গল্পটি শুনে আমি অবিশ্বাসীর বিজ্ঞ হাসি হেসেছিলুম। পরে ভেবে দেখলুম, এতে অবিশ্বাসের কিছুই নেই। কোথাও যদি পুলিশ সাইনবোর্ড লাগায় সাবধান, এখানে মালপত্র চুরি যায় আর তার পরও যদি আপনার মাল চুরি যায় আপনি কি তবে পুলিশকে গিয়ে ধরবেন যে তারাই মাল চুরি করেছে? (পুলিশের কাছে মাফ চেয়েই বলছি, ভারতবর্ষের কথা আলাদা, আমি অন্যান্য বর্বর দেশের কথা ভাবছি)।
শিরোনামায় বলেছি রাষ্ট্রভাষা। আপনি ঘড়েল পাঠক। নিশ্চয় এতক্ষণে ধরে ফেলেছেন আমার নলটা কোনদিকে চলেছে। হিন্দি রাষ্ট্রভাষা হয়ে গিয়েছে। সহি বাৎ। আমার তাতে কোনও আপত্তি নেই। একটা কেন, পঞ্চাশটা রাষ্ট্রভাষা চালান, আমি বড়ম্বরে সায় দেব। আমি তো আর কেন্দ্রে গিয়ে নোবাবির সন্ধান করব না, কিংবা মন্ত্রণাসভায় লম্বা লম্বা ভাষণ ঝাড়বো না যে হিন্দি রাষ্ট্রভাষার নোকরি পেয়ে গিয়েছেন শুনে বৈধব্য দুঃখে হবিষ্যান্নি আরম্ভ করব?
রাষ্ট্রভাষার যে প্রয়োজন আজ সেটা উপস্থিত না হয় মেনেই নিলুম এবং হিন্দি রাষ্ট্রভাষা হয়েছে তাতে আমার আপত্তি নেই। আমার শুধু সবিনয় নিবেদন, যেসব প্রদেশে হিন্দি প্রচারিত নয়, যেমন ধরুন বাঙলা, কিংবা অন্ধ্র, কিংবা তামিলনাড়ু সেসব দেশের লোককে জোর করে হিন্দির কলমা পড়াতে যাবেন না, কারণ পূর্বেই নিবেদন করেছি, দুটো ভাষা শিখতে পারে অল্প লোকেই।
উত্তরে আপনি বলবেন, কেন, মশায়, আমাদের অনেকেই তো ইংরেজি-বাঙলা দু ভাষাতেই খাসা বক্তৃতা ঝাড়তে পারেন!
আমি বলব, ইংরেজিতে আমরা বক্তৃতা দিয়েছি আপসে অর্থাৎ আপনজনের ভিতরে। দহরম মহরম বোঝাতে গিয়ে ফ্যামিলি ওয়ে বলেছি, ট্রেন মিস করার উল্লেখ করতে গিয়ে মিস ক্যারেজ বলেছি তাতে কোনও ব্যাকরণ অশুদ্ধ হয়ে যায়নি। কারণ, যে দু চারটি ইংরেজ সভাস্থলে উপস্থিত থাকতেন তারা নানা প্রকারের পিজিন ইংলিশ শুনে শুনে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলেন; আমাদের ইংরেজি নিয়ে মস্করামো করতেন না। কিন্তু লালাজি দুবেজি পড়েজিরা, আমাদের টোটি-ফোটি হিন্দি শুনে তুষ্ণীভাব অবলম্বন করবেন, না মুখ ফিরিয়ে একটুখানি ফিক করে হেসে নেবেন ঠিক এঁচে উঠতে পারছি নে। লক্ষ্ণৌ দেহলি কি হিন্দি, সাহেব, বড়ি ঠাটকি হিন্দি,– মজাককি বাৎ নহি!
বিলক্ষণ, বিলক্ষণ। মোটেই মজাক করছিনে। যে মন্ত্রণাসভায় দেশের দশের ধনপ্রাণ নিয়ে আলোচনা হবে সেখানে মস্করা করতে যাবে কে?
তাই বারান্তরে আলোচনা করার বাসনা রইল, যেসব দেশে বহু ভাষা প্রচলিত সেসব দেশ এ সমস্যা সমাধান করেছে কী প্রকারে। ততদিনের জন্য জয় হিন্দ এবং
জয় হিন্দ। — ওমর খৈয়াম
.
ত্রিবেণী
ভারত ও এশিয়ার অন্যান্য দেশের মধ্যে সাংস্কৃতিক সম্পর্ক দৃঢ় করিবার উদ্দেশ্যে ভারতের শিক্ষাসচিব মৌলানা আবুল কালাম আজাদের সভাপতিত্বে এশিয়ার বিভিন্ন দেশের কূটনৈতিক প্রতিনিধি, ভারতের বিশিষ্ট শিক্ষাব্রতী ও মুসলিম নেতৃবৃন্দের এক সম্মেলন হয়। এই সম্মেলনে বিভিন্ন দেশের সহিত সাংস্কৃতিক সহযোগিতা রক্ষাকল্পে একটি ভারতীয় পরিষদ গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হইয়াছে।
এ খবর পড়ে বিদগ্ধজন মাত্রই আনন্দিত হবেন এবং আমার বিশ্বাস বাঙালি এ আহ্বানে সাড়া দেবে সবচেয়ে বেশি কাজ করার সুযোগ পাবে কি না, সেকথা তুলে এই মঙ্গলের দিনে দ্বন্দ্ব-কলহের সূত্রপাত করতে চাইনে। বাঙালি কেন এ আহ্বানে সবচেয়ে বেশি সাড়া দেবে সেকথা আরেক দিন হবে উপস্থিত ভারতবর্ষই কেন এ প্রকারের সাংস্কৃতিক যোগাযোগের চক্রবর্তী হবে, সে আলোচনা করা যাক।
প্রাচ্যলোকে তিনটি ভূখণ্ড পৃথিবীতে যশ অর্জন করেছে। আরব-ভূমিতে দুটি ধর্মের অভ্যুদয় হয়। খ্রিস্টধর্ম ও ইসলাম এবং এ দুটি ধর্ম যে প্রাচীনতম ইহুদি ধর্মের ওপর প্রতিষ্ঠিত, তারও বিকাশ হয়েছে আরব-ভূমির অন্যতম কেন্দ্র জেরুজালেমে।
দ্বিতীয় ভূখণ্ড ভারতবর্ষ। এখানে সনাতন, বৌদ্ধ ও জৈনধর্মের উৎপত্তি ও বিকাশ।
তৃতীয় ভূখণ্ড চীন (এবং জাপানকে নিয়ে মঙ্গোলভূমি) কনফুসীয়, লায়োসে প্রচলিত পন্থাকে ধর্ম বলা যায় কি না, সে সম্বন্ধে সন্দেহ আছে, কিন্তু আমরা এখানে যে ব্যাপক অর্থে ধর্ম শব্দটি ব্যবহার করছি, তার প্রধান উদ্দেশ্য ধর্মকে সর্বপ্রকারের সংস্কৃতি ও বৈদগ্ধ্যের প্রস্থানভূমিরূপে অবলোকন করা।
সর্বশেষে আরেকটি ধর্মের উল্লেখ করা প্রয়োজন। আরব ও ভারতবর্ষের মধ্যবর্তী ভূখণ্ডের বল্খ (সংস্কৃত বহিক) নগরে জরথুস্ত্র আপন ধর্ম প্রচার করেন ও ইরানি আর্য রাজা শুশতাশ্মকে এই নবধর্মে দীক্ষিত করেন।
ভৌগোলিক দৃষ্টিবিন্দু থেকে দেখতে গেলে ভারতবর্ষ প্রথম ও তৃতীয় ভূখণ্ডের মধ্যবর্তী একদিকে বল (ইরান) ও আরবভূমি, অন্যদিকে চীন-জাপানের মঙ্গোলভূমি এবং সে যে শুধু মধ্যবর্তী তাই নয়– সর্ব বৈদগ্ধের চক্রবর্তীও বটে।
মুসলমান ধর্ম জন্ম নিল আরবভূমিতে, ইরানে সে ধর্ম সুফি মতবাদের সহায়তায় পুষ্ট হল, কিন্তু ভারতবর্ষে এসে মুসলিম বৈদগ্ধ্য যে বিকাশ ও পরিণতি পেল তার সঙ্গে কটি মুসলিম দেশ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারে? মিশরের ইবনেতুলুন মসজিদ অতি রমণীয়, জেরুজালেমের ওমর মসজিদ এবং মসজিদ-উল-আকসা স্থাপত্যের গর্বরূপ, বুখারা-সমরকন্দও চেঙ্গিস তিমুরের কীর্তি বক্ষে ধারণ করেছে, কিন্তু তৎসত্ত্বেও এ পৃথিবীর কে না জানে তাজমহলের বাড়া ইমারত পৃথিবীর আর কোথাও নেই।