কিন্তু প্রশ্ন ইউরোপ সত্যিই কি রাজনীতি থেকে ধর্ম বাদ দিয়ে ফেলেছে?
হিটলার যখন সোশ্যালিস্টদের সাবাড় করলেন, কম্যুনিস্টদের ভিটে-মাটি উচ্ছন্ন। করলেন, ধনপতিদের কলুর বলদের মতো খাটালেন, শ্রমিকদের ইউনিয়ন পয়মাল করে দিলেন, ইহুদিদের সর্বস্ব লুণ্ঠন করলেন, তখন নাৎসিরা নিশ্চিন্ত হয়ে ভাবল, এখন রাস্তা সাফ, লন্ডন-মস্কো পৌঁছতে এখন আর কোনই বাধা নেই। ঠিক তখনই বিদ্রোহ দেখা দিল এমন এক দলের মাঝখানে যাঁদের সবাই কুসংস্কারাচ্ছন্ন, অফিসের কারবারি নামে পরিচিত হতেন। এঁরা সব ক্রিশ্চান পুরোহিতের দল, এবং এদের নির্ভীক আচরণ দেখে জর্মনির বহু আস্তিক বহু নাস্তিক বিস্ময় মানলেন, এবং আস্তে আস্তে তাদেরই চারপাশে ভিড় জমাতে লাগলেন। ১৯২৯ সালে হিটলার যখন সামান্য মন্ত্রীত্ব পেলেই বর্তে যেতেন তখন আমি গির্জাঘরে অনায়াসে বসবার জায়গা পেতুম, ১৯৩৮ সালে যখন চেম্বারলেন তাঁর কথায় কথায় বাঁদরনাচ নাচতে শুরু করেছেন তখন গির্জাঘরের ভিড়ের ঠেলায় আমি বহু রবিবার দরজা পর্যন্ত পৌঁছে নিরাশ হয়ে বাড়ি ফিরে এসেছি। ১৯২৯ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়োলজি বিভাগ ছাত্রাভাবে অক্কা পায় পায়, ১৯৩৮ সালে ওই বিভাগই বক্তৃতা আলোচনায় গমগম করছে। হিটলারের স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে জর্মনির নাস্তিকরা তখন পর্যন্ত পাদ্রি-পুরুতের সঙ্গে দহরম মহরম আরম্ভ করেছে। এঁরা তখন যে সাহস দেখিয়েছিলেন জর্মনির লোক আজও তা ভুলতে পারেনি। এই মাত্র সেদিন পশ্চিম জর্মনির ব্রিটিশ এলাব যে গণ-নির্বাচন হয়ে গেল তাতে সবচেয়ে বেশি ভোট পেয়েছে এক ধর্মের নামে গড়া রাজনৈতিক দল। জর্মনির খবর কাগজ পড়ে মনে হয়, সাধারণ জর্মন আর যেন নির্জলা রাজনৈতিকদের হাতে সবকিছু তুলে দিতে রাজি নয়। যে দলে দু চারজন পাদ্রি-পুরুত আছেন সে দলকে স্বীকার করে জর্মনি যেন তাদের আগেকার সাহসের পুরস্কার দিতে চায়।
ইটালিতেও তাই। কমরেড তল্লাত্তির মতো সর্বজনমান্য কম্যুনিস্ট নেতা পৃথিবীর অল্প দেশেই আছেন। ইটালির গত গণভোটে তার অবশ্যম্ভাবী জয় ঠেকাবার জন্য স্বয়ং পোপকে ভোট-মারে নাবতে হল। তল্লাত্তিও তখন প্রমাদ গণলেন। কমিউনিস্ট পার্টি জনসাধারণকে সন্তুষ্ট করার জন্য ইস্তাহারে জাহির করলেন, কমিউনিস্টরা জয়লাভ করলে পাদ্রি-পুরুতের টাকা-পয়সায় হাত দেবে না, গির্জা মনাস্টেরির (সংঘ) যুগ যুগ সঞ্চিত চাষা-মজুরের রক্তে রাঙা ধনদৌলত যেমন আছে তেমনি থাকবে। অর্থাৎ ধর্মকে তার অর্থ থেকে বঞ্চিত করা হবে না। তবু তাত্তিকে হার মানতে হল। আর এখন তো ভ্যাটিকান এবং মার্শাল প্লান একই জিনিস হয়ে দাঁড়িয়েছে।
স্বয়ং স্তালিন লড়াইয়ের সময় পাদ্রি সম্প্রদায়কে ডেকে এনে বহু গির্জাঘর ফেরত দিলেন। শুনেছি কোনও কোনও গির্জাঘরে নাকি হোলি রাশার নামে পুজোপার্বণও হয়েছিল। নাম ভুলে গিয়েছি কিন্তু তখন এক বড় পাদ্রি সায়েবকে নিয়ে রুশিয়া বিস্তর মাতামাতি করেছিল। যুদ্ধের পর আমেরিকার ধনতন্ত্রে ফাটল ধরাবার জন্য কোনও কোনও মার্কিন পুরোতকে রুশ সাড়ম্বর নিমন্ত্রণ, আদর, আপ্যায়নও করেছিল।
ফ্রান্সের মতো নাস্তিক দেশে ক্যাথলিকদের এখনও কতখানি শক্তি সে-কথা আর বুঝিয়ে বলতে হবে না।
প্যালেস্টাইনে নবনির্মিত ইহুদিরাজ্য চোখের সামনে গড়ে উঠল যেহোভার নামে শপথ করে করে। ইহুদিরা শুয়োরের মাংস খায় না–শাস্ত্রে বারণ- ইসরায়েল রাজ্যে এই শূকর মাংস নিষিদ্ধ। অথচ এ রাজ্যের কর্ণধারগণের শতকরা নব্বইজন যখন ইউরোপে ছিলেন তখন ভুলেও সিনাগগে (ইহুদি ভজনালয়) যেতেন না, গবগব করে শুয়োরের মাংস গিলতেন প্রশস্ত দিবালোকে, হোটেল রেস্তোরাঁর বারান্দায় বসে।
এবং এই প্যালেস্টাইনের প্রতিবেশী মিশরে রাজনৈতিক আন্দোলন করে কে? ইংরেজকে খেদাবার জন্য উঠে-পড়ে লেগেছে কারা? অজহর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রেরা। আমরা এদেশে টোল বা মাদ্রাসা বলতে যা বুঝি অজহর ঠিক সেই জিনিস। সেখানে ধর্মচর্চা হয়, সেখানকার ভূগোল পাঁচশো বছরের পুরনো, সেখানে অর্থনীতি এমনকি রাজনীতিও পড়ানো হয় না। অথচ এই অজহরের ছাত্রেরাই ট্রাম পোড়ায়, বাস জ্বালায়, আর মোকা পেলে ইংরেজকে ঠ্যাঙায়। এদের দমাবার জন্য দিনসাতেক হল নতুন আইন পাস করা হয়েছে। এবং আশ্চর্যের বিষয়, মিশরের অন্য বিশ্ববিদ্যালয়টি ধর্মচর্চা করে না, ট্রামবাস পোড়াতেও চায় না, তারা আছে সরকারকে খুশি করে চাকরি পাবার তালে।
ট্রান্সজর্ডানের আমিরের তাগদ তিনি মহাপুরুষের বংশধর, তিনি রাজা এবং ধর্মগুরু দুই-ই বটেন।
ইবনে সউদের তাগদ তিনি মক্কা-নশীন তাই। মুসলিম জাহানের কেন্দ্র মক্কাশরীফ।
ইরান আফগানিস্তানের মোল্লা সম্প্রদায় এখনও সমাজচক্রবর্তী।
***
ধর্ম রাজনীতিতে প্রবেশ করবে কি না, করা উচিত কি না সে বিষয়ে ব্যক্তিগতভাবে আমি কিছু বলতে চাইনে। কারণ আমার মতের কোনও মূল্য নেই। আমি শুধু এইটুকু দেখিয়েই সন্তুষ্ট যে ধর্মকে গেট আউট বললেই সে সুড়সুড় করে বেরিয়ে যায় না। এবং তাই যদি সত্য হয় তবে ধর্মকে কী প্রকারে জনপদ-কল্যাণে নিযুক্ত করা যায় সেইটে সাদা চোখে ভালো করে তলিয়ে দেখতে হবে। এবং তলিয়ে দেখতে হলে ঈষৎ ধর্মচর্চার প্রয়োজন। সেটা কী প্রকারে করা যায় সেই হল সমস্যা। ধর্ম বলতেই যারা অজ্ঞান তাঁদের হাতে তো আর সবকিছু ছেড়ে দেওয়া যায় না।