শুধু তা-ই নয়। এ ইমারত গড়ে উঠল আর্য ও সেমিতি সংস্কৃতির অভূতপূর্ব সহযোগিতার ফলে। তাজের চারু-কারুকার্য অস্মদেশীয়, কিন্তু স্থাপত্য-পরিকল্পনা যাবনিক এরকম কথা পণ্ডিতেরা বলেন, আমরাও (অর্থাৎ অর্বাচীনরা) অস্বীকার করি না, কিন্তু ভারতবর্ষের ক-জন দর্শক তাজ দেখে বিস্ময়ে অভিভূত হওয়ার সময় এ সম্বন্ধে সচেতন?
সেইটেই সবচেয়ে বড় কথা এবং সেইটেই আমাদের সবচেয়ে বড় গর্ব। কোনও ইংরেজ বা মার্কিন যখন তাজের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে তখন কোনও হিন্দু তো একথা বলে না, আমাকে শোনাচ্ছ কেন? আমার এতে গর্ব করবার কী আছে? ও জিনিস তো মুসলমানের তৈরি– যাবনিক, ম্লেচ্ছদুষ্ট! (আজ পর্যন্ত এমন মুসলমানও দেখিনি যিনি রবীন্দ্রনাথের প্রশংসা শুনে কানে আঙুল দিয়ে বলেছেন, তওবা, উনি তো হিন্দু!)।
পৃথিবীতে বহু সাধক জন্মেছেন, কিন্তু বিশ্বমৈত্রী প্রচার করাতে যারা দেশ-বিদেশে সম্মান পেয়েছেন তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে বিস্ময়কর কবীর, নানক, দাদু, পল্টদাস এবং অন্যান্য অর্ধশিক্ষিত অশিক্ষিত আউল বাউল সম্প্রদায়। কবীরের চেয়ে বড় সাধক জন্মাননি একথা বলা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। কিন্তু তাঁর সাধনার ধন যখন বিশ্বজন সমক্ষে স্বপ্রকাশ হল তখন সত্যান্বেষীরা বিস্ময় মেনে এই কথাই জিজ্ঞাসা করেছিলেন, এই অশিক্ষিত সাধক সর্বধর্ম সমন্বয়ের সন্ধান পেল কোথায়? হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-জরথুস্ত্রি সব ধর্মকে পক্ষপাতহীন সহৃদয়তায় গ্রহণ করতে হলে যে ঐতিহাসিক, ভৌগোলিক, দার্শনিক পরিপ্রেক্ষিতের প্রয়োজন এ লোক সে দিব্যদৃষ্টি পেল কী করে?
এষাস্য পরমাগতি, এখোস্য পরম সম্পদ, ইহাই পরম গতি, ইহাই পরম সম্পদ, এ সম্পদ ভারতবর্ষ পেল কী করে?
সাধনার ক্ষেত্রে, সংস্কৃতির জগতে ভারতবর্ষ একদিন যে দিব্যদষ্টি পেয়েছিল, যার ফলে তার কাছে আত্ম-পর এক হয়ে গিয়েছিল, যার কৃপায় সর্বসংস্কারমুক্ত হয়ে সে যা কিছু সুন্দর, যা কিছু মঙ্গল, যা কিছু সত্য অনায়াসে গ্রহণ করতে পেরেছিল, আজও সে সম্পদ ভারতবাসীর অবচেতন মনে সুষুপ্ত। সে সত্যযুগ পশ্চাতে ছিল, সে সত্যযুগ সম্মুখেও রয়েছে। আজাদ সাহেবের অদ্যকার প্রচেষ্টাই আমাদের মন সর্বপ্রকার সংশয় থেকে মুক্ত করতে পেরেছে।
এ ভারতভূমিতে যেরকম ইসলাম এসে তার বিকাশ পেল, জরথুস্ত্র ধর্মও এ ভূমিতে এসে আশ্রয় নিল। ঠিক তেমনি একদা এদেশ থেকে বিশ্বজয়ে বেরিয়েছিল বৌদ্ধধর্ম। চীন-জাপানে সে ধর্ম কী বিকাশ, কী পরিণতি লাভ করেছিল তার সন্ধান মাত্র কিছুদিন হল আমরা আরম্ভ করেছি। আত্মম্ভরিতা আমাদের উদ্দেশ্য নয়, তবু বলি যে জিনিস ভারতবর্ষ গ্রহণ করেছে সে সম্বন্ধে সে সচেতন– ইসলামের ভারতীয় ইতিহাস তাই সে অম্লাধিক জানে, কিন্তু যে জিনিস সে বিশ্বজগৎকে দিয়েছে, সে সম্বন্ধে সে সম্পূর্ণ অচেতন।
তাই বলি, ভারতবর্ষ পূর্বদিকে বাহু প্রসারিত করে দিয়েছে, পশ্চিমদিকে বাহু প্রসারিত করে নিয়েছে। সম্বিতে হোক্, অবচেতন অবস্থায়ই হোক, দুয়েরই সঙ্গে তার যোগাযোগ। চীন তো আরবকে চেনে না, আরবও চীনকে চেনে না।
সমস্ত প্রাচ্যের দৃঢ়ভূমি তাই ভারতবর্ষ।
— ওমর খৈয়াম
.
এ-পার গঙ্গা ও-পার গঙ্গা
নদীর এপার যখন নিশ্বাস ছেড়ে বলে ও-পারের মতো সুখ এ-পারে নেই আর ও-পারও যখন ঠিক একই কথা বলে তখন বিচক্ষণ জন বিশেষ বিচলিত হন না। কিন্তু পুব পারের প্রজারা যদি বলে পশ্চিম পারে রামরাজত্ব এবং পশ্চিম পারের প্রজারা যদি বলে পুবের জমিদার শিবতুল্য লোক এবং তদুপরি যদি দুই জমিদারের ভিতর মনের মিল না থাকে তা হলে উভয় পারের জমিদারবাড়িতে সামাল সামাল রব পড়ে যায়। রামের তখন ভয়, পাছে শিব উস্কানি দিয়ে তার জমিদারিতে প্রজা-বিদ্রোহ মাতিয়ে তোলেন, এবং শিব আগের থেকেই আপন প্রজার কিছু কিছু বকেয়া খাজনা মকুব করে দিয়ে শিবতুল্য হওয়ার চেষ্টা করেন। এ-হাল বাবতে বাঙালি মাত্রই ওকিবহাল।
কাজেই জর্মনির পূর্ব-পশ্চিম দু পারের অবস্থা বুঝতে বাঙালিকে কিছুমাত্র বেগ পেতে হয় না। উপরের তুলনাটি পেশ করা মাত্রই বিচক্ষণ জন যেমন টে শুনলেই বুঝতে পারেন টেংরার হাইস্কুলের হেডমাস্টারের মাথার টাকের কথা হচ্ছে ঠিক তেমনি বাঙালি মাত্রই রগড়ের আশায় উফুল্ল হয়ে ওঠে।
পশ্চিম জর্মনির ইংরেজ-মার্কিন-ফরাসি বড়কর্তারা বিনিদ্র যামিনী যাপন করছেন পাছে রায়তরা রাতারাতি রাতুল রুশের উস্কানিতে লাল হয়ে ওঠে, ওদিকে স্তালিনও যে পূর্ব জর্মনির দিল-দরিয়ায় গোসল করবার হেকমত খুঁজে পাচ্ছে না সেটাও লাল হরপেই মাঝে মাঝে ফুটে উঠছে।
এ সমস্যার গর্ভদান করেছিলেন লড়াই শেষ হওয়ার পূর্বে রজোভেল্ট, স্তালিন এবং চার্চিল তিন হুজুরে মিলে। জর্মনিকে দু টুকরো করে কমজোর করার মতলব তিন গাঁও বুড়োতেই করেছিলেন। বেবাক ভুলে গিয়েছিলেন যে, হিটলার একদা জর্মনির মন পেয়েছিলেন অর্ধচ্যুত রাইনল্যান্ডকে সম্পূর্ণ আপন করার জিগির তুলে, জর্মনিকে পাগল করে তুলেছিলেন খণ্ডিত সারল্যান্ডকে ফিরে পাওয়ার লোভ দেখিয়ে এবং শেষটায় ক্ষেপিয়ে তুলেছিলেন পরহস্তগত সুডেটেনল্যান্ড ও ডানৎসিখ কেড়ে নেবার কড়া মদ খাইয়ে। অর্থাৎ জর্মনির সামান্যতম টুকরো তার জাতির অঙ্গ থেকে কেটে ফেললেই জর্মনির সমস্ত শরীর– অর্থাৎ তার পূর্ণাঙ্গ জাতীয়তাবোধ ছিন্ন অঙ্গের জন্য প্রথমটায় ব্যাকুল হয়, তার পর নানা কল-কৌশলে গায়ে গত্তি লাগিয়ে নিয়ে শেষটায় চতুর্দিকে ডাণ্ডা বুলোতে থাকে। তখন তার আর শক্ৰমিত্র জ্ঞান থাকে না। ইংলন্ড, ফ্রান্স, অস্ট্রিয়া, রুশিয়া, কাউকে তখন সে বাদ দিয়ে কথা কয় না। এ হিড়িকে তিন মাতব্বরই যে কী রকম বেধড়ক মার খেয়েছেন তা তাদের গা চ্যাটাস চ্যাটাস শব্দ থেকে আমরা পর্যন্ত স্পষ্ট বুঝতে পারছি।