ইতোমধ্যে দুটি একটি করে খদ্দের আসতে আরম্ভ করেছে। তার থেকে বুঝলুম, রাত হয়ে আসছে। আমার কাছে আশ্চর্য বোধ হয় যে আমরা সূর্যচন্দ্র দেখে সময়টা কী এবং তার চেয়েও বড় কথা মানুষের আচরণ তার কাজ-কারবার স্থির করি। যেমন সূর্য অস্ত যাচ্ছেন; অতএব এখন রাস্তার ভিড় কমতির দিকে। আর বিলেতে জানালার পর্দা সরিয়ে দেখলেন রাস্তায় প্রচণ্ড ভিড়। নিশ্চয়ই লাঞ্চের সময়, অতএব দুপুর।
ক্রমে ক্রমে রেস্তোরাঁ ভর্তি হয়ে গেল। কিন্তু কী আশ্চর্য! সব গোরার পাল। একটি মাত্র ইন্ডিয়ান নেই। চল্লিশ বছর পূর্বে টিলবারির রেস্তোরাঁয় দেখেছিলুম বেশিরভাগ সিলেটি খদ্দের; মাত্র দু একটি গোরা। এখানে দেখি স লাল হো গিয়া।
মালিক ওয়ারলডু এটুলাসের মতো বিরাট একখানা মেনু এগিয়ে দিয়ে বলল, কী খাবেন, হুকুম দিন। আমি বললুম, প্লেনে বিস্তর ঝাঁকুনি খেয়েছি আর কী খাব, কও। বমি করেছে বেশ কয়েকজন। তুমি-আমি নিতান্ত সিলেটের লোক। জন্ম থেকে হাওর-বিলে নৌকা ভিতরে-বাইরে নাগরদোলার দোল খেয়ে শিলঙ যাবার সময় আচমকা পাহাড়ি মোড়, হেয়ার পিন টার্ন হজম করে করে সি সিক অ্যার সিক, ল্যান্ড সিক হইনে। কিন্তু এবারে আমো কাবু। গা গুলোচ্ছে, বমি না করলেই রক্ষে। প্লেনে ওঠার আগে যা-সব খেয়েছিলুম সেগুলো যেন রিটার্ন টিকিট নিয়ে গিয়েছিল; এখন ফিরি ফিরি করছে। উপস্থিত থাক। বরঞ্চ খাটের পাশে দু খানা স্যানউইচ রেখে দিয়ো। ক্ষিদে পেলে খেয়ে নেব।
মেনুটার ওপর চোখ বুলিয়ে যাচ্ছিলুম, খেয়াল না করে, মালিককে ভদ্রতা দেখাবার জন্য, আলতো আলতো ভাবে। বিরিয়ানি, কোর্মা, কালিয়া, কাবাব, কোফতা, চিকেনকারি গয়রহ গয়রহ। এ তো ডালভাত কিন্তু শব্দার্থে বলছি না। আই মিন, এগুলো তো এরকম ফ্যাশনেবল রেস্তোরাঁতে থাকবেই। ইংরেজিতে যাকে বলে মাসুটস। কিন্তু কী একটা মামুলি আইটেমের দাম দেখতে গিয়ে আমি যেন আমার চোখকে বিশ্বাস করতে পারলুম না। বলে কী? দশ শিলিং! মানে? দশ টাকা। তখন মেনুর ডান দিকে তাকিয়ে দেখি, সব মালেরই প্রায় ওই দাম। অর্থাৎ, দু পদী আহারাদির জন্য আপনার খসে যাবে পৌন্ড খানিক। পনরো, বিশ, পঁচিশ টাকা! ও! তাই ইন্ডিয়ানরা আসেনি। ওদের বেশিরভাগই তো ছাত্রসম্প্রদায়। ওদের জেবে অত রেস্ত কোথায়?… মনে পড়ল, চল্লিশ বছর পূর্বে ছ পেনিতে (পাঁচ আনাতে)। রাইসকারি পাওয়া যেত টিলবারি ডক্-এ।
পরে খবর নিয়ে শুনলুম, গঙ্গার ভাও মোটেই আক্রা নয়। এটাই নর্মাল। এমনকি, ওই পাড়ার চীনা, হাঙ্গেরিয়ান, স্প্যানিশ রেস্তোরাঁতে আহারাদি আরও আক্রা। আর এর পর খাস বিলিতি ডাঙর ডাঙর রেস্তোরাঁতে কী ভাও, সেটা শুধোবার মতো হিম্মত আমার জিগর কলিজায় ছিল না, সেটা আমার হাফ-সিঙ্গল-চা, দুটো-ফলস্ পিনেওলা বেরাদর পাঠক নিশ্চয়ই দিব্য-দৃষ্টিতে দেখে ফেলেছেন।
কিন্তু এহ বাহ্য। কোন দেশে কোন বস্তুর কী দর, বিভিন্ন দেশের রেস্তোরাঁর তুলনাত্মক দরদাম সম্বন্ধে ডকটেরেট থিসিস লিখে ধৈর্যশীল পাঠককে, এ-অধম নিপীড়িত করতে সাতিশয় অনিচ্ছুক! তবে কেন?
সেটা পরে হবে।
.
নটিংহাম
০১.
আমাদের ছেলেবেলায় ঘটি-বাঙালে রেষারেষি ঠাট্টা-মশকরা ছিল ঢের ঢের বেশি। একটা মশকরা আমার মনে পড়ল নটিংহাম যাবার ট্রেনে বসে। বাঙালের সঙ্গে (বাঙাল সাথে বলে এবং গদ্যেও লেখে সাথে; রবীন্দ্রনাথ শেষ বয়সে সেটা কিঞ্চিৎ অনিচ্ছায় স্বীকার করে নেন) লিলুয়া স্টেশনে দেখা এক ঘটির। বাঙাল শুধাল, কোথায় চললেন দাদা? ঘটি বলল, চললুম, দাদা, পশ্চিমে। গায়ে এটুখানি গত্তি লাগিয়ে আসি। বাঙাল আমেজ করল, দাদা বুঝি হিলি দিল্লি বিজয় করতে চললেন। কারণ সে যখন প্রথম দেশ ছেড়ে শেয়ালদায় নামে তখন গান রচেছিল।
লাম্যা ইশটিশানে
গাড়ির থনে।
মনে মনে আমেজ করি
আইলাম বুঝি আলী মিয়ার রঙ-মহলে
ঢাহা (ঢাকা) জেলায় বশ্যাল (বরিশাল) ছাড়ি ॥
তার তরে বরিশাল ছেড়ে ঢাকা যাওয়াটাই একটা মস্ত কসরত। এবং শেয়ালদা আসাটা তো রীতিমতো গামার সঙ্গে লড়াই দেওয়া!… অবশেষে ধরা পড়ল ঘটি দাদা যাচ্ছেন লিলুয়া।
সবই পরিপ্রেক্ষিতের ব্যাপার। লন্ডন থেকে নটিংহাম সোয়া শো মাইল হয় কি না হয়। আমাদের কাছে লস্যি। অথচ লন্ডনের ইংরেজ দোস্তেরা যেভাবে আমাকে ওখানে যেতে নিরুৎসাহ করেছিলেন তার থেকে মনে হল ওরা ও-মুলুককে প্রায় দুশমনের পুরী বলে ধরে নিয়েছেন। একাধিক জন বললেন, ওখানে– অপরাধ নিয়ো না এই এই, অর্থাৎ সেখানে ইন্ডিয়ানদের ঠ্যাঙানো হচ্ছে। আমি বললুম, যেতে যখন হবেই তখন অত ভেবে কী হবে। তদুপরি আমাদের পোয়েট টেগোর বলছেন–
মৃত্যুকে যে এড়িয়ে চলে মৃত্যু তারেই টানে
মৃত্যু যারা বুক পেতে লয় বাঁচতে তারাই জানে ॥
ট্রেনে বসে চিন্তা করে দেখি, আমি নটিংহাম সম্বন্ধে যা জানি সে ধর্তব্যের মধ্যেই নয়। (১) আমার একজন আত্মীয় সেখানে আছেন। আমার আপন আত্মীয় হলে না গেলেও চলত কিন্তু তিনি আমার ছোট বোনের দেবর। তিনি আবার তালেবর লোক। আমি যখন হামবুর্গে তখন কী করে কোথায় থেকে খবর পেয়ে তিনি নটিংহাম থেকে আমাকে ট্রাঙ্ক-কল করে সাতিশয় অনুরোধ জানালেন আমি যদিস্যাৎ ইংলন্ডে যাই তবে অতি অবশ্য আমাকে নটিংহাম যেতেই হবে, যেতেই হবে– তিন সত্যি। (২) ছেলেবেলায় রবিনহুডের কেচ্ছা পড়েছিলুম। তার কর্মস্থল ছিল নটিংহাম। পাশে ছিল শারউড বন। সেইটেই ছিল তাঁর স্থায়ী আস্তানা।… এদানির কলকাতার ছেলেছোকরারা আর রবিনহুডের কাহিনী তেমন একটা পড়ে না। কলকাতার গলিতে গলিতে এন্তের রবিনহুড। তবে অতি সামান্য একটা তফাৎ রয়েছে। রবিনহুড নাকি ডাকাতি করে যে-কড়ি কামাতো সেটা গরিব-দুঃখীদের বিলিয়ে দিত। অদ্যকার কলকাতার রবিনহুডরা চাঁদার নামে, হ্যাঁনত্যানার নামে যে-টাকা, প্রায়-ডাকাতি করে কামান, সেটা ঠিক ঠিক কোন জায়গায় যায়, এ-মূর্খ সে-বাবদে বিশেষজ্ঞ নয়। ঈশ্বর সুকুমার রায় তার একটি কবিতাতে, উপবেশন কী করে করতে হয়, সে সম্বন্ধে লিখতে গিয়ে বলেছেন,