এ তো গেল। ওদিকে আরেক শিরঃপীড়া। ইংরেজের বাক্যরীতিতেই বলি, সে একাই তো বেলাভূমিতে একমাত্র উপলখণ্ড নয়। আরও মেলা চিড়িয়া রয়েছে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় কেবল অতি সামান্য একটা কারণে একটু মুশকিল বাধল। সেটা হচ্ছে এই যে, পৃথিবীর অন্য দেশগুলোকে ভূতে পায়নি।
এস্থলে দেখা ইতোমধ্যে ইউরোপের অন্যান্য জাত ভারতের অনেক অনেক উত্তম উত্তম। গ্রন্থ- অবশ্য অধিকাংশ অনুবাদে পড়ে ফেলেছে। দারাশিকুহকৃত উপনিষদের ফারসি অনুবাদ কিংবা তার আদেশে কৃত অনুবাদ (মুজমা-ই-বহরেন–দ্বিসিন্ধু মিলন) লাতিনে অনূদিত হয়েছে। ইংরেজ পড়ল বিপদে। উপনিষদ হিন্দু ধর্মগ্রন্থ। তার ফারসি অনুবাদ করল এক মুসলমান। তার লাতিন অনুবাদ করল এক খ্রিস্টান পাদ্রি এবং তার উচ্ছ্বসিত প্রশস্তি গাইল সেদিনকার– সর্বোত্তম বললেও অত্যুক্তি করা হয় না– সর্বসংস্কারমুক্ত, ধর্ম-নিরপেক্ষ দার্শনিক শোপেনহাওয়ার।
ইতোমধ্যে, শেক্সপিয়রের সঙ্গে সঙ্গে যার নাম অনেকেই করে থাকেন সেই কবি গ্যোটে শকুন্তলা নাট্যকে প্রশংসা প্রশংসায় স্বর্গে তুলে দিয়েছেন– না, ভুল বললুম,–তিনি বললেন, এই নাট্যেই স্বর্গ এবং পৃথিবী সম্মিলিত হয়েছে।
ইংরেজ জাত ঘড়েলস্য ঘড়েল। সে সুর পালটাল। অবশ্য আমার বক্তব্য এ-নয়, যে নিরপেক্ষ প্রাচ্যবিদ্যামহার্ণব কোনও ইংরেজ কস্মিনকালেই ছিল না। কিন্তু কে পরোয়া করে তাদের?
তাই আজ যখন প্রশ্ন উঠেছে, মহাভারত কাল্পনিক না ঐতিহাসিক তখন ইংরেজ পণ্ডিতেরই বরাত দেওয়া প্রকৃষ্টতম পন্থা। উওশবর্ন হপকিনস তার একাধিক প্রামাণিক গ্রন্থে বলেছেন (যে কারণে, অধমের জানা মতে, ধর্ম বিষয়ে সর্বোৎকৃষ্ট এনসাইক্লোপিডিয়ায় তিনি মহাভারত সম্বন্ধে প্রামাণিক প্রবন্ধ রচনা করার জন্য সম্মানিত আমন্ত্রণ পান), নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে মহাভারত কাব্যে কোনও সত্যকার সংঘর্ষ প্রতিবিম্বিত হয়েছে– ইট (মহাভারত) অনডাউটেডলি রিফলেটস সম্ রিয়েল কনটেসট। পুনরপি তিনি বলেছেন, সত্য ঐতিহাসিক পদ্ধতিতে আমরা যদি পুরাণে উল্লিখিত রাজবংশসমূহের তালিকা (লিস্টস) মহাভারতের সঙ্গে মিলিয়ে দেখি তবে পাই যে মহাভারতের নানা প্রকারের কিংবদন্তির পশ্চাতে সত্য ইতিহাস বিম্বিত হয়েছে। স্বর্গত গিরীন্দ্রশেখর ঠিক এই মতটিই তার প্রামাণিক গ্রন্থে সপ্রমাণ করেছেন; এ-পত্রিকার সম্পাদকীয় স্তম্ভে তার উল্লেখ হয়েছে।
সব থাক, সব যাক্। পাঠক, তোমার কমনসেনস কী বলে? কোনও কিছু ঘটেনি, কোনও কিছু হয়নি, এ যেন হাওয়ার-কোমরে দড়ি বাধা!
ঠিক তেমনি, খোঁড়াখুঁড়ি করে কিছু পাওয়া যায়নি বলে সব ঝট হ্যায়? তবে একটি ছোটিসি চুটকিলা পেশ করি। এক রেড ইন্ডিয়ান বলল তার দেশে খোঁড়াখুঁড়ির ফলে বেরিয়েছে প্রাগৈতিহাসিক যুগের টেলিগ্রাফের তার। অতএব সে-যুগেই তারা টেলিগ্রাফি জানত। উত্তরে এসকিমো বলল, তার দেশে খোঁড়াখুঁড়ি করে কোনও প্রকারের তার পাওয়া যায়নি। অতএব তারা বেতার ওয়্যারলেস ব্যবহার করত।
কিন্তু আমার শিরঃপীড়া ভিন্ন। মহাভারতের মতো কোনও গ্রন্থই বার বার পুনর্বার আমি পড়িনি। অথচ প্রতিবার নব নব সমস্যা দেখা দেয়। সে কথা আর এক দিন হবে।
.
৫৭০-১৯৭০/১৪০০ বছর হজরত
মুহম্মদ (দ.)-এর চতুর্দশ জন্মশতবার্ষিকী
হজরতের জন্মদিন নিয়ে বিস্তর আলোচনা, সবিস্তর তর্কাতর্কি মোটামুটি এই চোদ্দশো বছর ধরে চলছে, এবং চলবেও।
আজ ৪ জ্যৈষ্ঠ, ১৮ মে, শুক্লপক্ষের দ্বাদশী। আরবি চান্দ্রমাসের গণনায় আজ রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখ। দ্বাদশ শব্দের ফারসি : দোওয়াজদহম। দো = দ্ব = দুই; দহম = দশম = দশ। অর্থাৎ দ্বিদশ। বলা হয়, হজরত মুহম্মদ এইদিন জন্মগ্রহণ করেন। তাই চান্দ্রমাস রবিউল আউয়াল-এর বারো তারিখকে বলা হয় ফহ্-ই-দো ওয়াজদহম্। দোওয়াজদহম্ শব্দের অর্থ এইমাত্র নিবেদন করেছি। ফহ্ শব্দের অর্থ জয়। এই আরবি শব্দটি আমাদের সম্পূর্ণ অজানা নয়। শিখেরা গুরুজিকি ফতেহ জয়ধ্বনি করেন; বাদশা আকবর নির্মিত ফতেহপুর সিক্রি অনেকেই দেখেছেন।
কবি মরহুম গোলাম মোস্তফা তাঁর বিশ্বনবী গ্রন্থে এই মত পোষণ করেছেন।
পক্ষান্তরে সুপণ্ডিত মরহুম মাওলানা মোহম্মদ আকরম খান তাঁর মোস্তফাচরিত গ্রন্থে বিস্তর গবেষণার পর সিদ্ধান্ত করেছেন, হজরতের জন্ম হয়, ৯ রবিউল আউয়াল; ১২ নয়।
কিন্তু বাঙলা দেশের জনসাধারণ, তথা উভয় বাঙলার সরকার মেনে নিয়েছেন যে হজরতের জন্ম হয় ১২ তারিখে। কিন্তু সেটা চাঁদ দৃশ্যমান হবার ওপর নির্ভর করছে। কাজেই কেউ কেউ ১৮ মে, অন্যেরা ১৯ মে হজরতের জন্মদিবস (ঈদ-ই-মিলাদ-উন-নবি; ঈদ = আনন্দদিবস, মিলাদ = জন্মক্ষণ ও-ল-দ ধাতুর অর্থ জন্ম দেওয়া, তার থেকে মওলিদ, মিলাদ, মওলু অনেক শব্দই প্রায় একই অর্থে এসেছে, এমনকি আরবের খ্রিস্টানরা বড়দিনকে বলে ঈদ, উল মিলাদ তাই পাঠক নির্ভয়ে আজকের পরবকে মিলাদ শরিফ–শরিফ = উচ্চ, সম্মানিত, ভদ্র মওলুদ শরিফ, ঈদ-ই মিলাদ যা খুশি বলতে পারেন। কিংবা পূর্বোল্লিখিত আরবি-ফার্সির সংমিশ্রণে ফ-ই-দোওয়াদহও বলতে পারেন।
নবী, পয়গম্বর, রসুল ইত্যাদি শব্দ একই ব্যক্তি, অর্থাৎ হজরতকে বোঝায়।
হজরতের জন্মদিন নিয়ে দেশের জনসাধারণ যা মেনে নিয়েছেন আমরাও তাই মেনে নিলুম। এখন প্রশ্ন তাঁর জন্ম কোন বৎসরে?