কিন্তু এহ বাহ্য। সমাজবিদের কান খাড়া হবে শেষ তত্ত্ব এবং তথ্যটি শুনে। লন্ডনি যত টাকা নিয়েই গ্রামে ফিরুক না কেন, জমিদার মিরাশদারের (যদ্যপি এখন আর জমিদারি নেই) বৈঠকখানায় শব্দার্থে এখনও তারা কলকে পায় না। অথচ তারা জাতে উঠতে চায়। তাই তারা হন্যে হয়ে উঠেছে সদরে, মহকুমা টাউনে বাড়ি কিনতে। সেখানে কে কার খোঁজ নেয়? এক বা দু পুরুষে সবাই ভুলে যাবে তাদের উৎপত্তি, পেশা, জন্মস্থল। ফলে সিলেট শহরে যে-বাড়ির দাম পাঁচ বছর আগে ছিল পঞ্চাশ হাজার টাকা, এখন লন্ডনি দেড় লাখ হাঁকছে। একাধিক পেনশনার ভাবছেন সিলেটের বাড়ি বিক্রি করে ওই টাকা দিয়ে ঢাকাতে ওইরকম বাড়িই যখন পাব (সিলেট জেলার বাইরে লন্ডনি বাড়ি চায় না) তখন ছেলে-নাতির পড়াশুনোর সুবিধের জন্য ক্যাপিটালে বাস করার আরও সুবিধে সেখানেই যাই না কেন? যিনি আমাকে এ-ব্যাপারটির কথা বললেন, তিনি প্রাগুক্ত ওই মছলী-কহানীও জানতেন। শেষ করলেন এই বলে– আগে প্রবাদ ছিল মাছ খাবি তো ইলিশ, লাং ধরবি তো পুলিশ, এখন হয়েছে মাছ খাবি ন মণী, লাং ধরবি লন্ডনি। কিন্তু এটা চালু হবে না। লন্ডনিরা সচ্চরিত্র।
.
০৪.
এই পর্যায়ের কীর্তনকাহিনী (সাগা)-র কালি ভালো করে শুকোবার পূর্বেই দেখি হঠাৎ আমি সিলেটিদের মাঝখানে। তবে খাস সিলেটে নয়, লন্ডনে। এবং বিরাট লন্ডনের সব কটা সিলেটি রেস্তোরাঁ চষতে হলে পুরো পাক্কা ছটি মাস লাগার কথা।
প্রথম যেটিতে গেলুম, সেটা নিতান্তই যোগাযোগের ফলে। লন্ডনে যে অ্যারপর্টে নাবলুম সেখান থেকে খাস লন্ডন নিদেন ত্রিশ মাইল দূরে। তিনজন পরিচিতের ঠিকানা নোটবুকে টোকা ছিল। এক সহৃদয় ইংরেজকে সে-তিনটে দেখিয়ে শুধালুম, সবচেয়ে কাছে পড়ে কোনটা। এক ঝলক দৃষ্টি হেনেই বলল, গঙ্গা রেস্তোরাঁ। তাই সই। গেল বছরে যখন ওর মালিক পঁচিশ বছর লন্ডনে কাটিয়ে বাপ-মাকে দেখতে দেশে আসে তখন আমাকে জোর নিমন্ত্রণ জানিয়ে বলে, তার রেস্তোরাঁ আছে, ফ্ল্যাট আছে; আমি যদি দয়া করে পদধূলি– হেঁ হেঁ হেঁ হেঁ।
কোথায় কী? আমি ভেবেছিলুম, সেই যে চল্লিশ বছর পূর্বেকার টিলবারি ডকের সিলেটি রেস্তোরাঁ- যার কাহিনী আপনাদের শুনিয়েছি সেই ধরনের গরিবগুরবোর অটলই (হোটেলের সিলেটি উচ্চারণ; তবে সিলেটিতে এ্যাকসেন্ট আছে বলে সেটা পড়বে অ-র ওপর) হবে। তবে কি না, নিতান্ত মহারানির আপন নগরের মধ্যিখানে থানা গেড়েছে যখন, তবে হয়তো দেয়াল ছাদে দু এক পলস্তরা পাউডার-রুজ মাখিয়ে নিয়েছে।
কোথায় কী? পরিপাটি ছিমছাম পশ, শিক্। বাদবাকি সবকিছু পর্যবেক্ষণ করার পূর্বেই দূর থেকে মালিক (অটলালা = হোটেলওয়ালা) আমাকে দেখতে পেয়েই ছুটে এসেছে। আউকা, আউকা; বউকা বউকা (আসুন, আসুন; বসুন, বসুন)। তার পর দিল ছুট রেস্তোরাঁর গর্ভগৃহের দিকে পরিচয় করিয়ে দেবার জন্য বউকে নিয়ে আসতে।
টেবিল-ক্লথ, ন্যাপকিন মুরমুরে পয়লা নম্বরি আইরিশ লিনেনের, ফুলদানিতে যেন বাগান থেকে সদ্য তোলা, শিশির-ভেজা গোলাপ, ছুরি কাঁটা তথা যাবতীয় কাটলারি যেন মোগল আমলের খাঁটি রুপোর, আর গেলাস-বৌল এমনই স্বচ্ছ যে ভয় হল যে দুর্যোধনের মতো স্ফটিককে জল ভেবে, আমিও এগুলোর দু একটা দেখতে না পেয়ে ভেঙে ফেলি!
ডানদিকে কাচে ঘেরা একটি চৌকো কুঠরি। ভিতরে সারি সারি শেলফে সাজানো দুনিয়ার খাসা খাসা মদ্যাদি। বোতলের আকার-প্রকার রঙ-লেবেল দেখেই বোঝা যায়। কুঠরির। মাঝখানে দাঁড়িয়ে একটি খাপসুরৎ জোয়ান ছোকরা ন্যাপকিন দিয়ে ওয়াইন শ্যামপেন; বিয়ার-মাগ সাফসুতরো করছিল এবং মাঝে মাঝে আমার দিকে আড়নয়নে তাকাচ্ছিল। ছোকরার মুখের আদল, দেহের গঠন সিলেটির মতো। কিন্তু রঙটা? গোরাদের মতো ফর্সা নয়, আবার সিলেটির মতো শ্যাম-হলদেও নয়। সমাধান কিন্তু সহজ। গলা বাড়িয়ে সিলেটিতে শুধোলুম, ভাই সাহেব, আপনার দেশ কোথায়?
গোটা কয়েক গেলাস ভেঙে ফেলেছিল আর কি! গলার আওয়াজ হোঁচট খেতে খেতে, খাবি খেয়ে খেয়ে, পড়িমরি হয়ে বলল, জি, জি, জি; আমি সিলেটের ফেচুগঞ্জের।… এখানে যারা কাজ-কাম করে সবাই সিলেটি। (আমরা মারওয়াড়িদের দোষ দিই; তারা শুধু দেশের ভাইয়াদেরই চাকরি দেয়। সমস্যাটার সমাধান এখনও করতে পারিনি।)
ইতোমধ্যে মালিক এসে গেছেন। তাঁর গৃহিণীর– মেমসাহেবার প্রথম কথা কটি শুনেই আমার মনে সন্দেহ হল, যদিও এর ইংরেজি উচ্চারণ উত্তম– অন্তত আমার চেয়ে ভালো– তবু ইনি বোধহয় কন্টিনেনটাল। ভারি মিষ্টি স্বভাবের, লাজুক, স্বল্পভাষী রমণী। মালিকের মাথায় হঠাৎ কী যেন আচমকা ভাবোদয় হল। বলল, আপনি তো একদা জর্মনিতে পড়াশুনো করেছিলেন; এখনও নাকি ওই দেশের ভাষা বলতে পারেন। ইনি (বউয়ের দিকে তাকিয়ে) খাঁটি জর্মন।।
এ্যাতক্ষ্যাণ ব্যাললেই হত। মেমও সঙ্গে সঙ্গে জর্মন বলতে আরম্ভ করল। ওর উচ্চারণ থেকে মনে হল সে ভুরুটেবের্গ প্রদেশের মেয়ে।
সোমদেবের চরম কৃপাই বলতে হবে! যে প্লেনে জরমনি থেকে লন্ডন এসেছিলুম সেটাতে ওই ভরটেমূবের্গ প্রদেশের মোলায়েম ওয়াইন সস্তায় বিক্রি হচ্ছিল। লন্ডনে পৌঁছে শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে ডেরা পাব তা তো জানিনে। যদি-স্যাৎ কাজে লেগে যায়। তাই এক বোতল কিনে নিয়েছিলুম। আর যাবে কোথা! এক কোণে উঁই করে রাখা লাগেজ থেকে বোতলটি বের করে ম্যাডামের সামনে রেখে বললুম, এই নিন। সুম ভোল জাইন, আ ভত্র সতেহিয়ার ইজ টু ইউ –এসব তান্ত্রিক মন্ত্রের অর্থ আমি এখনও সঠিক জানিনে। তবে মোটামুটি দাঁড়ায় ইটি পান করে আপনার স্বাস্থ্যের উন্নতি হোক, আপনার সর্বমঙ্গল হোক ইত্যাদি। উভয় পক্ষ উভয়ের একই মঙ্গল কামনা করেন। মদ্যপান করে স্বাস্থ্যের উন্নতি হয় কি না জানিনে গত যুদ্ধে ফ্রানস হেরে যাওয়ার পর প্রেসিডেন্ট পেতা যখন প্রথম বক্তৃতা দেন, তখন তিনি বলেন, অত্যধিক মদ্যপান হেতু ফরাসি সেপাই ঠিকমতো লড়তে পারেনি– কিন্তু এটাই রেওয়াজ এবং ম্যাডামের চোখ ছল ছল করে উঠল। কোথাকার কোন ইন্ডিয়ান– তার দেশের জিনিস, এ স্থলে প্রতীক বলতে হবে, এনেছে। এটা কি কম কথা! ভাবুন, আপনি নিউজিল্যান্ড বা ওসলোতে। সেখানে কেউ নিয়ে এল আপনার জন্য পাটিসাপটা ক্ষীরের মালপো দেদো সন্দেশ! তদুপরি সে বাঙালি নয়।