(দোষাদুষির কথা হইতেছে না। আমরা ইতিহাসের যে শিখরে দাঁড়াইয়া দিকনির্ণয়ের চেষ্টা করিতেছি, সেখানে হিন্দু-মুসলমানের স্বার্থ এমনি বিজড়িত যে, একে অন্যকে ধাক্কাধাক্কি করিলে উভয়েরই পতন ও অস্থিভঙ্গের সমূহ বিপদ অবশ্যম্ভাবী।)
উপরোল্লিখিত রোগনির্ণয় সাধারণ মোটামুটিভাবে করা হইল। কিন্তু ইহার ব্যত্যয়ও আছে ও সেই সম্পর্কে প্রথম বক্তব্য যে, উপরোল্লিখিত রোগ মৌলানা ও শাস্ত্ৰীমণ্ডলীর। দেশের হিন্দু মুসলমান জনসাধারণ শাস্ত্র লইয়া অত্যধিক শিরঃপীড়ায় ব্যতিব্যস্ত হয় না; পক্ষান্তরে অর্থনৈতিক চাপে পড়িয়া একে অন্যের সঙ্গে মিলিতে ও এমনকি বসবাস করিতেও বাধ্য হয় কিন্তু সে-প্রসঙ্গ এখনও উত্থাপিত করিবার সময় হয় নাই। দ্বিতীয় এই যে, শাস্ত্রালোচনা করিবার ঔদার্য শাস্ত্রীর আছে সন্দেহ নাই কিন্তু ভারতবর্ষে ট্রেড সিক্রেট জাতীয় একটি নিন্দনীয় ঐতিহ্য অর্ধ-পণ্ডিতদের ভিতরে আছে। যোগ ও তন্ত্র শিক্ষা করিতে যাঁহারাই চেষ্টা করিয়াছেন– হিন্দু-মুসলমান যিনিই হউন– তাঁহারাই জানেন যে, গুণীরা জ্ঞানদানে কী পরিমাণ পরাজুখ। ফলিত-জ্যোতিষ, আয়ুর্বেদ, প্রতিমা-নির্মাণ, সঙ্গীত জাতীয় অন্যান্য প্রত্যক্ষ ও প্রয়োজনীয় বিদ্যার কথা বাদই দিলাম। অবশ্য একটি কারণও আছে, তাহাকে শাস্ত্রাধিকার বলে। অপকূ পাত্রে যোগের ন্যায় অত্যুষ্ণ ঘৃত রাখিলে যে সে সহ্য করিতে পারিবে না তাহাতে আর কী সন্দেহ? কিন্তু ভুক্তভোগী মাত্রই অকপটচিত্তে স্বীকার করিবেন যে এই শাস্ত্রাধিকার লইয়া অর্ধদগ্ধ পণ্ডিতেরা– সত্যকার বিদগ্ধেরা নহেন অনেক সময় মাত্রাজ্ঞান হারাইয়াছেন ও যোগ্য ব্যক্তিকেও প্রত্যাখ্যান করিয়াছেন।
গজনির বিখ্যাত মহমুদের সভাপণ্ডিত গুণীজন দ্বারা মহমুদ অপেক্ষা অধিক সমাদৃত অল-বিরুনি তাঁহার ভারতবর্ষ পুস্তকে এই লইয়া পুনঃপুন পরিতাপ করিয়াছেন। কিন্তু তাহার ধৈর্য ও জ্ঞানতৃষ্ণার প্রশংসা করিতে হয় ও যেসব পণ্ডিতের সঙ্গে তাঁহার যোগাযোগ হইয়াছিল, তাহাদের কয়েকজনকে তসলিম করিতে হয় যে, তাঁহারা অকৃপণভাবে জ্ঞানদান করিয়াছিলেন। না হইলে অল-বিরুনি ষড়দর্শন, রামায়ণ-মহাভারত, পুরাণ জ্যোতিষ ইত্যাদি নানা বিষয়ে লিখিতেন কী প্রকারে? (এই প্রসঙ্গ হয়তো পুনর্বার উত্থাপিত হইবে না, তাই একটি জিনিসের প্রতি পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করিবার লোভ সম্বরণ করিতে পারিলাম না; অল-বিরুনি তাহার পুস্তকে মহাভারতের যে পর্ববিভাগ ও তাহাদের শিরোনামা দিয়াছেন, সেগুলির সঙ্গে অদ্যকার প্রচলিত মহাভারতের বিস্তর অনৈক্য দৃষ্ট হয়। এ বিষয় লইয়া কোনও গবেষণা এযাবৎ আমার দৃষ্টিগোচর হয় নাই বলিয়া গুণীজনের সহৃদয় দৃষ্টি আকর্ষণ করিতেছি। Sachau-এর India নামক ইংরেজি অনুবাদ দ্রষ্টব্য।)
দুই ধর্মের চরম নিষ্পত্তি সম্মিলিত করিয়া হিন্দু-মুসলমানকে উচ্চাঙ্গ সাধনার ক্ষেত্রে মিলিত করিবার আর একটি প্রক্ষিপ্ত উদাহরণ দৃষ্ট হয়। সে উদাহরণটি এমনি ছন্নছাড়া, যূথভ্রষ্ট যে, বিশ্বাস হয় না এমন সাধনা সে-যুগে কী করিয়া সম্ভব হইল।
প্রাতঃস্মরণীয় রাজকুমার দারাশিকুহর কথা স্মরণ করিতেছি। কী অপূর্ব পাণ্ডিত্য ও অসাধারণ উপলব্ধির সম্মেলনে তাহার মুজম-ই বহরেন বা দ্বিসিন্ধুমিলন সৃষ্ট হইল। ১৮২০-৩০-এর সময় রাজা রামমোহন উপনিষদকে লোকচক্ষুর সম্মুখে আনিয়া ভারতে প্রখ্যাত হইলেন। তিনি ব্রাহ্মণসন্তান– কার্যটি তাঁহার পক্ষে অসম্ভব নয়। কিন্তু তাহার প্রায় দুইশো বৎসর পূর্বে পৃথিবীর সর্বাধিক বিলাসব্যসান মোগল রাজপরিবারের ফারসি-ভাষাভাষী সুকুমার রাজকুমার যৌবনের প্রারম্ভে কী করিয়া সংস্কৃতের বিরাট ভাণ্ডার হইতে এই অক্ষয়, অনাদৃত খনিটি কোন যোগবলে আবিষ্কার করিলেন? ব্রাহ্মণপণ্ডিত রাখিয়া তাহার অনুবাদ ফারসিতে করাইলেন পণ্ডিত ক্ষিতিমোহন শাস্ত্রী মহাশয়ের নিকট হইতে শুনিয়াছি মূল পাণ্ডুলিপিতে নাকি দারার স্বহস্তে কৃত শুদ্ধি সম্মার্জন মার্জিনে আছে। সেই ফারসি তর্জমা জেসুইয়ট দ্য পেরো লাতিনে অনুবাদ করেন এবং সেই অনুবাদ জানি না কী করিয়া জর্মন দার্শনিক শোপেনহাওয়ারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। কান্টের দেশের লোক, প্লেটোর ঐতিহ্যে সঞ্জীবিত, হেগেলের সমসাময়িক এই দর্শনার্ণনের জর্মন কর্ণধার বলিলেন, উপনিষদ আমার জীবনে শান্তি আনয়ন করিয়াছে। তার পর জর্মনি ও পরে ইউরোপে হুলস্থুল পড়িয়া গেল। উপনিষেদের খেই ধরিয়া নানা পণ্ডিত নানা সংস্কৃত জৰ্মনে তর্জমা করিলেন– সর্বত্র ভারতীয় বিদ্যা ছড়াইয়া পড়িল। কিন্তু সেকথা আজ থাক। অনুসন্ধিৎসু এই লোমহর্ষক লুপ্তগৌরব প্রত্যর্পণকারিণী কাহিনী জর্মন পণ্ডিত বিন্টারনিৎস (Winternitz) ও শ্রীযুক্ত রাধাকৃষ্ণণের ঈস্টার্ন আইডিয়ালিজম্ ও বেস্টার্ন থট পুস্তকে পাইবেন।
দারাশিকুহ’র দ্বিসিঙ্কুমিলনে তিনি ইসলামের সাধনামণি সুফিতত্ত্ব ও হিন্দু দর্শনের চিন্তামণি বেদান্ত তাহার জ্ঞানকাঞ্চনাঙ্গুরীয়তে একাসনে বসিয়া যে রশ্মিধারার সম্মেলন করিলেন, হায়, তাহা দেশের তমসান্ধকারকে বিদ্ধ করিতে সমর্থ হইল না।
কিয়ৎকাল পরেই প্রলয় প্রদোষে মোগলের উষ্ণীষশীর্ষ প্রস্ফুরিত হইতে লাগিল, শবলুব্ধ গৃধীদের বীভৎস চিল্কারের মধ্যে যোগাঙ্গুরীয় কোন অন্ধকারে বিস্মৃত বিলুপ্ত হইল।