কেউ বলেন ৫৬০ খ্রিস্টাব্দ, কেউ বলেন ৫৬৯ খ্রিস্টাব্দ, কেউ বলেন ৫৭০ খ্রিস্টাব্দ।
মোদ্দা কথা এই : যখন কোনও মহাপুরুষ জন্মগ্রহণ করেন তখন তো মানুষ জানে না, তিনি একদিন মহাপুরুষ রূপে আত্মপ্রকাশ করবেন। তদুপরি হজরত জন্মগ্রহণ করেন বিত্তহীন অনাথের গৃহে। সে-কালে মক্কা শহরে লেখাপড়ার খুব একটা চর্চা ছিল না (হজরতকে লেখাপড়া শেখাবার কোনও চেষ্টা তাঁর বাল্যবয়সে করা হয়নি; বস্তুত তিনি নিরক্ষর ছিলেন)– কে লিখে রাখবে তার জন্মদিন?
এটা শুধু হজরতের বেলায়ই নয়। বুদ্ধদেব, মহাবীর, জরথুস্ত্র, খ্রিস্ট এঁদের সকলেরই জন্মদিবস এমনকি জন্মবছর নিয়েও পণ্ডিতেরা আদৌ একমত নন।
হজরতের পরলোকগমন দিবস সম্বন্ধে কোনও মতানৈক্য নেই। তিনি মরধাম ত্যাগ করেন ৭ জুন, ৬৩২ খ্রিস্টাব্দে। এবং হিজরি তারিখ অনুযায়ী ১২ রবিউল আউয়াল। অর্থাৎ তার জন্মদিন এবং মৃত্যুদিন একই দিবসে। এতে ভক্ত মুসলমান মাত্রই আল্লাহতালার অদৃশ্য অঙ্গুলিসংকেত দেখতে পান।
পূর্বেই নিবেদন করেছি হজরতের জন্মবৎসর ৫৬০, ৫৬৯, ৫৭০ বলা হয়। আমরা ছেলেবেলা থেকেই স্কুলে পড়েছি ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে। সেই জনমতই আমরা আবার মেনে নিলুম। এখন যাচ্ছে ১৯৭০। তা হলে এই বৎসর, এই মাসে, এই দিনে ইজরতের ১৪০০ জন্মদিন। তাই বহু মুসলমান এদিনটিকে বিশেষ সম্মান দেখাচ্ছেন। কিন্তু এখানে কিঞ্চিৎ মতভেদের সম্ভাবনা রয়ে গিয়েছে। মুসলমানদের বৎসর গণনা চন্দ্র নিয়ে। চান্দ্র বৎসর সৌর বৎসরের চেয়ে হ্রস্বতর। তদুপরি গণনাতে আরেকটা অসুবিধা আছে। মুসলমানদের বৎসর হিজরি, গণনা আরম্ভ হয় জুলাই ১৬, ৬২২ খ্রিস্টাব্দ। কিন্তু তার পূর্বে আরবরা বৎসর গণনা করত সৌর বৎসরে। হিসাব তাই কঠিনতর হয়ে যায়। এবং সর্বশেষ বিপদ, যে খ্রিস্টান ক্যালেন্ডার নিয়ে আমরা সন তারিখ গণনা করি তারও পরিবর্তন সংস্কার একাধিকবার হয়েছে।
অতএব এসব হিসাব আপনার-আমার মতো সাধারণ জনের কর্ম নয়। আমরা সরল বিশ্বাসী। স্কুলে পড়েছি ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে হজরত মুহম্মদের জন্ম হয়। আজ তার জন্মদিন। এবং উপস্থিত ১৯৭০। অতএব আজ তার ১৪০০ বৎসরের জন্মদিন। আজ আনন্দের দিন। ঈদের দিন। মুসলমান হিন্দু, খ্রিস্টান, জৈন, (মারওয়াড়ি) সক্কলকে মিষ্টান্ন বিতরণ করতে হয়।*
[*এই সামান্য লেখনটি লেখার উদ্দেশ্য : বহু হিন্দু এবং অনেক মুসলমান হজরতের জন্মদিন, পরলোকদিবস সম্বন্ধে ওয়াকিফহাল নন বলে মনে মনে সঙ্কোচ বোধ করেন। পণ্ডিতরাই যে বিষয়ে মনস্থির করতে পারেননি, সে স্থলে আমাদের অযথা কুণ্ঠিত হওয়ার কোনও কারণ নেই।]
.
ভাই ভাই ঠাঁই ঠাঁই
০১.
হিন্দু-মুসলমান সমস্যা ভারতবর্ষের সর্বত্র যে রূপে প্রকাশ পায়, বাংলাদেশে সে রূপ গ্রহণ করে না। উত্তর ভারতের অন্যত্র হিন্দুরা হিন্দি বলেন পড়েন, মুসলমানরা উর্দুর সঙ্গে যুক্ত। তেজবাহাদুর সপ্রু ও পণ্ডিত জহরলাল নেহেরু জাতীয় উর্দু ভাষাভাষী হিন্দুর সংখ্যা ক্রমেই কমিয়া আসিতেছে। এককালে বিহারে বহু মুসলমান হিন্দি শিখিতেন; শুনিতে পাই, তাঁহারাও নাকি হিন্দি বর্জন আরম্ভ করিয়াছেন।
কিন্তু বাংলাদেশের অধিবাসী– তিনি হিন্দুই হউন আর মুসলমান হউন বাংলা বলেন ও পড়েন। কাজেই ভাষার কল্যাণে বাঙালি হিন্দু-মুসলমান একে অন্যকে চিনিবার সুযোগ পায়। মিশরে কপ্ট-রা ক্রিশ্চান ও বাদবাকি বাসিন্দা আরব মুসলমান। কিন্তু উভয়ের ভাষা এক বলিয়া রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মিলনের সুবিধা হইয়াছে। প্যালেস্টাইনে নবাগত ইহুদিরা হয় ইউরোপীয় কোনও ভাষা বলে নতুবা মৃতপ্রায় ইয়েডিশ ভাষাতে। কলহ লাগিয়াই আছে।
বাঙালি মুসলমান বাঙালি হিন্দুর কৃষ্টি-সভ্যতা সাধারণ বাঙালি হিন্দু যতটুকু (পরিতাপের বিষয় সে ধূলপরিমাণে) জানেন ইচ্ছা করিলেই ততটুকু অক্লেশে জানিতে পারেন ও অনেকেই জানেন। সাধারণ বাঙালি হিন্দু যেটুকু বেদ-উপনিষদ, রামায়ণ-মহাভারত, পুরাণ-ভাগবত, ষড়দর্শন, কাব্য-নাটক পড়েন, তাহা বাঙলা অনুবাদে ও বাদবাকি বৈষ্ণব ধর্মতত্ত্ব রামপ্রসাদী, পরমহংসদেবের রচনামৃত তো মূল বাঙলাতেই আছে। ফলিত-গলিত জ্যোতিষের জন্য বিরাট পঞ্জিকা আছে। বলিতে কি, গ্রামাঞ্চলে পঞ্জিকা বেদ-উপনিষদ গীতাকে হার মানাইয়াছে। আশ্চর্য হইবারই বা কী আছে? ভবানীকে যখন মহাকাল এক বসরকালের মধ্যে নিজেকে সীমাবদ্ধ করিয়া শুধু ওই বৎসরেরই ফলাফল নিবেদন করেন, তখন তাহাকে উপেক্ষা করিবে কোন নাস্তিক? আমরাও করি না। বস্তুত সরকারি আবহাওয়া দপ্তরের ভবিষ্যদ্বাণী অপেক্ষা ক্ষণা দেবীর উপর অন্তত আমার বিশ্বাস ভরসা বেশি।
সে যাহাই হউক। আসল কথা এই যে, অনুবাদ সাহিত্যে বাঙলা এখন এতটা সমৃদ্ধ হইয়াছে যে, তাহা দ্বারা সাধারণ বাঙালি নিজেকে দেশের ঐতিহ্যের সঙ্গে যুক্ত রাখিতে পারেন। বাঙালি মুসলমানও এই সাহিত্য হইতে অনেক কিছু পারেন। উপায় নাই। এইসব অনুবাদ, মূল বৈষ্ণব পদাবলি, মেঘনাদ বধ কাব্য, কৃষ্ণচরিত্র ইত্যাদি বাদ দিলে প্রাক্ রবীন্দ্র সাহিত্যে রইল কী?
এখন প্রশ্ন, বাঙালি হিন্দু-মুসলমানদের অথবা হিন্দুর দ্বারা লিখিত মুসলমানি সাহিত্যের কতটা খবর রাখিয়াছেন ও রাখিতেছেন?
বাঙালি-হিন্দু মুসলমানদের দ্বারা লিখিত পুস্তক যে পড়েন না বা কম পড়েন, তার জন্য তাহাকে সম্পূর্ণ দোষ দেওয়া যায় না। কারণ মুসলমানদের ভিতর শক্তিমান লেখক বড় কম। একবার ভাবিয়া দেখিলেই হয় যে, আজ যদি কোনও মুসলমান শরত্ববুর মতো সরল ভাষায় মুসলমান চাষি ও মধ্যবিত্ত জীবনের ছবি আঁকেন, তবে কোন হিন্দু না পড়িয়া থাকিতে পারিবেন? আরব্যোপন্যাসের বাঙলা তর্জমা এখনও হাজার হাজার বিক্রয় হয় যদিও তর্জমাগুলো অতি জঘন্য ও মূল আরবি হইতে একখানাও এযাবৎ হয় নাই। আবু সঈদ আইয়ুবের লেখা কোন বিদগ্ধ বাঙালি অবহেলা করেন? কিন্তু তিনি সৌন্দর্যতত্ত্ব সম্বন্ধে প্রবন্ধ লেখেন; মুসলমান জীবন অঙ্কিত করা বা মুসলমানি কৃষ্টি বা সভ্যতার আলোচনা তিনি করেন না। বাঙালি কবীরকে কে না চিনে?