[*পুনরায় ইবসেনের নাটকগুলো তো একদিন কম আদর পায়নি, কিন্তু এখনই কি তার রঙ ফিকে হয়ে আসেনি?সাহিত্যের মাত্রা, সমগ্রন্থ পৃ. ২৬০।]
উত্তম গ্রন্থের চুম্বক দেওয়া, বিশ্লেষণ করা, তুলনাত্মক সাহিত্যের দৃষ্টিবিন্দু থেকে তাকে ওই জায়-এর আর পাঁচখানা বইয়ের সঙ্গে তুলনা করা নিষ্প্রয়োজন; পরিচয় করিয়ে দেওয়া যায় মাত্র। কিন্তু সে-পরিচয় দেওয়ার সময়েও লেখক অবধূতের সর্বকালীন ও আমার জানা মতে তাঁর সর্বাগ্রগণ্য গুণমুগ্ধ পাঠক হিসেবে– এ-পরিচিতি দেবার হক্ক আমার একান্ত, অন্তত সেই কারণেই অধমের মনে ধোকা লাগে, মিছরির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে গিয়ে তার সুতোটার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি না তো? কে জানে, আমি যে-সূত্রটি ধরে এ-পরিচিতি পেশ করেছি সেটা অতি অবশ্য সূত্র বটে, কিন্তু হয়তো ওই মিছরির সুতোরই মতো! সুতো চিবিয়ে তো কোনও পাঠক মিছরির রস পাবেন না! সান্ত্বনা এইটুকু যে, বহুশত বছর ধরে অম্মদেশীয় আলঙ্কারিকমণ্ডলী কালিদাসের পরিচিতি দিতে গিয়ে লিখেছেন এবং সেটিকে অজরামর করার হেতু গদ্যে প্রকাশ না করে শ্লোকাংশে বেঁধেছেন, উপমা কালিদাসস্য। তাঁদের মতো অমুকের কাছে যাওপদলালিত্যের জন্য, অমুকের কাছে যাওঅর্থগৌরবের তরে– আর কালিদাস? ওহ্! তার উপমাটি উত্তম; এবং তাদের শেষ সুচিন্তিত আপ্তবাক্য, সর্বগুণসম্পন্ন কবি কিন্তু মাঘ! আজ আমরা জানি, সুদ্ধমাত্র তুলনার বাহাদুরি দেখিয়ে কেউ মহৎ কবি হতে পারেন না– উত্তম তুলনা দিতে পারা গুণটি অলঙ্কারশাস্ত্ৰপেটিকাসতি একটি নিরাড়ম্বর অলঙ্কার মাত্রই, এবং এ সাদামাটা তুলনা-অলঙ্কারের কথা দূরে থাক, সর্বোৎকৃষ্ট অলঙ্কার পরিয়েও কুরূপাকে সুরূপাতে পরিবর্তিত করা যায় না–কালিদাস ছিলেন সর্বগুণসম্পন্ন অলঙ্কারাতীত বিশ্বকর্মা, তুলনা-নির্মাণে দক্ষতা ছিল তাঁর সামান্যতম কৃতিত্ব।…তাই এ-স্থলে আমি যে পরিচিতি দিলুম সেটা হয়তো কালিদাসের বেলায় গোড়াতে যে-রকম হয়েছিল সেই রকম নিতান্তই আত্যন্তিক, ঐকান্তিক, অবান্তর, গুরুত্বহীন পরিচয়। কিন্তু ভরসা রাখি, কালিদাসের মতো বিশ্বকর্মা না হয়েও অবধূত ভবিষ্যতে একদিন কালিদাসের মতো সুবিচার পাবেন, কারণ ন্যায়াধীশ-মহাকালের সম্মুখে সবাই সমান।
মহাকালের দরবারে কালিদাস অবধূত বরাবর– এ কথাটা আমাকে পুনরায় বলতে হল। কারণ আমি জানি, একাধিক জন, এমনকি অবধূতের গুণী গাহকও ঈষৎ ভ্রু কুঞ্চিত করে শুধোবেন, আমি যে এক নিশ্বাসে চেখ, কালিদাস ইত্যাদি প্রাতঃস্মরণীয়দের সঙ্গে অবধূতের নামোচ্চারণ করি তার অর্থ কি এই যে, আমার মতে এঁরা সবাই সমগোত্রের! এর উত্তর যে কোনও অদ্য দিনের চোদ্দ ক্যারেটের আলঙ্কারিক, যে কোনও বটতলার চতুরানন চতুর-আনী মোক্তার চতুর্মুখে চতুর্ভদ্র সাফাই গাইতে পারবেন কিন্তু আমার এ সবেতে কোনও প্রয়োজন নেই। অধীনের নাক বরাবর অতিশয় সুচিন্তিত তথা অলঙ্কারশাস্ত্রসম্মত নিবেদন মাত্র একটি : অবধূত কেন, তার চেয়ে শতগুণে নিরেস কোনও কবিকেও যদি আজ অধিক পরিচয় করিয়ে দিতে চাই এবং প্রয়োজন-অনুরোধে তৃতীয় পক্ষের দোহাই কেটে তাকে/তাদেরকে আবাহন জানাতে হয়, তবে কি আমি বে-ওফ নাদানের মতো স্মরণ করব পাড়ার আকাট যেদো-মেদোকে? না, গঙ্গাস্বরূপা তৃতীয় কন্যা মাতা কুন্তীদেবীর অনুকরণে স্মরণ করব ধর্মরাজ, পবমেশ্বর, বাসবাধিপতিকে? কালিদাস, চেখফ, রবিকবিকে? না, বিবাহবাসরেরপ্রীতি-উপহার-রচক পোয়েট লরিয়েটকে, দাস্যমনোবৃত্তি-সঞ্জাত অধুনা-বিস্মৃত, ভি.আই.পি. কুলের চরম পদলেহনাবতার ভি.আই.পির ঘোষ কবিকে? অবশ্য, অতি অবশ্য, যদি অবধূত মহাকালের মোকদ্দমা হেরে যান (যদ্যপি আমার বিশ্বাস ধর্ম, বায়ু, ইন্দ্রকে সাক্ষীরূপে না ডেকে যেদো-মেদোকে ডাকলে মক্কেল অবধূত মোকদ্দমা তো হারবেনই, এস্তক সুপ্রিমকোর্টে আপিল করবার তরে সার্টিফিকেট অবধি পাবেন না!) তবে সম্পূর্ণ দোষ আমারই। আমি যে-কেস হাতে নিয়েছি সেটি মর্মান্তিক। কারণ অবধূত আমাকে বাংলা সাহিত্যের হট্টগোলের মাঝখানে তার নাম সুউচ্চ কণ্ঠে ঘোষণা করার জন্যে মোক্তার পাকড়াননি। বস্তুত আমিই সম্পূর্ণ, স্বেচ্ছায়, আপন খুদ, খুশ-এখতেয়ারে, অবধূতের সত্য মূল্য নিরূপণার্থে, সাহিত্য আদালতের নিরপেক্ষ বন্ধু, আমিকু কুরিআত্রারূপে অবতীর্ণ হয়েছি। সে-স্থলে হয়তো অবধূত বাধা দিতে পারতেন কিন্তু তিনি এবাবদে সুবুদ্ধিমান বলে সাহিত্যিক, দেওয়ানি, ফৌজদারি সর্বআদালত এড়িয়ে চলেন। এটিএক্স পার্টি, এক-তরফা মোকদ্দমা।
কিন্তু আদালতের তুলনাটা কথায় কথায় উঠল। বঙ্কিমেররাজসিংহ, রবিকবিরযোগাযোগ কোনও আদালত বিচার করবে না। নীলকণ্ঠও কোনও এজলাসের সম্মুখে দাঁড়াবেন না!* সাহিত্যে সর্বকালের সর্বজনের সর্বশ্রেষ্ঠ বিচারক পাঠক স্বয়ং। আদালতের বাইরে আমিও নগণ্য পাঠক। সে কিরে আমি এ-প্রস্তাবনার প্রস্তাবনাতেই একাধিকবার কেটেছি। এবং আমি অতিবৃদ্ধ পাঠক বলে একাধিক নবীন পাঠক আমাকে শুধোবে,
নীলকণ্ঠ বইখানা ভালো?
অত্যুত্তম।
সর্বোত্তম?
এতাবৎ লিখিত বইয়ের মাঝে সর্বোত্তম, কিন্তু এ-কেতাব সর্বোত্তম হবে না, যদি ইটি সমাপ্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে তাঁকে অনুপ্রেরণা না যোগায় যে এটাকেও পেরিয়ে গিয়ে তিনি আরও উত্তম কেতাব লিখতে পারেন।