.
০৩.
অ ভাই, জলদি আও, বেটিয়ে ডাকে।
একদম ন সিকে খাঁটি সিলেটি উচ্চারণ। অবশ্য আমি খুব-একটা হকচকিয়ে উঠিনি, কারণ ঢাকার অ্যার-পরুটে হরহামেশাই সিলেটি উচ্চারণ শোনা যায়। কিন্তু যে প্রৌঢ় লোকটি এই মধুর আহ্বান শোনালেন, তার পরনে দেখি উত্তম বিলিতি কাট-এ অত্যুত্তম ১০০% বিলিতি উলের নেভি ব্লু স্যুট। ওদিকে গলকম্বল মানমুনিয়া চাপদাড়ি। যাকে ডাকছিলেন তারও ওই বেশ, তবে বয়সে যুবক। কিন্তু ওই বেটিয়ে ডাকে অর্থাৎ মেয়েছেলে ডাকছে–এর বিগলিতার্থটা কী? তখন অ্যার-পরূটের প্রধান লাউজে ঢুকে দেখি একপাল লোক; প্রায় সক্কলেরই পরনে একই ধরনের নেভি ব্লু স্যুট। বুঝে গেলুম এরা লনডনি। বাড়িতে এসে দাদাকে তাবৎ হালত বয়ান করলুম। দাদা বলল, লনডনিরা ঈদের পরবে প্লেন চার্টার করে দেশে যায়। সে ঢাউস প্লেন সিলেটে নামতে পারে না বলে ঢাকা অবধি এসে থেমে যায়। তার পর সাধারণ সারভিসে আপন আপন মোকামে যায়। শ্রীমঙ্গল, শমসের নগরের মতো ছোট ছোট জায়গায়ও প্রধানত এদেরই জন্য অ্যার স্ট্রিপ করা হয়েছে। আর ওই যে চাপদাড়ি-ওলা লোকটাকে দেখলি সে খুব সম্ভব লনডনিদের বিলেতের মসজিদের ইমাম। এ-ই এদের বিলেত থেকে আপন আপন মোকাম অবধি দেখ-ভাল করে পৌঁছিয়ে দেয়। এদেরই একজন বোধহয় ছিটকে পড়েছিল; ইতোমধ্যে তরুণী এনাউনসার মাইকে বলেছে সিলেটগামী প্লেন এখখুনি ছাড়বে। তাই ইমাম হাঁকছিল, বেটিয়ে ডাকে, জলদি আও। সিলেটি মাত্রই জানেন, সে-ভাষায় বেটি ঠিক দুহিতা বা মেয়েছেলে নয়। বরঞ্চ মেয়েমানুষ এমনকি মাগি অর্থেও ধরে। পশ্চিমবঙ্গে যখন কেউ বলে বেটির কাণ্ড দেখ! তখন যে অর্থ ধরে। এখন পাঠক বুঝুন, সেই খাবসুরৎ তরুণীকে বেটি বললে কোন রস সৃষ্ট হয়।
লনডনিরা প্রতি বছর সিলেটে কত টাকা পাঠায় তার হিসাব কেউ দিতে পারে না। কারণ এরা কালোবাজারে খুব ভালো রেট পায় বলে এদের পাঠানো টাকার খুব বড় একটা হিস্যের কোনও সন্ধানই কেউ জানে না। শুনেছি কোনও এক বিশেষ সম্প্রদায়ের লোক কালোবাজারে লন্ডনিদের কাছ থেকে পাউন্ড কিনে তাদের নারায়ণগঞ্জস্থ আপন পাট গুদাম জুট মিলকে কোড-এ হুকুম দেয়। অমুক সিলেটিকে অত টাকা পাঠাবে। আরও শুনেছি, তার পর ওই পাউন্ড দিয়ে বিলিতি জিনিস কিনে, কিছুটা আইনত, বেশিরভাগ কালোয় প্রাচ্যে পাচার করে।
কত টাকা লনডনিরা পাঠায় তার হিসাব না জানা থাকলেও সিলেট জেলাতে সে টাকার সুদূরপ্রসারী গভীর প্রভাব সর্ব সিলেটির চোখে যেন ঘুষি মেরে আপন মাহাত্ম অহরহ প্রচার করে। সস্তা সেকেনহ্যানড বিদেশি ট্রানজিসটার, পারকার কলম, ক্যামেরা ইত্যাদির কথা বাদ দিচ্ছি– একমাত্র সিলেট শহরেই নাকি গণ্ডা দুই সরকার কর্তৃক স্বীকৃত ট্রাভেল এজেন্সি আছে– কল্পনা করতে পারেন এ-জিনিস বর্ধমানে? মহকুমা শহরের কথা বাদ দিন, বড় বড় থানায় বিশেষত যেসব পকেটে লনডনিদের আদি নিবাস পর্যন্ত বড় বড় ব্যাঙ্কের ব্রাঞ্চ আপিস খোলা হয়েছে। আর ডাকঘরের তো কথাই নেই। যে-ডাকঘরে দিনে তিনখানা চিঠিও আসে কি না, সেখানে আসে পাঁচশো-হাজার টাকার মনিঅরডার। কিন্তু এহ বাহ্য। যে সিলেট শহরের বন্দর-বাজারে মাছের কখনও অভাব হয়নি সেই বাজারে দর আগুন এবং শৌখিন মাছ বিরল। আমার এক মুরুব্বি বললেন, আসবে কোত্থেকে? লন্ডনির পাঠানো টাকাতে এখন গাঁয়ের লোক মাছ খায়। জেলে তকলিফ বরদাস্ত করে শহরে আসবে কেন। বললে প্রত্যয় যাবে কি, পাঁচখানা গাঁয়ের মাঝখানে যে-হাট, সেটা এই কয়েক বছর আগে পর্যন্ত বসত সপ্তাহে একদিন একবেলা। এখন বসে রোজ, প্রতিদিন, দু বেলা।
এটা আবার কনফারম করল আমার এক বোন। গাঁয়ের জমিদারবাড়িতে তার বিয়ে হয়েছে এবং লন্ডনিরা যখন দেশে আসে তখন প্রায়ই ব্যাঙ্কের চিঠিপত্রাদি পড়াবার জন্য জমিদারবাড়িতে আসে। বোন বলল, এক লন্ডনি দেশে এসেছে ঈদ করতে। মাছ কিনতে গেছে ভিন গাঁয়ের হাটে। একটা ভালো মাছ দেখে দাম শুধাল। জেলে বলল ওটা বিক্রি হয়ে গিয়েছে। সেটা কিনেছে ওই গাঁয়েরই এক লন্ডনি, এবং দুই গাঁয়ে দারুণ আড়াআড়ি। ভিন গায়ের লন্ডনির এক দোস্ত প্রথম লন্ডনিকে খোঁচা দিয়ে যা বলল তার অর্থ তোমাদের গায়ে এ-মাছ খাবার মতো রেস্ত আছে কার? প্রথম লন্ডনি বড় নিরীহ, কোনও উত্তর দিল না। কিন্তু তার গায়ের সঙ্গী-সাথীরা চটে গিয়ে তাকে বলল, আল্লার কসম, এই, এই মাছটাই তোকে কিনতে হবে। তখন মাছ চড়ল নিলামে। দশ, বিশ, শ, দু শো চড়চড় করে চড়ে গেল। কবিগুরুর ভাষা একটু বদলালে দাঁড়ায়,
দশ মাষা দিব আমি
কহিলা লনডন-ধামী,
বিশ মাষা অন্য জনে কয়।
দোঁহে কহে দেহো দেহো,
হার নাহি মানে কেহ–
মূল্য বেড়ে ওঠে ক্রমাগত।
আমার বোনটি অতিরঞ্জনে অভ্যস্ত নয়। শেষটায় বলল, আখেরে মাছটা বিক্রি হল এক হাজার এক টাকা মূল্যে। কিনল প্রথম লন্ডনি। এবং আশ্চর্য নগদ টাকা তার ওয়াকিটের পকেট থেকেই বের করল। তার পর বিজয়ী মাছটাকে নিয়ে প্রসেশন করে গ্রামে এসে আপন গাঁ প্রদক্ষিণ করল। বিস্তর জিন্দাবাদ জিগিরের পর মাছটাকে ব্লেড দিয়ে প্রায় ডাকটিকিটের সাইজে টুকরো টুকরো করে গায়ের সব্বাইকে বিলোলো। এখন এরা হাটে গিয়ে দেমাক করে, আজার টেকি (হাজার টাকা দামের) মাছ খাই আমরা।