মুসোলিনিও ইতালিকে শক্তিশালী করেছিলেন জনমতের কণ্ঠরুদ্ধ করে। কিন্তু লড়াই লেগে যাওয়ার পর তিনি যুদ্ধের পক্ষে জনমত গড়ে তুলতে পারলেন না। কারণ তাঁর গোয়ালে কোন গ্যোবেলস বাধা ছিল না। তাই যুদ্ধের মাঝামাঝিই ইতালির সর্বত্র দেখা যেত মুসোলিনি-বৈরী জনমতের নোটিশ লাগানো রয়েছে, যুদ্ধে যোগ দিয়ে ভারতবর্ষ দেখে নাও! অর্থাৎ লড়াইয়ে যোগ দিলে তোমাকে লিবিয়ায় যেতে হবে। সেখানে লড়াইয়ে হেরে ইংরেজের হাতে ধরা পড়বে। ইংরেজ তোমাকে ভারতবর্ষের বন্দিশিবিরে পাঠিয়ে দেবে। ব্যস! ফোকটে ভারতবর্ষ দেখা হয়ে গেল। আর ভারতবর্ষ দেখবার নামে ইতালির লোক অজ্ঞান।
মোদ্দা কথা তা হলে এই; জনমতের টুটি চেপে ধরলে দেশটাকে ঝটপট শক্তিশালী করা যায় কিন্তু যখন মার আসে তখন আর সামলানো যায় না। এই তত্ত্বটিই পূর্ববঙ্গের একটি প্রবাদে শুনেছি :
একলা ঘরের বউ-ঝি খেতে বড় সুখ।
মারতে গেলে ধরবে কে? ঐ বড় দুখ।
অর্থাৎ যে বাড়িতে শ্বশুর, ভাশুর, দেবর নেই সে বাড়ির একা বউ মনের আনন্দে যা খুশি রান্না করে খায়, কিন্তু যখন কিল মারার গোসাই সোয়ামি বউকে ঠ্যাঙাতে আরম্ভ করেন তখন তাঁকে ঠেকাবার জন্য শ্বশুর-ভাশুর কেউ নেই– এই হল বেদনা।
কিন্তু আমরা ভারতবাসী একান্নপরিবারে বিশ্বাস করি। তাই আমাদের বিশ্বাস কংগ্রেসও জনমত গড়ে তুলতে চাইবেন।
চান আর না-ই চান, আপনি-আমি তো আর চুপ করে বসে থাকতে পারিনে। কী করা যায়?
প্রথমত শিক্ষার ভিতর দিয়ে, অর্থাৎ স্কুল-কলেজে শিক্ষার বিষয়বস্তু এবং পদ্ধতির আমূল পরিবর্তন করে।
কিন্তু ততদিন কি জনমত তে-ঠ্যাঙা রেস রান করবে?
না। খবরের কাগজ রয়েছে। এ যুগসন্ধিক্ষণে সত্যযুগাকাক্ষী খবরের কাগজ মাত্রেরই দায়িত্ব অসীম।
–ওমর খৈয়াম
.
রাষ্ট্রভাষা
গল্পটা অতি পুরনো তাই আরেকবার বললে ক্ষতিবৃদ্ধি হবে না।
চাটুয্যে এসেছেন শ্রাদ্ধের নেমন্তন্নে স্মোকিং জ্যাকেট পরে। আনকোরা ইভনিং স্যুট। হালে বিলেত থেকে ফিরেছেন তাই।
বাঙ্গালাতেই কথাবার্তা হচ্ছিল। চাটুয্যে বললেন, কিছু মনে করবেন না, আমি বাঙলাটা তেমন ভালো বলতে পারিনে। সবাই চুপ। শেষটায় মুখুয্যে বললেন, তাই তো বড় বিপদে ফেললে হে চাটুয্যে, ইংরিজিটাও জানেন না, কী করা যায় বলো।
অর্থাৎ দু নৌকোয় পা দিলে মধ্যিখানে পড়ে যাবার সম্ভাবনাই বেশি।
কিংবা বলতে পারেন, এ সংসারের অধিকাংশ লোকই একটার বেশি ভাষা শিখতে পারে না (সাহিত্যিকরা বলবেন, একটা ভাষাই-বা কটা লোকে ঠিকঠিক শিখতে পারে বলো, কিন্তু এখানে উচ্চাঙ্গ বঙ্গভাষা নিয়ে রঙ্গরসের কথা হচ্ছে না)। এবং তাই নিয়ে এ পৃথিবীর গুরু সম্প্রদায়ের ভিতর শিরঃপীড়ার অন্ত নাই। আমেরিকা, ইংলন্ড, ফ্রান্স যে কোনও দেশ-মহাদেশের শিক্ষা বাবদীয় মাসিক পত্রিকা খুললেই দেখতে পাবেন সেই প্রাচীন সমস্যা নিয়ে পুনরপি আলোচনা : সেকেন্ড ল্যাগুইজ শেখানো কী প্রকারে সফল করা যায়?
আমেরিকায় লক্ষ লক্ষ ডলার খরচা করে লক্ষ লক্ষ ছেলেমেয়েকে ফরাসি, জর্মন শেখানো হয়, ইংলন্ডেও তাই, ছেলেমেয়েরা লেটার পেয়ে পরীক্ষা পাসও দেয় কিন্তু গর্বান্ধ বাপ-মায়েরও অন্ধত্ব ঘুচে যায় যখন দেখেন ছেলে ক্যালে বন্দরে পোর্টারকে ফরাসি ভাষায় সামান্য প্রশ্নটুকু জিগ্যেস করতে পারছে না, পারিসের ট্রেন ছাড়বে কটায়, কোন প্ল্যাটফর্ম থেকে। দেখেন, ছেলের প্রশ্ন শুনে ফরাসি পোর্টার প্রথমটায় মাথা চুলকোয়, তার পর মুখ থেকে পাইপটা নামায়, তার পর হঠাৎ তার মাথায় কী একটা খেয়াল খেলে যাওয়ায় চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, তার পর আর এক বেরাদর পোর্টারকে চেঁচিয়ে বলে, হে জ্যা, ভিয়ানিসি, ভোয়ালা আঁ মসিয়ো কি পার্ল আংলো–অর্থাৎ হেই জন, এদিকে আয়, এক ভদ্রলোক হেথায় ইংরেজি বলছেন। বাপ-মার চক্ষুস্থির, ছেলের মুখ চুন। কিন্তু কেলেঙ্কারিটার শেষ এইখানেই নয়। জ্যাঁ আসবে, ইংরেজি বলবে এবং সে ইংরেজি বাপ-ব্যাটা কেউই বুঝবে না।
হামেশাই এ ব্যাপার দুনিয়ার সর্বত্র হচ্ছে। প্যারিসে রাস্তা হারিয়ে ফেলেছেন; ফিটফাট ভদ্রলোক, লম্বা দাড়ি অধ্যাপক, পাততাড়ি বগলে স্কুলের ছোকরা সবাইকে বুজুর বলে জোর করে দাঁড় করাচ্ছেন, অতিশয় কমনীয় নমনীয় ইংরেজিতে কিংবা আপনার অতি নিজস্ব মেড ইন ইন্ডিয়া (কিংবা ইংলন্ড) মার্কা ফরাসিতে জিগ্যেস করছেন, প্লাস দ্য লা মাদলেন। কোথায়? ফলম? সর্বং শূন্যং!
কিংবা হাম্বুর্গে। ইংরেজি ছাড়ুন, ফরাসি ছাড়ুন, জর্মন ছাড়ুন। যা ইচ্ছে তাই, কিংবা যাচ্ছেতাই। ইয়া, ইয়া, ইয়েস, ইয়েস, নো, নো, আন্দারস্তেন্দ নৎ। সরি, সরি গুদ মর্নিং! হয়ে গেল আপনার পায়ে হাঁটার অভিযান। মনে মনে কানমলা খেয়ে প্রতিজ্ঞা করলেন, আর ট্রামবাসে পায়ে হেঁটে ইয়ার্কি মারা নয়, এখন থেকে শুধু ট্যাক্সি, যেখানে যাবার যাব আর আসব, কারও সঙ্গে স্পিকটি নট।
অথবা আরেকটি গল্প নিন। আমার বক্তব্য আরও খোলসা হয়ে যাবে। এক ফরাসি দোকানের সামনে বড় বড় হরফে লেখা, ইংলিশ স্পোকেন। তাই দেখে আপনার-আমার মতো ভাষা বাবদে একংজিহ্ব (মনোগ্নট) জনৈক ইংরেজ সেই দোকানে ঢুকে গড়গড় করে ইংরেজি বলে কী একটা কিনতে চাইল। দোকানদার উত্তর দেয় যেন ফরাসিতে। ইংরেজ শুধায়, ফরাসি কও কেন? ইংরেজি বলতে পারো না? সাইনবোর্ডে লিখে রাখোনি ইংলিশ স্পোকেন? সাইনবোর্ডের দিকে আঙুল দিয়ে দেখানোতে দোকানদার মামলাটার আন্দেশা করতে পারল। অনেক ধস্তাধস্তি, বহুৎ হোঁচট খেয়ে ফরাসি-ইংরেজিতে আইরিশ স্টু বানিয়ে যা বললে তার অর্থ, ঠিকই তো, ইংলিশ এখানে বলা হয়। আমাদের খদ্দেররা ইংরেজি বলেন, আমরা কিন্তু ফরাসিই বলে থাকি। দোকানদারকে দোষ দিয়ে কী হবে, সে তো আর লেখেনি, উই স্পিক ইংলিশ, সে লিখেছে, ইংলিশ স্পোকেন।