সবকিছু দেখিনি, যা দেখলুম তাতে খুশিই হয়েছি। রুচিবাগীরা বলেন, এরকম টাকার শ্রাদ্ধ, বাজে থিয়েটার এবং থিয়েটারকে টেক্কা দেবার জন্য কলকাতা থেকে বাঙলা ফিল আনানো; এরা যদি ট্যাক্সি করে মীরাট থেকে কলাগাছ আনালো তবে ওরা প্লেনে করে কলকাতা থেকে মাল্য যোগাড় করালে; এসব অপব্যয় আড়াআড়ি নিতান্ত অর্থহীন, মূল্যহীন এবং এদের চাপে পড়ে দেবীপূজার মাহাত্ম্য গাম্ভীর্য সমস্তই নির্মমভাবে ব্যর্থ হয়।
বহু স্থানে রুচিবাগীশদের সঙ্গে আমি একমত– একথা অস্বীকার করে মহানবমীর দিনে আমি মহাপাতক হতে চাইনে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে একথাও বলব যে, যাদের রুচি আছে, যারা দেবী-পূজার প্রথম দিন থেকে শেষ দিন পর্যন্ত কী কী করতে হয় সে সম্বন্ধে সুস্পষ্ট ধারণা ধরেন, তারা যদি হাত গুটিয়ে বসে থাকেন, তবে দিল্লি শহরের ঐতিহ্য-বিস্মৃত যুবক-যুবতীরা এমন কী অলৌকিক কর্ম সমাধান করতে পারবে? এদের অনেকেই পুব, পশ্চিম কোনও বাঙলায় কখনও যায়নি, বাঙলায় দুর্গাপূজার রূপ এরা কখনও দেখেনি– এদের দেখাবে কে, শেখাবে কে?
কিন্তু এদের উৎসাহ-উদ্দীপনা খাঁটি বাঙালির চেয়ে কোনও অংশে কম নয়। হাঁসকে যেমন জলে ছেড়ে দিলে সে তৎক্ষণাৎ সাঁতার কাটতে আরম্ভ করে, বাঙালিকে তেমনি পৃথিবীর যে কোনওখানেই ছেড়ে দাও না কেন, বাঁশ, খড়, মাটি, রঙ যোগাড় করে ভালো-মন্দ একটি প্রতিমা বানিয়ে বসবেই বসবে, ঢাক-ঢোল সানাইয়ের অভাবে ট্যাম্বুরিন ক্লারিনেট দিয়ে কাজ চালিয়ে নেবেই নেবে।
আমার চোখে পড়ে এই উৎসাহটাই। তার বর্তমান গতি বা রূপ দেখে আমি নিরাশ হইনে। যতক্ষণ প্রাণ আছে ততক্ষণ নিরাশ হবার কোনও কারণই আমি দেখতে পাইনে।
***
দিল্লির যেসব ছেলে-ছোকরারা দেহলি প্রান্তে পড়ে এবং আমাকে যারা ব্যক্তিগত জীবনে কিছুটা মানে, তাদের উদ্দেশে আমি দু একটি কথা বলতে চাই।
দুর্গাপূজার প্রধান উদ্দেশ্য শক্তির সন্ধান, শক্তির সাধনা। এ শক্তি শারীরিক মানসিক নৈতিক সর্বপ্রকারের পার্থিব আধ্যাত্মিক শক্তি ছাড়িয়ে গিয়ে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সর্বশক্তির আধার। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অন্তরালে যেসব শক্তি আছে যাদের সন্ধান করতে গিয়ে আমাদের বাক্ এবং চিত্ত বার বার ফিরে আসে সেগুলোও ওই মূল শক্তির ভিতর সমাহিত। মানুষ যখন ধ্যানলোকে তার শারীরিক মানসিক সর্বপ্রকারের সংকীর্ণ সীমা অতিক্রম করে ব্রহ্মের সঙ্গে মিলিত হয় তখন সে শক্তি পায় সেই মূল শক্তি থেকে, আবার ক্ষুদ্রতম কীটাণুকীট যখন তার সামান্যতম প্রয়াসে নিযুক্ত হয় তখনও এই বিশ্বশক্তি তাকে অনুপ্রাণিত করে। এ শক্তির বাইরে কোনও কিছু নেই– সবকিছুই এরই ভিতরে।
শান্তির সাধনা করো আর সংগ্রামের সাধনাই করো, এই শক্তি ছাড়া অন্য পন্থা নেই।
এই জ্ঞানের মাধ্যমে আমরা জড়জগতের সৃষ্টিশক্তির অনেক সন্ধান পেয়েছি এবং শক্তির দ্বারাই আমাদের সভ্যতা গড়ে তুলেছি। শক্তিকে কেউ অস্বীকার করে না, এ শক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়ালে যে আমাকে সঙ্গে সঙ্গে নিষ্পেষিত হতে হয় সে তত্ত্ব সকলেরই জানা। ঠিক তেমনি আমাদের মনের ভিতরে-বাইরে নানা ধরনের শক্তি আছে যার সন্ধান কেউ অল্পবিস্তর পেয়েছে, কেউ সাধনার জোরে বেশি পেয়েছে।
এঞ্জিনের শক্তির সামনে আমি দাঁড়াইনে, কিন্তু নৈতিক শক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়ালেও যে তদ্দণ্ডেই আমার বৃহত্তর মৃত্যু সে কথা আমরা ভেবে দেখিনে। তার প্রধান কারণ আমরা সে শক্তির স্বরূপ চিনিনে– সে শক্তি তো চোখ দিয়ে দেখা যায় না, হাত দিয়ে স্পর্শ করা যায় না। এই নৈতিক শক্তির স্বরূপ মহাত্মা গাঁধী তাঁর সর্বসত্তা দিয়ে চিনতে পেরেছিলেন এবং সেই শক্তি-অশ্ব যখন তিনি তাঁর স্বরাজরথে পার্থসারথির মতো সংযোজনা করলেন তখন ইংরেজকে পরাজয় স্বীকার করতে হল।
এ শক্তি সকলেই কাজে খাটাতে পারবে সে আশা দুরাশা। পার্থসারথি হওয়া মহামানবের কর্ম কিন্তু এ শক্তিকে চিনতে পারা ততখানি কঠিন নয়। সামান্যতম পদাতিকও কৃষ্ণের রথ দেখে চিনতে পারে এবং পথ ছেড়ে সরে দাঁড়ায়। এ তত্ত্ব নেতিবাচক কিন্তু এর কমে বেঁচে থাকা অসম্ভব। তাই এর সন্ধান আমাদের অহরহ করতে হবে। নৈতিক ভুবনে শক্তিশালী হই আর না-ই হই, শক্তিমানকে যেন অন্তত চিনতে পারি।
***
এসব শক্তি ছাড়িয়ে যে বিশ্বশক্তি, যে বিশ্ব-ভাণ্ডার থেকে সর্বশক্তি উচ্ছ্বসিত হয় তার সন্ধানে মানুষ এখনও খুব বেশি অগ্রসর হতে পারেনি। কী করলে সেই শক্তি-স্রোতে আমি শরীর ভাসিয়ে দিয়ে সুধাপারাবারে পৌঁছব তার সন্ধান পেয়েছেন অতি অল্প পুরুষই। এ-যুগে তাই শ্রীঅরবিন্দ ভারতবর্ষের আধ্যাত্মিক ইতিহাসে স্বর্ণসিংহাসনে বিরাজ করছেন। সকলেই জানেন, তিনি কতবার বলেছেন, শক্তিরূপা মাতাকে আরাধনা না করে আধ্যাত্মিক জগতে গত্যন্তর নেই।
দুর্গাপূজার দিনে বাঙালি এ সত্য সর্বান্তঃকরণে স্বীকার করে। কিন্তু বাদবাকি ৩৬৪ দিন? তখন বাঙালি আবার সেই নির্জীব শক্তিহীন বাঙালি?
তাই শক্তিপূজা শুধু কয়েকটি দিনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়— বছরের প্রতিদিন শক্তিকে স্মরণ করতে হয়, তাঁর সাধনা করতে হয়। –রায় পির্থেীরা
.
০৪.
প্রভাত মুখুয্যের রত্নদীপ যখন মাসিকে ধারাবাহিক হয়ে বেরোয়– আজ পিছন পানে তাকিয়ে মনে হয় সে যেন বহু যুগের কথা– তখন কী উৎসাহে বাঙালি জনসাধারণ এবং রুচিসম্পন্ন পাঠকেরাও সে-বই পড়েছিলেন! মফঃস্বলের শহরের ডাকঘরে যখন সে মাসিক আসত তখন তার জন্য কাড়াকাড়ি পড়ে যেত। আমাদের শহরে তো নিয়ম ছিল, পোস্ট মাস্টার মহাশয়ের মাসিকখানা পোস্টাপিসের সম্মুখের কালীবাড়িতে নিয়ে গিয়ে কাউকে দিয়ে চেঁচিয়ে পড়ানো– আমরা সবাই কুণ্ডুলি পাকিয়ে সেই শাস্ত্ৰ-পাঠ শুনতুম।