কেন্দ্রীয় সরকার, বিশেষত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও আসাম সরকার জানতেন যে, চরমপন্থী মিজোরা অস্ত্রশস্ত্র যোগাড় করছে ১৯৬৩ থেকে, এবং যারা অস্ত্র যোগাড় করে তারা একদিন অস্ত্র নিয়ে দাঁড়াবে, তা-ও জানতেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নন্দজি নিজে বললেন লোকসভায় যে, অস্ত্রাদি এসেছে পাকিস্তান থেকে, এবং মিজোদের অনেককে সামরিক শিক্ষাও দিয়েছে পাকিস্তান। এটা সরকার জানেন আজ অনেকদিন। তা সত্ত্বেও না হয়েছে চেষ্টা অস্ত্র-আনার পথ বন্ধ করার, না হয়েছে চেষ্টা চরমপন্থি নেতাদের গ্রেপ্তার করার, না হয়েছে চেষ্টা অস্ত্রের গোপন গুদাম খুঁজে বের করার। এও যদি জরপাব না হয় তো কে আর হবে?
শুধু তাই কি? এই চরমপন্থী শ্রেষ্ঠ নেতা হল লালডেংগা, ও তার দক্ষিণহস্ত হল লালনুমাউইয়া, মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্টের যথাক্রমে সভাপতি ও উপ-সভাপতি। এরা, ও আরও অনেকে চট্টগ্রাম দিয়ে যেত পাকিস্তানে। এবং যেত বেড়াবার জন্য নয়। অবশেষে ১৯৬৩-র ১৭ ডিসেম্বর এই দু জনকেই গ্রেপ্তার করা হয় বেআইনিভাবে পাকিস্তানে যাওয়ার জন্য। কিন্তু কী জানি কেন, কিছুকাল পর দুজনকেই ছেড়ে দেওয়া হয়। তার জন্য দায়ী আসাম সরকার।
আজ থেকে প্রায় বছর চার-পাঁচেক আগে কেন্দ্রীয় সরকারকে দেওয়া হয়েছিল গোপন সামরিক রিপোর্ট ভারতের ওইসমস্ত পাহাড়ি সীমান্ত নিয়ে, এবং তাতে নাগা-মিজো পাকিস্তানের ষড়যন্ত্রের উল্লেখও ছিল।
মুখ্যমন্ত্রী শ্রীচালিহার নাকি চমৎকার যুক্তি। তাঁর প্রাক্তন সহযোগী ফকরুদ্দিন আলি আহমেদ সাহেব বললেন লোকসভায় যে, মুখ্যমন্ত্রী অতিরিক্ত কোনও নিরাপত্তা বাহিনী পাঠালেন না মিজো অঞ্চলে এই ভয়ে যে, তাতে মিজোরা অসন্তুষ্ট হবে, এবং হয়তো তাদের বিদ্রোহের দিন ঘনিয়ে আনবে। এমন যুক্তি কোনও মুখ্যমন্ত্রী দিতে পারেন, অবিশ্বাস্য। কিন্তু বাস্তবে তাই হয়েছে। আইজলে মাত্র ছিল এক ব্যাটালিয়ন আসাম রাইফেলস্। হালফিলে পাঠানো হয়েছে আর একটি মাত্র ব্যাটালিয়ন। সশস্ত্র মিজোদের সামনাসামনি করতে, অথবা বিদ্রোহ দমন করতে এই দুই ব্যাটালিয়ন কিছুই না। যদি কর্তৃপক্ষ অতিরিক্ত বাহিনী পাঠানোর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেনই তা হলে ওই সময়ে আরও বেশি কেন পাঠানো হল না? আমাদের সৈন্যবাহিনীর ঘাটিই-বা নেই কেন? ভবিষ্যতের দিকে দৃষ্টি এত কম ছিল যে, অতিরিক্ত রাস্তাঘাট তৈরির চেষ্টাও হয়নি।
অসীম অবহেলা যেমন নিরাপত্তার দিকে তেমনি রাজনৈতিক দিকে। লালডেংগা প্রমুখ মিজো নেতারা ১৯৬০ ও আগে থেকে অন্যান্য পার্বত্য অঞ্চলনেতাদের সঙ্গে মিলে কাজ করছিল। ১৯৫৫-৫৬ থেকে তারা দাবি তুলেছে, সমস্ত পার্বত্য অঞ্চল নিয়ে আলাদা রাজ্য গড়ার। স্বাধীন রাষ্ট্রের নয়, ভারতের ভিতরে থেকে আলাদা রাজ্য গড়ার। কে শোনে? আসাম সরকার ও তাঁর কর্মচারীদের ঔদ্ধত্যের ফলে ক্রমশ নাগারা গেল বিগড়ে। তাঁদের শাসক-মনোভাব শেষে অন্যান্য পার্বত্য অঞ্চলেও আনল অসন্তুষ্টি। গোড়ায় ছিল পাহাড়ি মানুষদের একটা অনুভব যে, তারা আসামের ভিতরে থেকে আসামের কর্তৃত্বধীনে নিজেদের মতো জীবনযাপন করতে পারবে না। ১৯৬০-এর ভাষা বিল, বাঙালি বিতাড়ন আন্দোলন, ১৯৬১-এর কাছাড়ে পুলিশি তাণ্ডব সব মিলে ঠেলে দিল পার্বত্য নেতাদের সম্পূর্ণ বিরোধী স্থানে।
তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী নেহরুর সঙ্গে এদের প্রতিনিধিরা সাক্ষাৎ করতে থাকেন ১৯৬০-এর নভেম্বর (২৪-২৬) থেকে। লালডেংগারা সেই বছরই বেরিয়ে চলে গেল সর্বদলীয় নেতা সম্মেলন থেকে। তখন থেকে মিজোরা চলল আলাদা পথে। এমনকি নরমপন্থী দলের নেতা থাংলুরা মশায়ও কংগ্রেস দল থেকে ইস্তফা দিয়েছিলেন ২৭ এপ্রিল, ১৯৬১। তাঁকেই আবার কংগ্রেস পাঠালো রাজ্যসভায়। মিজোরা ছিল দু মুখো। এক মুখে ছিল স্বায়ত্তশাসন অর্জনের কথা, অন্য মুখে ছিল সার্বভৌম রাষ্ট্র স্থাপনের কথা। আমাদের সরকার প্রথম মুখের কৌশলে ধরা দিলেন।
অন্যান্য পার্বত্য অঞ্চল-নেতারা (খাসি, গারো, মিকির ইত্যাদি) নিজেদের দাবি নামিয়ে আনল। নেফা থেকে গারো পাহাড় অবধি এক রাজ্য আর চায় না। তারা শুধু চাইল, নেহরু ফরমুলা মতে, পুরোপুরি স্বায়ত্তশাসন আসাম রাজ্যের অভ্যন্তরে। এমনকি মুখ্যমন্ত্রী চালিহাও সম্মত হলেন (১-১-৬৪)। তা সত্ত্বেও আজ দু বছর গড়িয়ে গেল, কিছুই হল না।
সরকারের না আছে সামরিক দূরদৃষ্টি, না আছে রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি। দৃষ্টিই নেই, তা কি। দূরের কি কাছের! ফল : (১) মিজো বিদ্রোহ। (২) অন্যান্য পার্বত্য অঞ্চলে তার প্রভাব, যার ফলে অন্যান্য পার্বত্য অঞ্চল শুধু স্বায়ত্তশাসনে সন্তুষ্ট না থেকে হয়তো দাবি আরম্ভ করবে ভারতীয় রাষ্ট্রস্থ রাজ্যপদ লাভের।
— দারাশিকো।
সত্যপীরের কলমে
লাক্ষাদ্বীপ
বহু বত্সর পূর্বে আমি মাদ্রাজ শহরে এক বন্ধুর বাড়িতে বাস করতুম। তখন চিনি বড় রেশনড় ছিল। যে-ঘরের বারান্দায় বসেছিলুম সেখানে বন্ধুপত্নী কাগজে মোড়া চিনি একটা বোয়ামে রেখে কাগজটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে চলে গেলেন। সেই কাগজের টুকরোটা হাওয়ায় ভেসে ভেসে এসে আমার পায়ের কাছে ঠেকল। আমার চোখ গেল যে, কাগজটাতে আরবি হরফে কী যেন লেখা। আশ্চর্য। এই মাদ্রাজ শহরে চিনির দোকানে আরবি কাগজ এল কোথা থেকে? কৌতূহল হল। কাগজটি তুলে ধরে পড়বার চেষ্টা দিলুম। তখন দেখি আরবি হরফে যেসব ভাষা লেখা হয় এটা তার কোনওটাই নয়, আরবি নয়, ফারসি নয়, উর্দু নয়, সিন্ধি নয় (সিন্ধি আরবি হরফে লেখা হয়), কিছুই নয়। তুর্কি ভাষা আমি জানি না। কিন্তু তুর্কি ভাষা এই মাদ্রাজে এসে পৌঁছবে কী প্রকারে? একটি পাতার তো ব্যাপার; ধৈর্য সহকারে পড়ে যেতে লাগলাম এবং দ্বিতীয় পৃষ্ঠার শেষ শব্দটি দেখি মুদরায়ে অর্থাৎ মদুরা। তা হলে ইটি ভারতীয় ভাষা। তখন ছিন্ন পত্রখানা ফের সযত্নে পড়ে দেখি, খাস আরবি শব্দের সঙ্গে মিশে আছে মালায়লাম ও তামিল শব্দও। হঠাৎ মাথায় খেলল, এটি তা হলে মপলাদের ভাষা। এরা আরব ও মালয়ালমের বর্ণসঙ্কর। পরের দিন বন্ধু যখন কর্মস্থলে গেলেন তখন ছিন্ন পত্রটি তার হাতে দিয়ে আমার অনুমানটি কনফার্ম করিয়ে নিলুম। এবং অনুসন্ধান করে আরও জানলুম, লাক্ষাদ্বীপকে নিয়ে যে দ্বীপপুঞ্জ গঠিত সেগুলোর ভাষাও নাকি মোটামুটি ওই একই।