চোক্কোরো। ও-কথা তুললে আম্মর-উল্লা ভ্যাক করে কেঁদে ফেলবে।
শুধু কি তাই! বিদায় নেবার সময় ডোরা দোস্ত শশাঙ্কের হাতে তুলে দিল একটা বাস্কেট। পথে নেমে সেটাকে প্রিয়ার গণ্ডদেশে হাত বুলোবার মতো আদর করতে করতে বলল, তিন দিনের দু বেলার আহারাদি হে দোস্তো দু জনার তিনজনারও হতে পারে।
.
০২.
ঠিক কোন সময়ে হিন্দুরা সমদ্রযাত্রা বন্ধ করেন ঠিক বলা যায় না। তবে এর ফল যে বিষময় হয়েছিল সে-বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। এই চট্টগ্রাম এবং সিলেটের (সিলেট সমুদ্রতীরবর্তী নয়, কিন্তু সিলেটে বিরাট বিরাট হাওর থাকায় মাঝিরা অন্ধকারে তারা দেখে নৌকা চালাতে পারে– লিন্ডসে সাহেব গত শতাব্দীর গোড়ার দিকে কম্পাসের সাহায্যে একাধিক হাওর পেরিয়ে চাল-ভর্তি মহাজনি নৌকা মাদ্রাজ পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছিলেন এবং সি-সিকনেস তাদের হয় না) লক্ষ লক্ষ ব্যবসায়ী মাঝিমাল্লা অন্নহীন হয়ে যায়। এর পর আরব বণিকরা সমুদ্রপথে চট্টগ্রামে ব্যবসা করতে এলে এরা প্রধানত পেটের দায়ে মুসলমান হয়ে গোড়ার দিকে আরব জাহাজে খালাসির চাকরি নিয়ে পূর্বে ইন্দোনেশিয়া ও পশ্চিমে জেদ্দা, সুয়েজ বন্দর অবধি পাড়ি দেয়। কিছুদিনের মধ্যেই চট্টগ্রামের সদাগর সম্প্রদায় আপন আপন পালের জাহাজ নির্মাণ করে বর্মা মালয়ের সঙ্গে ব্যবসা চালাতে থাকে এবং এ শতাব্দীর প্রথম দশক পর্যন্ত ইংরেজের কলের জাহাজের সঙ্গে পাল্লা দেয়।
প্রধানত সিলেট, চট্টগ্রাম ও নোয়াখালির মাঝিমাল্লা চাষাভূষোই গোড়ার দিকে ইউরোপীয় জাহাজে কাজ নেয় এবং এদের খালাসি বলা হত (এ স্থলেই উল্লেখ করি সংখ্যায় প্রায় আশি হাজারের মতো যেসব সিলেটি বর্তমানে ইংলন্ডে কলকারখানায় কাজ করে শুনেছি সিলেটিদের তুলনায় পুব পাকের অন্যান্য জেলার লোকসংখ্যা নগণ্য দেশের সিলেটবাসীরা এদের নাম দিয়েছেন লন্ডনি, যদিও এদের বড় আড্ডা বোধহয় নটিংহামে)। বহু বছর ধরে খালাসিরা ডাঙায় বাসা বেঁধে কলকারখানায় ঢোকেনি। কিন্তু বেশ কিছু সংখ্যক সিলেটি কানাডা এবং যুক্তরাষ্ট্রে কলকারখানায় ঢুকে প্রচুর পয়সা কামিয়ে দেশে ফিরত– ওখানে চিরতরে বাসভূমি নির্মাণ করত না।
খালাসিবৃত্তি থেকে কবে কী করে এরা দক্ষিণ ও মধ্য ইংলন্ডের কলকারখানায় ঢুকে পড়ে লন্ডনি খেতাব পায় তার কোনও লিখিত বিবরণ আমি পড়িনি। তবে আমার মনে হয়, ১৯২৯-৩৩-এর পূর্বে নয়, কারণ এ সময়ে ইউরোপ-আমেরিকার কারখানাকর্মীদের ভিতর প্রচুরতম বেকারি। এর পরে প্রধানত যুদ্ধের সময় বিস্তর সস্তা লেবারের প্রয়োজন হল। আজ যে আপনি-আমি লন্ডন-নটিংহামের যে কোনও দ্বিতীয় শ্রেণির ইংরেজি রেস্তোরাঁতেও পাটনা রাইস এবং কারি পাচ্ছি তার গোড়াপত্তন হয় ওই সময় (পাটনা রাইস বলে বটে, কিন্তু সেটা দেরাদুন, বাসমতি সবকিছুই হতে পারে। বহু গবেষণা করে সন্ধান পেলুম কোম্পানির আমলে এ-দেশ থেকে যে-চাল বিলেত যেত সেটা প্রধানত সংগ্রহ করা হত পাটনার আড়তে যে-হরেক প্রদেশের চাল জড়ো হয়েছে তার থেকে; তাই এর অমনিবাস নাম হয়ে যায় পাটনা রাইস) সৈন্যদের এবং লন্ডনিদের ক্ষুধা নিবারণের জন্য। আজ এদেশ থেকে প্রতিদিন মণ মণ চাল, ডাল, শুঁটকি, মসলা ইত্যাদি তো যাচ্ছেই, তার ওপর হাজার হাজার বোতল আম, নেবু, জলপাইয়ের আচার। গত বছর সিলেটে এক বিরাট আচার ফ্যাকটরি দেখে আমি স্তম্ভিত। পরে সে কারখানার অমায়িক মালিকের সঙ্গে দেখা হলে তিনি বললেন, যা তৈরি হয় তার প্রায় বেবাক মাল চলে যায় লন্ডনিদের খেদমতে। চাহিদাও বেড়ে চলেছে। আমি পেরে উঠছি না। অবশ্য আমি জানতুম, মালদার ম্যাংগো স্লাইজ এবং মিষ্টি-টক (সুইট-সাওয়ার) আমের আচারের এক বৃহৎ অংশ লন্ডনিদের তরেই যায়। কারণ সিলেটের আম জঘন্য। তার থেকে ভালো আচার হয় না– স্লাইস মাথায় থাকুন। অবশ্য সিলেট থেকে সর্বোকৃষ্ট আনারস-স্লাইস বিলেত যায়। মার্কিন হাইনস ফিফটি সেভনের (বা অন্য সংখ্যাও হতে পারে) মতো সিলেটি আচার কারখানা ৪৭ রকমের আচার, স্লাইস ইত্যাদি তৈরি করে। বুঝুন, যে সিলেটি দেশে ভাত, লাল লঙ্কা পেষা, আর কিস্যুৎ নিতান্তই মেহেরবান হলে একটি কাঁচা প্যাজ খেত– তা-ও দুবেলা নয় এবং সে-ও পেট ভরে নয়– সে কি না আজ সিলেটের জমিদার-ছেলেরও যা জোটে না বিলেতে বসে তাই খায়। এস্তেক পান-তক। পান যায়। প্লেনে। তাই নাকি একটা খিলির দাম সি পেন্স থেকে এক শিলিং
সিলেটিরা বিলেতে চাকরি পায় কেন? কাগজে নিশ্চয়ই পড়েছেন, সাদা আর কালো মজুরে সেখানে নিত্য লড়াই। আমি এ-বিষয়ে সরেজমিন তদন্ত-তাবাশ করিনি। যা শুনেছি, তাই বলছি : (১) কালোরা– বিশেষ করে সিলেটিরা কম মাইনেতে কাজ করতে রাজি; নিগ্রোরা মদ খায়, জুয়া খেলে বলে তাদের খাই বেশি। (২) দুই শিফটে এবং রবিবারেও কাজ করতে রাজি নিগ্রোরা খ্রিস্টান, রবিবারে সাবাৎ মানে। (৩) ইউনিয়ন এড়িয়ে চলে, স্ট্রাইক করতে চায় না। (৪) রাতভর মদ খেয়ে পরের দিন বেহুশ হয়ে পড়ে থাকে না বলে কাজকর্মে কামাই দেয় কম।
এই সিলেটিরা অনেকেই মেম বিয়ে করে ওদের একটা দু আঁসলা সমাজ গড়ে তুলেছে এবং ঘটকালি করে এই মেমেরা নবাগত সিলেটিকে তাদের বোন-ভাগ্নী বিয়ে দেবার জন্য। বোন-ভাগ্নীও লন্ডনির বউয়ের কাছ থেকে জেনে গিয়েছে (১) সিলেটি মদ খেয়ে মাতাল হয়ে বউকে ঠ্যাঙায় না, (২) ঘোড়ার রেস, কুকুরের রেস, এমনকি কড়ি খর্চা করে ফুটবল খেলা দেখতে যায় না, মদে পয়সা ওড়ায় না এবং কোনওপ্রকারের জুয়োও খেলে না বলে বউ স্বচ্ছন্দে সংসার চালাবার জন্য স্বামীর মাইনের একটা বড় হিস্যে পায়। বিয়ের পূর্বে বা পরে সে অন্য মেয়ের সঙ্গে পরকীয়া করে না– সে তো ধলা মেম পেয়েই খুশ! এ দুটো সেকুরিটি পৃথিবীর সর্বত্রই রমণীমাত্রই খোঁজে। এবং কেউ কেউ তৃতীয় সেকুরিটিও দিতে পারে– আপন পয়সায় কোনও নিজস্ব কটেজ। আমার পরিচিত এক চৌধুরীর ছেলে তো নটিংহামে তিনখানা চেন, হোটেল-রেস্তোরাঁর মালিক (আজকাল সিলেটি মুসলমানদের উচ্চশ্রেণির লোকও নানা ধান্দায় লন্ডনি হচ্ছেন)। তিনি তো অনায়াসে তৃতীয় সেকুরিটি দিতে পারেন। এছাড়া ছোটখাটো আরও অনেক আরাম-আয়েস আছে। বাচ্চা রাত্রে কেঁদে খাস-সায়েব মজুরের ঘুম ভাঙালে সে ধমক দিয়ে বউকে বাচ্চাসহ রান্নাঘরে খেদায়; লন্ডনি গায়ে পড়ে বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে ঠাণ্ডা করে। দেশে ছেলেবেলা থেকেই সে কত ভাতিজা ভাতিজি ঠাণ্ডা করেছে।… পাব-এ যায় না বলে প্রায়ই তার ফুরসত থাকে এবং বউকে প্রেম। করে বলে প্র্যাম-এ করে বাচ্চাকে হাওয়াভি খাওয়ায়।