হালে শ্রীযুক্তা ইন্দিরা গান্ধী এই দ্বীপপুঞ্জটির সফরে গিয়েছিলেন। আমি আশা করেছিলুম, এই সুবাদে আমাদের দেশের ওই অংশটি সম্বন্ধে অনেক-কিছু জানতে পাব। তা জেনেছি নিশ্চয়– এঁদের বর্তমান অবস্থা সম্বন্ধে অনেক সাংবাদিক সবিস্তর বর্ণনা দিয়েছেন, কিন্তু আমার কৌতূহল ছিল এঁদের প্রাচীন ইতিহাস জানবার। সে-বাবদে যে তিমিরে সে তিমিরেই রয়ে গেলুম।
প্রথম প্রশ্ন লাক্ষাদ্বীপ কথাটার অর্থ কী? ইংরেজিতে বানান করা হয় Laccadive এবং এর শেষাংশ দীব যে দ্বীপ সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। আরবি ভাষায় প অক্ষরটি নেই বলে সে স্থলে ব বা ওয়া (অর্থাৎ ইংরেজি v অক্ষর) ব্যবহৃত হয় : তাই দীব বা দীও নিশ্চয়ই দ্বীপ। কিন্তু প্রশ্ন লাক্ষা শব্দের অর্থ কী? পণ্ডিতেরা বলেন, ওটা সংস্কৃত লক্ষ (১,০০,০০০) থেকে এসেছে। অথচ লাক্ষাদ্বীপপুঞ্জে দ্বীপের সংখ্যা মাত্র চোদ্দটি। এমনকি এই দ্বীপপুঞ্জের সংলগ্ন, মাত্র আশি মাইল দূরে অবস্থিত মালদ্বীপের (এ-এলাকা ভারতের অংশ নয়।)
চতুর্দিকে যে দ্বীপপুঞ্জ আছে তার সংখ্যাও তিন শো (এর মধ্যে মাত্র সতেরোটিতে লোকাবাস আছে এবং এদের ভাষা আরবি মিশ্রিত সিংহলি)। এই তিনশো এবং লাক্ষাদ্বীপে চৌদ্দটি (বসতি আছে সাকুল্যে তা হলে বাইশটি দ্বীপে) নিলেও তাকে লক্ষ সংখ্যায় পরিবর্তিত করতে হলে এদেরকে হাজার হাজার ডবল প্রমোশন দিতে হয়। তবে কি না, কি হিন্দু পুরাণকার কি মুসলমান পর্যটক ঐতিহাসিক গণনা করার (শুমার করার) সময় বেশকিছুটা কল্পনাশক্তির আশ্রয় নিয়ে ১০০ বা ১০০০-র পিছনে গোটা তিনেক শূন্য বসিয়ে দিতে কার্পণ্য করতেন না। এরই একটি উদাহরণ পাওয়া যায় বাঙলা দেশের কেচ্ছাসাহিত্যে : লোক মরে লক্ষ লক্ষ, কাতারে কাতার। শুমার করিয়া দেখি আড়াই হাজার। তবু এ কবিটির কিঞ্চিৎ বিবেক-বুদ্ধি ছিল। উৎসাহের তোড়ে প্রথম ছত্রে লক্ষ লক্ষ বলে শেষটায় মাথা ঠাণ্ডা করে বললেন, না, পরে গুনে দেখি, আড়াই হাজার। অতএব আড়াই হাজার যদি লক্ষ লক্ষ হতে পারে তবে তিনশো দ্বীপকে মাত্র এক লক্ষে পরিণত করতে আর তেমন কি ভয়ঙ্কর অসুবিস্তে! তদুপরি মূল পাণ্ডুলিপির কপি করার সময় নকলনবিসরা শূন্য সংখ্যা বাড়াতে ছিলেন বড়ই উদারচিত্ত।
এতসব যুক্তি থাকা সত্ত্বেও আমি অতিশয় সভয়ে একটি নিতান্ত এমেচারি (ফোক ইটিমলজি) শব্দতাত্ত্বিক গবেষণা পেশ করি।
লাক্ষা শব্দের অর্থ গালা। পলাশ প্রভৃতি বৃক্ষের শাখায় পুঞ্জীভূত কীট-বিশেষের দেহজ রস হইতে ইহা উৎপন্ন হয় (হরিচরণ)। এর রঙ লাল। হিন্দিতে এর নাম লাক এবং ইংরেজি ল্যাক এর থেকে এসেছে।… লাক্ষাদ্বীপপুঞ্জ নির্মিত হয়েছে এক প্রকারের কীটের রস থেকে। এর নাম প্রবাল এবং এর রঙ লাল গোলাপি, সাদা ইত্যাদি হয়। কিন্তু প্রবাল বলতে সংস্কৃতে সর্বপ্রথম অর্থ : অঙ্কুর, কিসলয়, নবপল্লব– অতএব বৃক্ষের সঙ্গে এর সম্পর্ক রয়েছে।
তাই আমার মনে সন্দেহ জাগে সেই প্রাচীন যুগে যখন লাক্ষাদ্বীপের নামকরণ হয় (এবং আর্যরা ওই প্রথম প্রবালদ্বীপ, কোরাল আইল্যান্ড-এর সংস্পর্শে আসেন। তখন তারা হয়তো লক্ষ সংখ্যার কথা ভাবেননি, তাঁরা এর নামকরণ করেছিলেন লাক্ষার সঙ্গে এর জন্মগত, বর্ণগত, রসাগত রূপ দেখে।
.
সিন্ধুপারে
লাক্ষা দ্বীপ নিয়ে বড্ড বেশি তুলকালাম করার কোনওই প্রয়োজন থাকত না, যদি না তার সঙ্গে ভারতবর্ষের প্রাচীন ইতিহাস বিজড়িত থাকত।
প্রথম প্রশ্ন : পশ্চিমদিকে ভারতীয়রা কতখানি রাজত্ব বিস্তার করেছিল? কোন কোন জায়গায় তারা কলোনি নির্মাণ করেছিল?
আমার সীমাবদ্ধ ইতিহাস ভূগোল জ্ঞান বলে, পশ্চিম দিকে, ভারতের দক্ষিণতম প্রান্ত কন্যাকুমারী থেকে প্রায় দু হাজার মাইল দূরে, আদন বন্দরের প্রায় ছ শো মাইল পুব দিকে সোকোত্রা দ্বীপে। ম্যাপ খুললেই দেখা যায়, এ-দ্বীপ যার অধিকারে থাকে সে তাবৎ লোহিত সাগর, আরব সমুদ্র এবং পার্সিয়ান গালফের ওপরও আধিপত্য করতে পারে।
এই সোকোত্রা দ্বীপের গ্রিক নাম দিয়োকরিদে এবং পণ্ডিতেরা বলেন এ শব্দটি এসেছে সংস্কৃত দ্বীপ-সুখাধার থেকে। মনে হয়, ভারতবর্ষের পশ্চিম প্রান্ত থেকে নৌকোয় বেরিয়ে, দু হাজার মাইল ঝড়ঝার সঙ্গে লড়াই করতে করতে যে কোনও জায়গায় পৌঁছলেই মানুষ সেটাকে সুখাধার বলবেই বলবে। কিন্তু এ-দ্বীপের পরিষ্কার ইতিহাস জানবার তো উপায় নেই। প্রাচীন গ্রিক ভৌগোলিকেরা বলছেন, এ দ্বীপে বাস করত ভারতীয়, গ্রিক ও আরব বণিকরা। পরবর্তী যুগের ঐতিহাসিকরা বলছেন, এটা তখন ভারতীয় বম্বেটেদের থানা। তারা তখন আরব ব্যবসায়ী জাহাজ লুটপাট করত।
মনে বড় আনন্দ হল। এদানির অহিংসা অহিংসা শুনে শুনে প্রাণ অতিষ্ঠ। আমরাও যে একদা বম্বেটে ছিলুম সেটা শুনে চিত্তে পুলক জাগল। বম্বেটেগিরি হয়তো পুণ্যপন্থা নয়, কিন্তু এ-কথা তো সত্য যেদিন থেকে আমরা সমুদ্রযাত্রা বন্ধ করে দিলুম সেইদিন থেকেই ভারতের দুঃখ দৈন্য, অভাব দারিদ্র্য আরম্ভ হল।
সোকোত্রা দ্বীপকে মিশরিরা নাম দিয়েছিল সুগন্ধের সারিভূমি–অর্থাৎ সারি কেটে কেটে যেখানে সুগন্ধ দ্রব্যের চাষ হয়। এবং এখন সেখানে ঘৃতকুমারী (মুসব্বর), মস্তকি (MyTh), গুগগুল এবং আরও কী একটা উৎপাদিত হয়। মামি তৈরি করার জন্য মিশরীয়দের অনেক কিছুর প্রয়োজন হত। এবং খুশবাইয়ের প্রতি ওদের এখনও খুবই শখ। খ্রিস্টপূর্ব হাজার বছর আগে রচিত রাজা সুলেমানের গীতে বিস্তর সুগন্ধের উল্লেখ আছে। এদের অধিকাংশই যেত ভারত, সিংহল, ইন্দোনেশিয়া এবং সোকোত্রা থেকে। এবং এই সোকোত্রাই ছিল ভারত ও আরব বণিকদের পণ্যদ্রব্য বিনিময়ের মিলনভূমি। আরবদের মারফতে সেসব গন্ধদ্রব্য বিলেত পর্যন্ত পৌঁছত। তাই শেকসপিয়র ভেবেছিলেন এসব গন্ধদ্রব্য বুঝি আরব দেশেই জন্মায়– লেডি মেকবেথ বলছেন, অল দি পারফিউমজ অব আরাবিয়া উইল নট সুইটেন দিস লিটিল হ্যান্ড। এই গন্ধের ব্যবসা তখন খুবই লাভজনক ছিল। এবং কাঠিয়াওয়াড়ের গন্ধবণিকরা এর একটা বড় হিস্যা পেতেন। মহাত্মা গান্ধীর জন্মবার্ষিকীতে এই সুবাদে স্মরণ যেতে পারে যে তিনি জাতে গন্ধবণিক– সেই গন্ধ থেকে তাঁর পরিবারের নাম গাঁধী।