–ওমর খৈয়াম
.
কাঠ-বেরালি?
স্বাধীনতা সংগ্রামে যারা প্রাণ দিয়েছেন তাদের কথা এ সপ্তাহে আমরা বার বার স্মরণ করেছি; দেশের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা জনারণ্যের মাঝখানে বক্তৃতামঞ্চের উপর থেকে তাদের উদ্দেশে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করেছেন। স্বাধীনতার যে দেউল নির্মিত হল তার অনির্বাণ আরতির চিরন্তন প্রদীপ হয়ে রইল তাদের স্মৃতি।
সঙ্গে সঙ্গে কিন্তু এ-বেদনাটাও বুকে বাজে যে, বহু অখ্যাত অজ্ঞাত দেশবাসীর নাম আমরা এ উপলক্ষে পাঁচজনকে শোনাতে পারলুম না। তারা এমন কিছু কীর্তি রেখে যেতে পারেননি যার জন্য আমরা তাদের নাম আড়ম্বর করে স্মৃতিফলকে উত্তীর্ণ করতে পারি। অথচ আপনি আমি পাঁচজন নগণ্য লোকের চেনা-শোনার ভিতরেও এরকম ধরনের দু চারটি দেশসেবী ছিলেন।
তাঁর নাম শান্তিলাল খুশহালচন্দ শাহ। বাড়ি মহাত্মাজির দেশে, অর্থাৎ কাঠিওয়াড়ে–প্রাচীন সৌরাষ্ট্রে। রোগা-পটকা লোকটি দৈর্ঘ্যে পাঁচ ফুট হয় কি না-হয়। অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়ে এ-দিক ও-দিক ধাক্কা খেয়ে খেয়ে পৌঁছলেন শান্তিনিকেতনে সেখান থেকে গেলেন বন্ শহরে (অধুনা পশ্চিম জর্মনির রাজধানী) সংস্কৃতে ডক্টরেট নেবার জন্য। অধ্যাপক কিফেল (পুরাণ সম্বন্ধে ইন্ডিশে কসমগণি নামে একখানা বিরাট গ্রন্থ ইনি লিখেছেন, বিখ্যাত প্রাচ্য বিদ্যামহার্ণব অধ্যাপক য়াকোবির ইনি শিষ্য) ছোকরাকে পেয়ে ভারি খুশি।
কী মতলব তা জানার পূর্বে খামকা তর্ক করে অস্ট্রেলিয়ান শয়তানকে হুঁশিয়ার করে দেওয়াটা বিচক্ষণের কর্ম হবে না।
ভেবেছিলুম, শাহ খবরদারিটা শুনে অস্ট্রেলিয়ানকে ঠ্যাঙাবার জন্য তার ভাঙা মোটর-সাইকেল করে তদণ্ডেই বন শহর চষতে আরম্ভ করে দেবে। আদপেই না, ঠাণ্ডা হয়ে সব কথা শুনল, মিটমিটিয়ে একটুখানি হাসল।
শুধালুম, দেশে ফিরে না যেতে পারলে দেশ-সেবা করবে কী করে? তাই একটু সমঝে-বুঝে বক্তৃতাটা দিলে হয় না?
শাহ মিটমিটিয়ে হাসল।
বক্তৃতার দিন আমরা সদলবলে উপস্থিত– দেখি অস্ট্রেলিয়াও এসেছে।
সাড়ে ছ-ফুটি জর্মনদের মধ্যিখানে পাঁচফুটি শাহকে বামনাবতারের মতো দেখাচ্ছিল।
ভারতবর্ষের নানা প্রকার ঐতিহাসিক সাংস্কৃতিক অর্থনৈতিক গবেষণা করার পর শাহ নামল ইংরেজ রাজত্বের আমলে। প্রথমে আলোচনা করল সে-আমলের সর্বাঙ্গীণ দুঃখ-দৈন্য, মহামারী-দুর্ভিক্ষের, আস্তে আস্তে ফুটিয়ে তুলতে লাগল তার জন্য যে দায়ী তার বিকট বীভৎস নগ্ন ছবি এবং সর্বশেষে করল হুঙ্কারের পর হুঙ্কার দিয়ে এমিল জোলার আই একুজ (I accuse) কায়দায় ইংরেজের চতুর্দশ পুরুষের শ্রাদ্ধ।
কর্ণপটবিদারক করতালির মাঝখানে শাহ আসন গ্রহণ করল।
করতালির প্রতি নমস্কার করতে উঠে শাহ বলল, এই সামান্য নগণ্য বক্তৃতা সম্পর্কে আমার আরেকটি বক্তব্য আছে।
তার পর অতি শান্তকণ্ঠে অস্ট্রেলিয়ান হুমকির একটা সবিস্তর বয়ান দিয়ে বলল, আমি কে, আর আমার কতটুকুই-বা শক্তি? সেই সামান্য সত্তাটুকুকেও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ সইতে পারে না বলে এই সুদূর বন্ শহরের নিভৃত কোণেও সে চোখ রাঙায়, মার লাগাবে বলে ভয় দেখায়। কিন্তু আমার দেহ ক্ষুদ্র, ভয়ও সেই অনুপাতে ক্ষুদ্র।
পাঁচফুটি শাহ সেদিন জর্মনদের কাছ থেকে বাদ-‘শাহী’ কদর পেয়েছিল।
***
আমি দেশে ফিরে এলুম। কিছুদিন পরে শুনলুম, কোথাও থেকে একটা বৃত্তি যোগাড় করে শাহ বন্ শহরের মেডিকাল কলেজে ঢুকেছে। সংস্কৃতে ডক্টরেট নেওয়ার পর পরিণত বয়সে ডাক্তারি পড়া আরম্ভ করা– তা-ও আবার জর্মন মেডিকাল কলেজে! চারটিখানি কথা নয়।
তার পর শুনলুম, শাহ ডাক্তারি পাস করে জর্মন ফৌজে ডাক্তার হয়ে ঢুকেছে। তখন বুঝলুম, কেন সে এত মেহনত করে ডাক্তারি শিখল। সুভাষচন্দ্র যেরকম জাপানের সাহায্য নিয়ে ইংরেজকে পর্যুদস্ত করতে চেয়েছিলেন, আমাদের নগণ্য শাহ তেমনি জর্মন ফৌজে ঢুকেছিল সেই মতলব নিয়ে। পাঁচফুটি শাহ তো অন্য কোনও উপায়ে জর্মন ফৌজে ঢুকতে পারত না।
তার পর নাকি শাহ স্তালিনগ্রাদের দিকে জর্মন ফৌজের সঙ্গে যায়– এটা অবশ্য উড়ো খবর। শাহের জীবনের এ পর্বটা জানবার কৌতূহল সকলেরই হওয়ার কথা, কিন্তু অনেক অনুসন্ধান করেও আমি এ বিষয়ে কোনও তথ্য যোগাড় করতে পারিনি।
শাহের সর্বশেষ খবর পাই লড়াই শেষ হওয়ার বছরখানেক পরে। জর্মনিতে তখন যেসব ভারতীয় আটকা পড়ে আছেন তার একটা ফিরিস্তি ইংরেজ সরকার প্রকাশ করে। সে ফিরিস্তিতে শাহের নাম ছিল।
তার পর শাহের আর কোনও খবর পাইনি।
–প্রিয়দর্শী
.
মিজো সমস্যা : সরকার
ফিজোর ভাই মিজো না হলেও খুব যে নিকট-আত্মীয় সন্দেহ নেই। বললেন, লোকসভার একজন কংগ্রেসি সদস্য সংসদের কেন্দ্রীয় হলঘরে। উপস্থিত একজন সদস্য অতিশয় উত্মা প্রকাশপূর্বক বর্ণনা করতে লাগলেন কেন্দ্রীয় সরকার ও আসামের রাজ্য-সরকারের মনোভাব। এবং এক জায়গায় এসে উনি অতি নিপুণভাবে যে বিশেষণটি প্রয়োগ করলেন এই দুই সরকারের বিষয়ে, সেই শব্দটি জরগদব।
একদা নাগা-নেতা ফিজোকে নিয়েও ছিল এই জরপাব ভাব; এবার মিজোদের বেলায়ও দেখা গেল ওই একই ভাব। সশস্ত্র অভ্যুত্থানে যারা দেশের বাইরে চলে যেতে চায় তাদের নিন্দা করেন না এমন রাজনৈতিক নেতা ভারতে খুব বিরল। কিন্তু এবার অনেকে (তাদের ভিতর সরকারি দলের নেতারাও আছেন) প্রশ্ন করতে আরম্ভ করেছেন কেন্দ্রীয় ও আসাম রাজ্য-সরকারের সেই ঢিমে-তেতালা জমিদারি চালের, যার জন্য আজ সম্ভব হয়েছে মিজো বিদ্রোহ।