ওই সময়ে বাদশাহ জাহাঙ্গির চিঠি লিখলেন ওসমানকে : আত্মসমর্পণ করো। ওসমান অতি সংযত ভদ্র ভাষায় উত্তর দিলেন, যার মর্মার্থ, আপনি দিল্লীশ্বর, আপনার দেশ দেশব্যাপী বিরাট রাজত্ব। আমি তো তার তুলনায় সামান্য একটি চিড়িয়া। কিন্তু সামান্যতম পাখিটিও স্বাধীনভাবে থাকতে চায়।…. ওসমান জানতেন মোগলরা এতদিনে বেশ কিছুটা নৌ-যুদ্ধ শিখে নিয়েছে। তদুপরি সেটা শীতকাল (ইয়াহিয়া খানের কপাল ভালো যে শেখ মুজিবের সঙ্গে তার ঝগড়াটা চরমে পৌঁছায় মার্চ মাসে; বর্ষা নামলেই চিত্তির। তাই তিনি তিলব্যাজ না সয়ে মারলেন তাঁর হাতুড়ি ওই মোকাতেই)। তাই তিনি স্থির করলেন মোগলদের নিয়ে যেতে হবে সিলেটে। সেখানে যেসব হাওর আছে তার প্রধান ভাগ শীতকালে শুকোয় না। কারণ বৃষ্টির জন্য প্রসিদ্ধতম স্থল চেরাপুজি। তার কুল্লে পানি নেবে আসে সিলেট জেলায়, ডাউঁকি হয়ে জইন্তা হয়ে অসংখ্য নদনদী খাল নালা দিয়ে। এই সব হাওরে সামান্যতম ঝড় উঠলে ওই দেশেরই বহু কিশোর তরুণ তক বমি করতে থাকে– অর্থাৎ বাংলা কথায় সি-সিক হয় (পাঠকের স্মরণ থাকতে পারে ডিডে ল্যান্ডিঙের সমর প্রচুর সৈন্য নরমান্ডির বেলাভূমিতে নেমে সেখানে শুয়ে পড়ে। বমি করতে করতে তাদের পেটে তখন আর কিছু ছিল না যে লড়াই করে করে জর্মনদের ঘাঁটি দখল করে।
নেপোলিয়ন বলেছিলেন, এন আর্মি মার্চেজ অন ইটস স্টমাক। অন্যার্থে। কিন্তু এস্থলে এটা প্রযোজ্য)। এবং ঢাকা থেকে সিলেটের হাওর অবধি এক্কেবারে ফ্ল্যাট। সিলেট পৌঁছলেই আরম্ভ হয় টিলা, কোনও কোনও টিলাকে পাহাড়ও বলা যেতে পারে। ঘন বন জঙ্গল এবং প্রচুর সুপুরিগাছ।… ওসমান তাই পৌঁছলেন সিলেটে। রিয়ার গার্ড একশন করতে করতে। অর্থাৎ তিনটে সুপুরিগাছ জড়িয়ে বেঁধে তার সর্বোচ্চতম প্রান্তে একটা কাঠের প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে সেখানে কামান তুলে নিয়ে দুশমনের উপর কামান দাগতে দাগতে। মিয়াদের তখন তাজ্জব নয়া অভিজ্ঞতা হল। করে করে ওসমান সিলেট জেলার প্রায় আধখানা পেরিয়ে মিয়াদের নিয়ে গেলেন, আজ ম্যাপে যেখানে মৌলবি বাজার, তার তিন মাইল দূরে দুল্লভমপুরে (অধুনা নাম দুর্লভপুর)। তারই পরে হাইল হাওর। ওসমান ও তার সৈন্যদল হাওরের হাঁটুজলে পায়ে হেঁটে ওপারে চলে গেলেন। তিনি জানতেন, মোগলরা এ অঞ্চলে কখনও আসেনি। তারা জানে না কোন জায়গায় হাঁটুজল আর কোন কোন জায়গায় অথৈ জল। মোগলরা এপারে দাঁড়িয়ে। তার পর শুভলগ্নে ওসমান ওপার থেকে হাওর পেরিয়ে আক্রমণ করলেন– মোগল সৈন্যদের। তারা লড়েছিল প্রাণপণ। কিন্তু পরাজয় অনিবার্য বুঝতে পেরে তারা পালাতে আরম্ভ করল। এমন সময় হাতির-পিঠে-বসা অগ্রগামী ওসমানের চোখে এসে ঢুকলো একটা উটকো তীর। মাহুত ভয় পেয়ে হাতি ঘোরাল। ওসমান বুঝতে পেরে চেঁচাচ্ছেন, এগিয়ে চল চল। ওদিকে মোগল সৈন্যদের ভিতর বিজয়ধ্বনি আরম্ভ হয়েছে ওসমান পালাচ্ছে, ওসমান পালাচ্ছে। মোগলরাই জয়ী হল। সে এক করুণ কাহিনী। সুযোগ পেলে আরেকদিন সবিস্তর বলব।
কিন্তু আমি জালা জালা পুরনো কাসুন্দি ঘাঁটছি কেন? যারা বাংলা দেশ থেকে আসছেন, তাঁরাই বলছেন গেল সাড়ে-দুই মাস ধরে সবচেয়ে মোক্ষম লড়াই দিয়েছে সিলেটের লোক। তাদের কী সুবিধে টিলাবন হাওর– অর্থাৎ তেরা– পূর্বেই বলেছি।
ওসমান যুদ্ধে হারেন শীতকালে মার্চ মাসে। এবারে দেখি ঘন বরষায় তারা হাওরের কী সুযোগ নেয়।
এপিলোগ : আকবর বাদশাহ মারা যান আমাশাতে। বাংলা বিজয় অভিযানে বেহারে! সে আবার আমাশা! ঢাকার আমাশা অলিম্পিক। পিণ্ডির জাঁদরেল যে এই বর্ষায় ঢাকায় আসছেন, তার যদি ভালো-মন্দ কিছু একটা হয়ে যায়। সম্পাদক মহাশয়, আপনি সহৃদয় লোক। তাই আপনাকে অনুরোধ করছি, পিণ্ডির খান সাহেবকে জানিয়ে দিতে, প্রতিদিন দুটো এনটেরো ভায়োফর্ম এবং এক বড়ি ত্রিফলাকস, তদভাবে ইসপগুল তিনি যেন সেবন করেন। যদি তিনি এ যাত্রায় নিস্তার পান তবে ইতিহাস হয়তো আপনার প্রতি কটুকাটব্য করবে! সাধু সাবধান।
.
মহাভারত
পয়লা ফেব্রুয়ারি দিবস, কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটির বার্ষিক সম্মেলনে লাটসাহেব শ্ৰীযুত শান্তিস্বরূপ ধাওন যা বলেন তার বিগলিতাৰ্থ– আমি তিনখানা খবরের কাগজের রিপোর্টের ওপর নির্ভর করে আমার নিবেদন জানাচ্ছি- এতাবৎ ইউরোপীয় পণ্ডিতেরা মহাভারতের তথা ভারতীয় সভ্যতার ব্যাখ্যা (ইন্টারপ্রিট) করেছেন তাঁদের পশ্চিমী দৃষ্টিভঙ্গি দৃষ্টিকোণ দৃষ্টিবিন্দু (উয়েসটার্ন আইজ) দিয়ে। এখন আমাদের ভারতীয়দের উচিত, ভারতীয় সভ্যতা (শ্ৰীযুত ধাওন সভ্যতার–সিভলিজেশন-এর সঙ্গে কালচার বলেছিলেন কি না সেটা খবরের কাগজ উল্লেখ করেনি। এটা গুরুত্বব্যঞ্জক। কারণ যে কোন একটা জাতি, দেশ, নেশন অতিশয় সিভিলাইজড না হয়েও কালচার, বৈদগ্ধ্যের উচ্চাসন গ্রহণ করতে পারে। আমি ধরে নিচ্ছি শ্ৰীযুত ধাওন দুটোই বলতে চেয়েছেন। ভারতীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ব্যাখ্যা করা।
এ অতি উত্তম প্রস্তাব সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। আমাদের অজানা নয় যে, যবে থেকে ইংরেজ আপন স্বার্থের জন্য ভারতবর্ষে এসেছে সেই থেকেই এ দেশের নিন্দাবাদ করেছে। গোড়ার দিকে মৃদুকণ্ঠে, মোলায়েম মোলায়েম ভাবে। পরে যখন বণিকের মানদণ্ড পুরোপাক্কা রাজদণ্ডে পরিণত হল তখন ভারত বাবদে তার অন্যতম প্রধান কর্তব্য হয়ে দাঁড়াল বিশ্বজনের সামনে সপ্রমাণ করা : ভারতবর্ষ অতিশয় অশিক্ষিত, অসভ্য, অনলচরড দেশ এবং এ দেশকে সভ্য ভদ্র সত্যধর্মে –খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করার জন্য ইংরেজ নিতান্ত পরোপকারার্থে, প্রতি খ্রিস্টজনের যা কর্তব্য, অর্থাৎ বর্বরদের সভ্য করার জন্য এ দেশে এসেছে, এবং এই পাষণ্ড, নেমকহারাম দুশমনের কলকাতা শহরের জলাভূমির আমাশা, নানাবিধ জ্বর রোগে সাতিশয় ক্লেশ ভুঞ্জিয়া সদ্যপ্রভুর পদপ্রান্তে আপন আত্মা নিবেদন করছে, সেক্রিফাইস করছে, এক কথায় মার্টার বা শহিদ হয়েছে। এই যে ইংরেজের দম্ভোলিদম্ভ- এরই ঘৃণ্য ভণ্ডনাম হোয়াইট মেনস বার্ডেন। তদর্থ, গড ধবলাঙ্গদের প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন, সে যেন শ্যামাঙ্গ, কৃষ্ণাঙ্গ, রক্তাঙ্গ (রেড ইন্ডিয়ান), পীতাঙ্গ পৃথিবীর কুল্লে জাতকে শিক্ষিত সভ্য করার গুরুভার (বার্ডেন) আপন স্কন্ধে তুলে নেয়। এ বার্ডেন বইতে গিয়ে ইংরেজাদি শ্বেতাঙ্গদের কী পরিমাণ মুনাফা হয়েছে সে তত্ত্ব আমরা হাড়ে হাড়ে জানি। থ্রি মেন ইন এ বোট-এর প্রখ্যাত রসাচার্য ভারতপ্রেমী লেখক জরৌম কে জরৌম এই বার্ডেন ভণ্ডামিকে তীব্রতর ভাষায় ব্যঙ্গ করে এই শতকের গোড়ায় একটি প্রবন্ধ লেখেন : হোয়াইট মেনস বার্ডেন– হোয়াই শুড ইট বি সো হেভি? কিংবা ওই ধরনের। তিনি নানা প্রকারের ঠাট্টামশকরা ব্যঙ্গবিদ্রূপ সারার পর বক্রোক্তি করেন, হোয়াইট মেনস বার্ডেন বইতে গিয়ে আমরা যে আত্মত্যাগ, পরার্থে প্রাণ দান করলুম তাতে করে আমাদের কী ফায়দা হয়েছে? এই নেমকহারাম ইন্ডিয়ানরা (বলা বাহুল্য, ইংরেজের আত্মত্যাগ, ভারতীয়ের নেমকহারামি জরৌম আগাপাশতলা উল্টো বুঝলি রামার্থে নিয়েছেন। যদি আমাদের বার্ডেন বওয়ার মূল্য না বুঝে এখন নিজের বার্ডেন নিজেই বইতে চায় (ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন তখন জোরদার জরৌম তার প্রতি অনুরাগী) তবে ফেলে দে না, বাবা, ওই মূর্খদের স্কন্ধে ওদের আপন বার্ডেন। চলে আয় ওদেশ ছেড়ে। বয়ে গেছে আমাদের।