রবীন্দ্রনাথ লন্ডনে এসেছেন শুনে তাকে প্রণাম জানিয়ে যখন রাস্তায় নেমেছি তখন হঠাৎ এক সিলেটি দোস্তের সঙ্গে মোলাকাত। আলিঙ্গন কুশলাদির পর দোস্ত শুধাল, অত রোগা কেন? একে দুর্দান্ত শীত, তদুপরি লন্ডনের গুষ্টির-পিণ্ডি-চটকানো রান্না। সংক্ষেপে বলল, চল। এতদিন পরে সব ঘটনা আর মনে নেই তবে বাসে করে যে অনেকখানি পথ যেতে হয়েছিল সেটা স্পষ্ট মনে আছে। মোকামে পৌঁছে ভালো করে বেয়ারিং পাবার পূর্বেই দেখি, একটি ছোটখাটো রেস্তোরাঁর মাঝখানে আমি দাঁড়িয়ে এবং কানে গেল পূর্বোক্ত অ ডুরা– ইত্যাদি, যার অর্থ, ও ভোরা, কোণের সাহেবকে আরেক বাটি ঝোল দাও।
হালে কাগজে পড়লুম, বিলেতে যেসব পাক-ভারতের রেস্তোরাঁ আছে তার শতকরা ৮০ ভাগ সিলেটিরা চালায়। অবশ্য ওই চল্লিশ বছর পূর্বে বিলেতে অত ঝাঁকে ঝাঁকে পাক ভারতীয় রেস্তোরাঁ ছিল না; তবে সে-রাত্রেই জানতে পাই, যে-কয়টি আছে পনেরো আনা সিলেটিদের। এমনকি লন্ডনের নামকরা হতচ্ছাড়া তালু-পোড়া দামের এক ভারতীয় রেস্তোরাঁর শেফও সিলেটি।
ইতোমধ্যে দোস্ত শশাঙ্কমোহন অটলালার (হোটেলওয়ালার) সঙ্গে বে-এক্তেয়ার গালগল্প জুড়ে দিয়েছেন– আহা, যেন বহু যুগের ওপার হতে লঙ লসট ভ্রাতৃদ্বয়ের পুনর্মিলন। শশাঙ্ক আমাকে অটলালার পাশের একটা টেবিলের কাছে বসবার ইঙ্গিত দিয়ে আবার তার ভ্যাচর ভ্যাচরে ফিরে গেল। একটা দরজা খুলে যেতে দেখি বেরিয়ে এল একটি প্রাপ্তবয়স্কা মেম। হাতের ট্রের উপর রাইস, কারি, ডাল, ভাজাভুজি। আমাদের দিকে নজর যেতেই মৃদুহাস্য করে গুড ইভনিং বলে বয়সের তুলনায় অতি স্মার্ট পদক্ষেপে গটগট করে প্রথম অন্যান্য খদ্দেরদের রাইসকার্যাদি দিয়ে সর্বশেষে কোণের সাহেবের টেবিলের উপর তার ছালনের কট্রা রাখল। ইনিই তা হলে ডোরা।… জনা আষ্টেক খালাসি পরম পরিতৃপ্তি সহকারে সশব্দে, ছুরি-কাটার তোয়াক্কা না করে খেয়ে চলেছে। আরও দু জন গোরা একান্তে বসে ওই খাদ্যই রসিয়ে রসিয়ে উপভোগ করছে। ডোরা ফিরে আসতে অটলালা তার ক্যাশ ছেড়ে এল। আমরা চারজন এক টেবিলে বসলুম। অটলালা সঙ্গে সঙ্গে বলল, আমরা তো বেশি পদ রাঁধি না– আমাদের গাহক তো সবই খালাসি, দু একজন গোরা মাঝেমধ্যে। কিন্তু আপনারা অতদূর থেকে মেহেরবানি করে এসেছেন। ভালোমন্দ কিছু করতে হয়। আমাদের আপত্তি না শুনে দুজনা রান্নাঘরে চলে গেল। শশাঙ্ক বলল, আশ্চর্য, কুড়ি বছর হয়ে গেল এই আম্বরউল্লা এ-দেশে আছে, তবু একবর্ণ ইংরেজি শিখতে পারেনি। ওদিকে ওর বউ ভোরা দিব্যি সিলেটি বলতে পারে। খালাসি গোরা সব খদ্দের ও-ই সামলায়। তবে ওর ইংরেজি বোঝাটাও চাট্টিখানি কথা নয়। একদম খাস খানদানি কনি। আমি শুধালুম, বিয়েটা– মানে সিলেটি খালাসি আর লন্ডনি মেমেতে হল কী প্রকারে? কেন হবে না? তুমি কি ভেবেছ ডোরা কোনও অক্সফড ডন-এর মেয়ে এবং কেমব্রিজের রেঙলার? আর হ কথাই যদি কই, তবে বলি, সামাজিক পদমর্যাদায় আম্বর মিয়া তার মাদামের চেয়ে ঢের ঢের সরেস। মিয়া চাষির ছেলে আর ডোরা মুচির মেয়ে। অবশ্য ভোরার মতো লক্ষ্মী মেয়ে শতকে গোটেক। আমাদের যে কী আদর করে, পরে দেখতে পাবে। আর এমন সময় আম্বর মিয়া সহাস্য আস্যে প্রত্যাবর্তন করে বলল, আমাদের সুখদুঃখের কথাতে মাঝে মাঝে বাধা পড়বে, স্যর। ডোরাই খদ্দেরদের কাছ থেকে হিসেবের কড়ি তোলে। এখন রাঁধছে। ওটা আমাকে সামলাতে হবে। আমি ভয় পেয়ে মনে মনে বললুম, মেমের হাতের রান্নায় আবার সেই লাঞ্ছনা আবার সেই সাফার! আমরা তো গাঁটের রোক্কা সিক্কা ঝেড়ে হেথায় পৌঁছলুম, আর ওই হতভাগ্য লন্ডনি লাঞ্ছনা-সাফার কোত্থেকে বাস-ভাড়া জোগাড় করে আমাদের পিছনে ধাওয়া করল? প্রকাশ্যে রোস্টোমোস্টো রাঁধবে নাকি?
হেসে বলল, তা-ও কি কখনও হয়, স্যর। রাঁধবে খাঁটি সিলেটি রান্না।
শিখল কার কাছ থেকে?
আমার কাছ থেকে সামান্যই, কিন্তু আমার গাহক খালাসি-ভাইদের ভিতর প্রায়ই বাঢ়িয়া বাঢ়িয়া বাবুর্চি থাকেন। তাঁদের কাছ থেকে সিলেটের পোশাকি খানা থেকে মামুলি ঝোল-ভাত সবকিছু শিখে নিয়েছে। এমন সময় কোণের গোরা রান্নাঘরের দরজার দিকে তাকিয়ে সামান্য গলা চড়িয়ে বলল, ও মিসিস উল্লা আজকের কারিটাতে একদম ঝাল নেই। দুটো গ্রিন চিলি– সরি– সে তো,এই গড ড্যাম দেশে নেই। তা হলে একটু টাবাস্কো চিলি সস্ দাও না। বলে কী ব্যাটা! ডোরা যখন রাইস-কারি নিয়ে যাচ্ছিল, তখন সে-কারির কটকটে লাল রঙ দেখে আঁতকে উঠে আমার মতো খাস সিলটাও মনস্থির করেছিল ওই বস্তু কম মেকদারে খেতে হবে– চাটনির মতো, আ লা চাটনি। আর এ-গোরা হট, হট, ডবল হট মাদ্রাজি আচার দিয়ে তার ঝোলের ঝাল বাড়াল।… একে একে, দুয়ে তিনে সব খদ্দের কড়ি গুনে চলে গেল। আমার চোখে একটুখানি ধাঁধার ভাব দেখে বলল, ঠিক ধরেছেন, স্যর। সক্কলের জেবে কি আর রেস্ত থাকে? ইনশাল্লা, দিয়ে দেবে কোনও এক খেপে। আর নাই বা দিলে।
আমরা খেয়েছিলুম, বেগুন-ভাজা, মুড়িঘন্ট, মটরপোলাও, মাছ ভাজা, মুরগি কারি– বাকি মনে নেই। অসম্ভব সুন্দর রান্না। কিন্তু আর শুধোবেন না। আহারাদির আলোচনা আরম্ভ হলে আমার আর কাণ্ডজ্ঞান থাকে না। রাতও তখন অনেক। মোকা পেয়ে শশাঙ্ককে কানে। কানে বললুম, বিল?