represented in his two little things, his heart and his tongue.
এতদিন ধরিয়া আমরা ঠিক এই কথাটিই বলিবার চেষ্টা করিতেছিলাম। সর্বধর্মের মূলতত্ত্ব সমান, আমরা সকলে একথা স্বীকার করি; কিন্তু আচার-ব্যবহারে অশন-বসনে সেই তত্ত্বগুলি যখন প্রকাশ পায়, তখন অনেক সময় এমন বিকৃত রূপ ধারণ করিয়া পীড়াদায়ক হইয়া উঠে যে, তখন মানুষ শুধু সেই মানুষগুলির আচরণের নহে তাহাদের ধর্মের উপরও দোষারোপ করিতে থাকে। সবিস্তর নিবেদন করি :
ইংরেজরা এদেশে খ্রিস্টধর্ম আনয়ন করেন। খ্রিস্টধর্ম মৈত্রী ও ক্ষমার ধর্ম। কিন্তু দেড়শত বৎসর খ্রিস্টধর্ম প্রচারের পরও এদেশে দেখি, দিশি খ্রিস্টানের স্বতন্ত্র ধর্মালয়, শ্বেত খ্রিস্টানের স্বতন্ত্র ধর্মালয়, আহার-বিহার সামাজিক গণ্ডি স্বতন্ত্র, এমনকি মৃত্যুর পাণ্ডুহস্ত স্পর্শেও কৃষ্ণ-খ্রিস্ট ধবল হয় না; তাহার জন্য স্বতন্ত্র গোরস্তান। ইংরেজ শাসকের স্বৈরতন্ত্র মুসলমান শাসকের এখতেয়ারি অপেক্ষা সর্বাংশে অধিক, চর্মদাহে মর্মদাহে তাহা বার বার অনুভব করিয়াছি ও করিতেছি। কিন্তু তাহাদের সর্বপ্রকার সাহায্য সত্ত্বেও খ্রিস্টধর্মের ন্যায় উদার ধর্ম, এদেশে সসম্মানে বরিত ও নন্দিত হইল না। ধর্মপিপাসু মন বার বার শুধায়, ক্রটি কোনখানে? হয়তো যাহারা বাহকরূপে আসিয়াছিলেন, তাঁহারা ধর্মের সত্য সেবক ছিলেন না।