কিন্তু প্রশ্ন, গবেট শিষ্য কিঞ্চিৎ ব্যাকরণ জানত বলে ওই বিষয়ে পড়াতে তার বাধোবাধো ঠেকত। পিথৌরার কি সেরকম কোনওকিছু আছে?
সেই তো বেদনা, সুশীল পাঠক, সেই তো ব্যথা।
মা সরস্বতী সম্বন্ধে কোনও কিছু লিখতে বড় বাধো-বাধো ঠেকে। চতুর্দিকে গণ্ডা গণ্ডা সরস্বতী পূজা হয়ে গেল। আমি গা-ঢাকা দিয়ে, কিংবা পালিয়ে পালিয়ে বেড়িয়েছি।
আর কোনও দেবতার সেবা করার মতো সুবুদ্ধি আমার হয়নি– প্রথমজীবনে মা সরস্বতীই আমার স্কন্ধে ভর করেছিলেন, আর আমি হতভাগা তার সেবাটা কায়মনোবাক্যে করিনি বলে আজ আমার সবকিছু ভণ্ডুল বরবাদ হয়ে গিয়েছে। এখন মা সরস্বতীর দিকে মুখ তুলে তাকাতেও ভয় করে। হায়, দেবীর দয়া পির্থেীরার প্রতি হয়েছিল, কিন্তু মৃর্থ তাঁকে অবহেলা করে আজ এই নিদারুণ অবস্থায় পড়েছে। —–রায় পিথৌরা
.
০২.
দিল্লির বিখ্যাত সাধু নিজামউদ্দীন আওলিয়ার প্রখ্যাত সখা এবং শিষ্য কবি আমির খুসরৌর জন্মোৎসব কয়েক দিন হল আরম্ভ হয়েছে। আমির খুসরৌর কবর নিজামউদ্দীনের দরগার ভিতরেই– এবং সে দরগা হুমায়ুনের কবরের ঠিক সামনেই। (এ দর্গায় আরও বহু বিখ্যাত ব্যক্তির কবর আছে।)
খুসরৌর পিতা ইরানের বখ (সংস্কৃত বহীকম– ভারতীয় কোনও কোনও নৃপতি বখ পর্যন্ত রাজ্যবিস্তার করেছিলেন বলে কিংবদন্তি আছে) থেকে ভারতবর্ষে আসেন। পুত্র খুসরৌ কবিরূপে দিল্লির বাদশাহদের কাছে প্রচুর সম্মান পান।
ফারসি তখন বহুদেশের রাষ্ট্রভাষা। উত্তর ভারতবর্ষ (ফার্সি এদেশের ভাষা নয়), আফগানিস্তান (সে দেশেরও দেশজ ভাষা পশতু), তুর্কিস্তান (তারও ভাষা চুগতাই) এবং খাস ইরানে তখন ফার্সির জয়-জয়কার। এমনকি বাঙলা দেশের এক স্বাধীন নৃপ হাফিজকে বাঙলা দেশে নিমন্ত্রণ করেছিলেন।
খুসরৌ ফার্সিতে অত্যুত্তম কাব্য সৃষ্টি করে গিয়েছিলেন। ভারতের বাইরে, বিশেষ করে কাবুল-কান্দাহার এবং সমরকন্দ-বোখারা খুসরৌকে এখনও মাথার মণি করে রেখেছে।
আলাউদ্দীন খিলজী, তার ছেলে খিজর খান; বাদশা গিয়াসউদ্দীন তুগলুক, তাঁর ছেলে বাদশা মুহম্মদ তুগলুক (ইংরেজ ঐতিহাসিকদের পাগলা রাজা) এরা সবাই খুসরৌকে খিলাত ইনাম দিয়ে বিস্তর সম্মান দেখিয়েছেন।
গুজরাতের রাজা কর্ণের মেয়ে যখন দিল্লি এলেন তখন তার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে রাজকুমার খিজর খান তাকে বিয়ে করেন। ইংরেজের মুখে শুনেছি, বিয়ে নাকি প্রেমের গোরস্তান, অর্থাৎ বিয়ে হওয়ার পরই নাকি সর্বপ্রকারের রোমানস্ হাওয়া হয়ে যায়। এখানে হল ঠিক তার উল্টো। এদের ভিতর যে প্রেম হল সে প্রেম পাঠান-মোগল হারেমের গতানুগতিক বস্তু নয়– তাই অনুপ্রাণিত হয়ে খুসরৌ তাঁদের প্রেমকাহিনী কাব্যে অজর অমর করে দিলেন। সেই কাব্যের নাম ইশকিয়া–বাঙলা ভ্রমণের সময় সম্রাট আকবর সেই কাব্য শুনে বার বার প্রশংসা করেছিলেন। কর্ণের মেয়ের নাম দেবতাদেবী। শুনেছি, বাঙলায় নাকি দেবলাদেবী নাটক বহুদিন ধরে অভিনীত হয়েছে।
গিয়াসউদ্দীন তুগলুক নিজামউদ্দীনকে দু চোখে দেখতে পারতেন না। সে কাহিনী দৃষ্টিপাতে সালঙ্কার বর্ণিত হয়েছে- দিল্লি দূর অস্ত! কিন্তু গিয়াস নিজামের মিত্র খুসরৌকে রাজসম্মান দিয়েছিলেন। খুসরৌ বড় বিপদে পড়েছিলেন, একদিকে সখার ওপর বাদশাহি জুলুম, অন্যদিকে তিনি পাচ্ছেন রাজসম্মান।
মুহম্মদ তুগলক রাজা হওয়ার পর তাবৎ মুশকিল আসান হয়ে গেল। ঠিক মনে নেই (পোড়ার শহর দিল্লি একখানা বই পাইনে যে অর্ধবিস্মৃত সামান্য জ্ঞানটুকু ঝালিয়ে নেব), বোধহয় খুসরৌ বাদশা মুহম্মদের লাইব্রেরিয়ান ছিলেন।
সে এক অপূর্ব যুগ গেছে। সাধক নিজামউদ্দীন, সুপণ্ডিত বাদশা মুহম্মদ তুগলুক, ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দীন বরনী এবং সভাকবি আমির খুসরৌ।
প্রথম দেহত্যাগ করলেন শেখ-উল-মশাইখ নিজামউদ্দীন আওলিয়া, তার পর তাঁর প্রিয়সখা আমির খুসরৌ, তার পর বাদশা মুহম্মদ শাহ তুগলুক এবং সর্বশেষে জিয়া বরনী।
ইংরেজ আমাদের কত ভুল শিখিয়েছে। তার-ই একটা, এসব গুণীরা ফার্সিতে লিখতেন বলে এঁরা এদেশকে ভালোবাসতেন না। বটে? সরোজিনী নাইডু ইংরেজিতে লিখতেন, তাই তিনি ভারতবর্ষকে ভালোবাসতেন না!
খুসরৌ মাতৃভূমি ভারতবর্ষ ভালোবাসতেন এবং সে ভূমির অশেষ গুণকীর্তন করে গিয়েছেন।
এবং দূরদৃষ্টি ছিল বলে তিনি যেটুকু দেশজ হিন্দি জানতেন (হিন্দিরও তখন শৈশবাবস্থা) তাই দিয়ে হিন্দিতে কবিতা লিখে গিয়েছেন।
শুধু তাই নয়, ফার্সি এবং হিন্দি মিলিয়ে তিনি উর্দুর গোড়াপত্তন করে গিয়েছেন– জানতেন একদিন সে ভাষা রূপ নেবেই নেবে।
আবার বিপদে পড়লুম; হাতের কাছে বই নেই, তাই চেক আপ করতে পারছিনে– পণ্ডিত পাঠক অপরাধ নেবেন না– যেটুকু মনে আছে, নিবেদন করছি–
হিন্দু বাচ্চেরা ব নিগরু আজ হুসন্ ধরত হৈ
দর ওকতে সুখ জদ মুহ ফুল ঝরত হৈ
গুফতম কে বি আ আজ লবেৎ বোসে বিগরিম–
গুফত আরে রাম! ধরম নষ্ট করত হৈ!
হিন্দু বামা কী অপূর্ব সৌন্দর্যই না ধারণ করে,
কথা বলার সময় মুখ থেকে যেন ফুল ঝরে।
বললুম, আয় তোর ঠোঁটে চুমো খাব
বললে, আরে রাম! ধর্ম নষ্ট করত হৈ! –রায় পিথৌরা
.
০৩.
দিল্লির দুর্গাপূজা দেখবার মতো জিনিস। আমরা বুড়ো হয়ে গিয়েছি, কিন্তু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সমাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং ধর্মতাত্ত্বিক তথ্য সংগ্রহ করবার মতো বয়স, সময় এবং উৎসাহ যাদের আছে তারা যদি এখানে পূজার সময় গোটা তিনেক রোদ মেরে যান তবে নব হুতোম লিখে পৌরজনকে বিস্তর মধু পান করাতে পারবেন।