সোজা বাংলায় বলতে গেলে দাঁড়ায় : বিচ্ছেদের ফল বেদনা এবং তার থেকে জন্ম নেয় নিবিড়তম একাত্মবোধ। এই আমাদের যক্ষের ব্যাপারটাই বিবেচনা করে দেখুন না। একটুখানি ভেডুয়াগোছ ছিল বলে লোকটাকে কুবের গাঁয়ের বার করে দিলেন। বেচারি তখন হাউমাউ করে যে কান্নাকাটি করেছিল তারই নাম মেঘদূত। খাসা কাব্যি, কেউ অস্বীকার করবেন না। অথচ দেখুন, কুবের যদি ছোরার বউ-হ্যাংলামোটা একটুখানি বরদাস্ত করে নিতেন তা হলে সে আরামে খেয়েদেয়ে দু পয়সা লোকটার ছিল তো বটে– ঢেঁকুর তুলে তুলে আর আণ্ডা-বাচ্চা পয়দা করে বাকি জীবন কাটিয়ে দিত।
অবশ্য যক্ষটি অম্মদেশীয় অর্থাৎ গান্ধীপন্থি অহিংস। জর্মন হলে কী করত বলা যায় না। হয়তো ভি ওয়ান, ভি টু নিয়ে কুবেরের পেছনে তাড়া লাগাত আর কুবেরও হয়তো এটমবমের সন্ধানে মন্বন্তরব্যাপী তপস্যায় বসে যেতেন।
পাঠক বলবেন, চার্চিল তো আর মেঘদূত পড়েননি, এ তত্ত্বটা জানবেন কী করে? আলবৎ জানা উচিত। কারণ ইংরেজিতেই প্রবাদ রয়েছে অ্যাবসেন্স মেক্স হার্ট ফন্ডার। আমার বিশ্বাস চার্চিল এ প্রবাদটি জেনেশুনেই বিরহের ব্যবস্থাটা করেছিলেন। কারণ ইংরেজ আর কিছু জানুক আর না-ই জানুক, পয়সার কদরটা খুব ভালো রকমেই জানে। তাই তাদের ভিতর এ প্রবাদেরও বাড়া আরেকটা প্রবাদ আছে এবং সেটা জানে অতি অল্প ঘড়েলই– সেটা হচ্ছে, প্রেজেন্টস ফন্ডার স্টিল।
অর্থাৎ প্রেজেনস নয় প্রেজেন্টস। সাড়িডা, বালাডা কিন্যা বিবির মন যোগাও।
আমার বিশ্বাস চার্চিল যখন জর্মনিকে বৈষ্ণবার্থে খণ্ডিতা করতে রাজি হয়েছিলেন তখনই প্রেজেন্টসের কৌশলটা মনে মনে এঁচে নিয়েছিলেন। তাঁর মতলব ছিল কৃষ্ণকে কোনও গতিকে রাধার কাছ থেকে মথুরায় সরিয়ে নিয়ে রুক্মিণী-সত্যভামার ভেট দেওয়া। আমার বিশ্বাস তাই ইংরেজ এত সাত-তাড়াতাড়ি জর্মনিতে আবার খানা-দানা পাঠাতে আরম্ভ করেছে। (যুদ্ধ যখন লাগে তখন আমার এক জর্মন বন্ধুর দুই মেয়ের বয়স ছিল এক আর তিন। বন্ধু মাসখানেক হল একখানি চিঠিতে আমাকে লিখেছেন, যুদ্ধের সময় তো দক্ষিণ আমেরিকা থেকে কলা আসা বন্ধ ছিল। কাল প্রথম বাজারে কলা উঠেছে। আমার মেয়ে দুটি ছবিতে দেখা জিনিস নিজের চোখে দেখে আনন্দে চেঁচিয়ে উঠল। পদ্মার ও-পারে আমরা বলি, জর্মনিকে আবার কলা মূলাড়া দেওয়া হচ্ছে।
এবং সবচেয়ে বড় সওগাত মার্কিন-ইংরেজ-ফরাসি তিন মহাজন পশ্চিম জর্মনিকে দিয়ে ফেলেছেন সেটা হচ্ছে স্বরাষ্ট্রাধিকার। পশ্চিম জর্মনির কাজ-চালানো-গোছ একটা কনসটিটুশান তৈরি হয়ে গিয়েছে, গণনির্বাচন সমাপ্ত হয়েছে এবং হের আডেনাওয়ার এ অঞ্চলের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন।
কিন্তু মার্কিন-ইংরেজ-ফরাসি বড়কর্তারা স্তালিনকে ফাঁকি দিয়েছেন। কথা ছিল কোনও কর্তাই আপন হিস্যার জর্মনিকে স্বরাজ দেবে না– স্বরাজ যদি দিতেই হয় তবে সবাই একজোট হয়ে পূর্ণাবয়ব জর্মনিকে পূর্ণাঙ্গ স্বরাজ দেবেন। মা-ই-ফ ঝপ করে আপন হিস্যায় স্বরাজ দিয়ে অর্থাৎ প্রজাস্বত্ব আইন চালু করে দিয়ে ওপারের জমিদার শিববাবুকে বেবাক বোকা বানিয়ে দিয়েছেন।
প্যাঁচটা মন্দ নয়। কারণ নব-রাষ্ট্রপতি হের আডেনাওয়ার প্রথম বক্তৃতাতেই ও-পারের জমিদারের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। অবশ্য হিটলার যেরকম ভাষায় সুডেটেন চেয়েছিলেন ঠিক সে ভাষায় নয়– অতি মোলায়েম কণ্ঠে, কিন্তু আমরা এসব গলা চিনি, টে বললেই বুঝতে পারি টেংরার হাই স্কুলের ইত্যাদি।
অবশ্য চেম্বারলিনের মতো স্তালিনের ছাতা-বগলে ছুটোছুটি, ওড়াউড়ি করতে এখনও ঢের দেরি।
কিন্তু তাঁকেও এপিজমেন্ট করতে হচ্ছে। পূর্ব-জর্মনিকেও স্বরাজ দিতে হয়েছে।
এখন কে কত দিতে পারে? সুকুমার রায়ের মতো আমরা বলি লাগ, লাগ, লাগ–অর্থাৎ নিলামটা লেগে যাক, দর চড়ুক, বেচারি জর্মনির দু মুঠো অন্ন জুটুক, গায়ে গত্তি লাগুক।
–ওমর খৈয়াম
.
ধর্মং শরণং?
নদীতে স্নান করলে স্বাস্থ্য ভালো থাকে, দেশভ্রমণ করলে কুসংস্কার ও সঙ্কীর্ণতা থেকে মানুষ মুক্তি পায়, বস্ত্রদান ছত্রদান করলে দেশের শিল্প উন্নতিলাভ করে, মন্দির-মসজিদ গড়লে দেশের চারুকলা সমৃদ্ধিলাভ করে, তাই গঙ্গাস্নানে পুণ্য, তীর্থযাত্রায় ধর্মলাভ, দানে মোক্ষ আর উপাসনালয় নির্মাণে যে পুণ্য-ধর্ম-মোক্ষ তিনেরই সম্মেলন সে বিষয়ে এককালে কারও মনে কোনও সন্দেহ ছিল না।
অর্থাৎ যা কিছু মানুষের পক্ষে মঙ্গলদায়ক এককালে তাকেই ধর্ম নাম দিয়ে সাধুসজ্জন এবং সমাজপতিরা জনগণের মন উদ্বুদ্ধ করতেন। এখনও অশিক্ষিত লোক ধর্মের দোহাই না দিলে কোনও প্রকারের সামাজিক উন্নতির চেষ্টা করে না, এখনও বহু লোক শরীর অসুস্থ হলে ডাক্তার না ডেকে মন্ত্রতন্ত্রের আশ্রয় নেয়। দাওয়াই-দেনে-ওয়ালা সন্ন্যাসী ফকিরের বিধান এখনও মানে বহু লোক, বিধানের বিধানকে উপেক্ষা করে। এ নিয়ে মনস্তাপ করলে শিক্ষিত সম্প্রদায় বলেন, শিক্ষা বিস্তার ছাড়া অন্য কোনও উপায়ে মানুষের মন ধর্মের মোহ থেকে মুক্ত করা যাবে না। স্বাস্থ্যরক্ষা, সমাজসংস্কার, শিল্পকলার বিস্তার এখন ডাক্তার, অর্থবিদ নন্দনজ্ঞদের হাতে ছেড়ে দিতে হবে–এরা সব স্পেশালিস্ট ধর্ম এখন শুধু তাদেরই জন্য যারা পরলোকের জন্য ইহলোক ত্যাগ করতে প্রস্তুত। শিক্ষাবিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ এ তত্ত্বটা বুঝতে পেরে রাজনীতি অর্থনীতি থেকে ধর্মকে গলাধাক্কা দিয়ে বিদায় করে দেবে। যেমন ইউরোপ করেছে।