পুনর্বার ক্ষীণচেষ্টা দেখা গেল– সুভাষচন্দ্র তাহার পুস্তকে সে প্রচেষ্টার উল্লেখ করিয়াছেন কিন্তু তখন বিদেশি আসিয়াছে। সেই কথার উল্লেখ করিয়া একদিন লিখিয়াছিলাম।
তার পর? তার পর লজ্জা ঘৃণা পাপ
অপমান; প্রকাশিল অন্তহীন শাপ
হিন্দু-মুসলমান ক্ষত্রিয়েরা যখন ১৮৫৭ সালে পুনরায় সম্মিলিত হইয়া সফল হইলেন না তখন তাহাই উদ্দেশ করিয়া লিখিয়াছিলাম।
যুগ ক্ষাত্রতেজে তার পাপ প্রক্ষালন
চেষ্টা হল ব্যর্থ যবে। করিল বরণ
ভেদমন্ত্র ছিদ্রান্বেষী পরম্পরাঘাত
হইল বিজয়টিকা সে অভিসম্পাত।
.
ভাই ভাই ঠাই ঠাঁই
না
ভাই ভাই এক ঠাঁই?
ভারতীয় কৃষ্টি ও সভ্যতা সম্যক হৃদয়ঙ্গম করিবার চেষ্টা সর্বপ্রথম করেন অল-বিরুনি ও পরবর্তী যুগে হিন্দু-মুসলিম উভয় সাধনার যে চরম উৎকর্ষ বেদান্ত ও সুফি মতবাদে বিদ্যমান, তাহাদের মিলন ঘটাইবার চেষ্টা করেন রাজকুমার দারাশিকুহ। আমরা বারান্তরে তাহার উল্লেখ করিয়াছি।
এক্ষণে যে স্থলে উপস্থিত হইয়াছি সেখানে প্রশ্ন ওঠে, আর কি ভাই ভাই ঠাই ঠাই বলা চলে, না এখন বরঞ্চ বলিব ভাই ভাই এক ঠাই?
এই সম্পর্কে একটি উদাহরণ নিবেদন করি।
খ্রিস্টানরা যেরকম এদেশে সিরিয়ন ক্যাথলিকবাদ, রোমান ক্যাথলিকবাদ এবং প্রোটেস্টান্ট ধর্মের নানা চার্চ বা মতবাদ স্ব স্ব ধর্মবিশ্বাসানুযায়ী প্রচলিত করিবার চেষ্টা করেন, মুসলমানরাও সেইরূপ সুন্নি, শিয়া ও অন্যান্য নানারকম মজহব (Seeds) প্রচলন করার চেষ্টা করেন। ভারতবর্ষে পাঠান রাজত্ব সর্বত্র পূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠিত হইবার বহু পূর্বে মুসলিম অবৈতনিক মিশনারিরা এদেশে স্ব স্ব ধর্মমত প্রচার করিবার প্রয়াস করেন ও বেশিরভাগ সমুদ্রযোগে ভারতবর্ষের পশ্চিম উপকূলে, অর্থাৎ সিন্ধু দেশ হইতে কেপ কমরিণ পর্যন্ত কর্মস্থল বিস্তৃত করেন।
যাহারা ফিটজিরাল্ড কৃত ওমর খৈয়ামের ইংরেজি অনুবাদের উপক্রমণিকাটি মনোযোগ দিয়া পড়িয়াছেন তাহাদের স্মরণ থাকিবে যে, ওমর খৈয়ামের বন্ধু হিসাবে আরেকটি লোকের নাম তাহাতে উল্লেখ করা হইয়াছে– সে নাম হাসন বিন্ সব্বার। এই হাসন সব্বা স্বধর্ম ও স্বাধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত করিবার মানসে পারস্যে এক ভয়ঙ্কর গুপ্তঘাতকদের প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করেন; সেই ঘাতকদের নাম হশিশিয়ুন এবং হশিশিয়ুনরা ক্রুসেডের নাইটদের মধ্যে এমনই আতঙ্কের সৃষ্টি করে যে, সেই হশিশিয়ুন শব্দ ল্যাটিনের ভিতর দিয়া ইতালির assassino হইয়া, ফরাসি assassin-এ রূপান্তরিত হইয়া ইংরেজিতে সেই বানানেই প্রচলিত আছে। হানন সব্বা পারস্যে আপন কর্মভূমি সীমাবদ্ধ করেন নাই। বিদেশে স্বমত সুপ্রতিষ্ঠিত করিবার বাসনায় গুজরাটে তিনি মিশনারি প্রেরণ করেন। তাঁহাদেরই একজন লোহানা রাজপুতদিগের মধ্যে অ্যাসাসিনদের শিয়া ধর্ম প্রচার করেন। ইহারা বর্তমানে পশ্চিম ভারতে খোঁজা সম্প্রদায় নামে সুপরিচিত। কলিকাতার রাধাবাজারে ইঁহাদের কাহারও কাহারও কাপড়ের দোকান আছে।
এস্থলে শিয়া-সুন্নি মতবাদ লইয়া আলোচনা করা নিষ্প্রয়োজন। ততোধিক নিষ্প্রয়োজন শিয়াদের বিভিন্ন সম্প্রদায় ও তাহাদের পার্থক্য লইয়া বাক্যব্যয় করা। শুধু এইটুকু বলা প্রয়োজন যে, হাসন সব্বার মতবাদী খোঁজা মুসলমানরা উত্তর ভারতের শিয়া হইতে ভিন্ন; উত্তর ভারতের শিয়ারা ইসনা আশারি অর্থাৎ বারোজন শুরুতে বিশ্বাস করেন, খোঁজারা ইসমাইলি অর্থাৎ ইসমাইলকে শেষ প্রধান গুরু হিসাবে বিশ্বাস করেন। অনুসন্ধিৎসু পাঠক এই সব বিভিন্ন মতবাদের আংশিক ইতিহাস এনসাইক্লোপিডিয়া অব রিলিজিয়ন অ্যান্ড এথিকস এবং পূর্ব ইতিহাস এনসাইক্লোপিডিয়া অব ইসলামে পাইবেন।
লোহানা রাজপুতরা বৈষ্ণব ধর্মে বিশ্বাস করিতেন ও সম্ভবত পঞ্চরাত্র সম্প্রদায়ভুক্ত ছিলেন (Schrader-এর আজিয়ার হইতে প্রকাশিত পাথরাত্র সিস্টেম দ্রষ্টব্য)। কিন্তু বৈষ্ণব যে ছিলেন সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নাই–কারণ তাঁহারা বিষ্ণুর দশ অবতারে বিশ্বাস করিতেন।
অদ্যকার খোঁজাদের মধ্যে কুরান শরিফের প্রচলন নাই। তাঁহাদের ধর্মগ্রন্থগুলি আংশিক কচ্ছের উপভাষায় ও আংশিক গুজরাতিতে লেখা। সেগুলি গিনান। (সংস্কৃত জ্ঞান) নামে প্রচলিত ও তাহাদের মধ্যে দশাবতার পুস্তক বা গিনান সর্বাধিক সম্মান পায়। লোহানা রাজপুতদিগকে যে মিশনারি ইসমাইলি শিয়া মতবাদে দীক্ষিত করেন সেই নুর-সৎ-গুর (নুর আরবি শব্দ রশ্মি অর্থে ও সৎগুর সৎগুরু হইতে) দশাবতারের প্রণেতা। খোঁজারা সাধারণ মুসলমানদের মসজিদে যান না, তাহাদের স্বতন্ত্র জমাতখানা বা সম্মেলন গৃহে জমায়েত হন। বিশেষ পর্ব উপলক্ষে দশাবতার পঠন হয়, প্রথম নয় অবতার মৎস্য, কূর্ম, বরাহ ইত্যাদি তাঁহারা উপবিষ্ট হইয়া শ্রবণ করেন; কিন্তু দশমাবতারের কাহিনী আরম্ভ হইলে তাহারা দণ্ডায়মান হন।
এই দশমাবতার লইয়া বৈষ্ণব ও খোঁজার পার্থক্য। বৈষ্ণবমতে দশমাবতার কল্কি, খোঁজামতে দশমাবতার বহুকাল হইল মক্কায় জন্মগ্রহণ করিয়াছেন– তিনি মহাপুরুষ মুহম্মদের জামাতা হজরত আলি। (পাঠককে এইস্থলে স্মরণ করাইয়া দেই যে, গোঁড়া শিয়ারা আলিকে মহাপুরুষ মুহম্মদ অপেক্ষা সম্মান প্রদর্শন করে ও আদালুসের ইবনে হাজমের মতে এমন শিয়াও আছেন যাঁহারা বলেন, দেবদূত = ফিরিস্তা জিবরাইল = Gabriel ভ্রমবশত কুরান শরিফ হজরত আলিকে না দিয়া হজরত মুহম্মদকে দিয়া ফেলেন!!! এবং আরও বিশ্বাস করেন যে, হজরত আলির মৃত্যুর পর তাঁহার আত্মা তাঁহার পুত্র হাসন তৎপর তাঁহার ভ্রাতা হুসেন, তৎপর জয়ন উল-আবেদিন তৎপর তাঁহার পুত্র হইয়া বংশানুক্রমে চলিতে চলিতে বর্তমান জীবিত ইমাম বা গুরুতে বিরাজমান বর্তমান গুরুর নাম পরে উল্লেখ করিব।