**লর্ড কেদারনাথ সম্বন্ধে আমার এক মুখুজ্যে ভাতিজাও লেখে ঠাকুর দেখতে তেমন কিছু না, কিন্তু সন্ধেবেলায় যখন ডিনারের ইভনিং জ্যাকেটটি পরেন তখন বড্ডই মাইডিয়ার দেখায়। তবে কেদার না হয়ে ইনি পথমধ্যের অন্য কোনও লর্ডও হতে পারেন। ]
কেদারবদ্রী-গামীর কাফেলা তো চোখের সামনে দিয়ে যাচ্ছেই– তার এবং মানসাদি বহু তীর্থযাত্রীর বর্ণনা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দিয়েছেননীলকণ্ঠের বহু বহু পূর্বের বিস্তরজরিন-কলম বাঙালি, ইংরেজি, জর্মন, ইতালিয়ান ইত্যাদি লেখক আপন আপন মাতৃভাষায় কিন্তু নীলকণ্ঠে চলেছে অবধূতের বাছাই করা আরেকটি চরিত্রের কাফেলা, হেঁটমুণ্ড সাধক, যশোমতী, মেমসায়েব যাদের কয়েকজনের উল্লেখ এইমাত্র করেছি; কিন্তু হায়, অবধূত, রসসৃষ্টিতে হদ্দ কোথায় সেটা শনাক্ত করে ফেলেছেন এবং আমাদের কৌতূহল যখন চরমে পৌঁছায়, আমরা কলরব তুলে শুধধাই, এটা কী করে হল? তার পর কী হল? তখন তিনি মৃদু হাস্য করে স্টপস্ ইটিং বিকজ ইট ইজ টেস্টিং। মাথা চাপড়ে বলতে ইচ্ছে করেপোড়া কপাল আমাগো। লাঙ্গুলবারিয়ার জীতেন সাধুর লগে লগে আর বেবাকগুলির নামডাক ভি ভালো কইরা বুঝাইয়া কইলা না, কতা!
কটাক্ষ করা এ-পাঠকের উদ্দেশ্য নয়, কিন্তু মনে প্রশ্ন জাগে, কবিগুরু কি ক্লেরভইয়াসের দৃষ্টি দিয়ে দেখতে পেয়েছিলেন যে, তাঁর পরিনির্বাণের স্বল্পকাল মধ্যেই এই গৌড়ভূমিতে তিন-তিন হাজারি পাঁচ-পাঁচ হাজারি পাতার মনসব নিয়ে পিলপিল করে বেরুবেন উপন্যাসের আমীর-ওমরাহ-কেতাব নয়, পুঁথি নয়, আস্ত এক-একখানা ইটের থান, না তারই পাঁজা হাতে নিয়ে এবং এদেরই উদ্দেশে বলেছিলেন মানবের প্রাণের লয়টাকে দানবের লয়ে সাধনা করা চলছে। কিছুতেই তাল পৌঁছচ্ছে না শমে।* অবধূত শমে পৌঁছতে জানেন। তিনি-নিজেই এক জায়গায় আধারহস্যছলে বলেছেন- কারণ সোজাসুজি ধর্মোপদেশ তিনি দেন না, নীতিও প্রচার করেন না- সাক্ষাৎ অমৃত কি না! খাঁটি অমৃত কি আর তাড়ির মতো ভাঁড় ভাড় খেতে হয়? কারণ এর হদিস্-সবুত রয়েছে তাঁর, আমার, আপনার গুরু রচিত পাতঞ্জলের যোগসূত্রের ন্যায়সাহিত্যের সূত্রাবলিতে : উপকরণের বাহাদুরি তার বহুলতায় অমৃতের সার্থকতা তার অন্তর্নিহিত সামঞ্জস্যে। আর্টেরও অমৃত আপন সুপরিমিত সামঞ্জস্য।** এ তত্ত্বটি বুঝে নিলে অবধূতের বাংযম পাঠককে গভীরতম আনন্দ দেবে– আপনা কল্পনাজাল বোনার পথ দেখিয়ে দেবে।
[*,** রবীন্দ্রনাথ, সমগ্রন্থ]
এ-বাবদে শেষ প্রশ্ন : নীলকণ্ঠে তথাকথিত অলৌকিক কারখানা, ধর্মের নামে নিকৃষ্টতম পাপাচার, লাঙ্গুলবারিয়ার জীতেন সাধুর পন্থা, মাজোকিস্ট ভোয়াইওর বিদুর বাবার পন্থা পাতার পর পাতায় প্রাচীন নবীন একটার পর আরেকটা সমস্যা যেন পান্ডোরার কৌটো থেকে বেরিয়ে ওই কালীকমলীচটির বেশুমার ছারপোকারই মতো– চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ছে, এবং সর্বাপেক্ষা মহামোক্ষম সমস্যা যেটি স্বয়ং অবধূতই তুলেছেন তিনটি শব্দ দিয়ে, যদ্যপি একটিই যথেষ্ট হত (তাজ্জব মানতে হয়, লোকটা কী সরল, কীনাইফ এরকম সিংহের গহ্বরে মাথা গলায়!) এবং যার উল্লেখ আমি পূর্বেই করেছি সেটি আবার বলি– শোনা জিনিসই মানুষ ফের শুনতে চায় অনেকের কাছে সন্ন্যাসীরা হলেন পরম পবিত্র রহস্যময় জীববিশেষ। তার পর বলছেন, সত্যিই কি তাই! (তিনি অনায়াসে প্রথম শব্দটি মাত্র দিয়ে, তা-ও শেষেরইটি খারিজ করে দিয়ে লিখতে পারতেন, সত্যি!–কারণ ফারসিতে বলে দানিশমন এক ই ব্যস আস্ত বুদ্ধিমানের জন্য একটিমাত্র হরফই যথেষ্ট সমুচাল এন্তের (লজো) তফাজিল-ফজুল– বস্–এন্তের। কিন্তু আমার মতো অগা পাঠকও এন্তের। আমার মাথায় নিদেন তিনটে শব্দের তিনটে ডাঙশ মারলে তবে কি না একটা শব্দ মগজে সিঁধিয়ে ঘিলুর ঘিয়ে ভাজা হয়)।
সে-প্রশ্নের উত্তর? সে-সমস্যার সমাধান? এবং বাদবাকিগুলো?
এবার আর ফোনের মিসিবাবা না– এবারে উচ্চতর পর্যায়ে যাই। বিচারপতি পন্টিস পিলাটুসের (জেস্টিং পাইলেট) সওয়ালে খ্রিস্ট যখন বললেন, আমি এসেছি সত্য প্রতিষ্ঠিত করতে। তখন পিলাটু শুধোলেনসত্য কী? হোয়াট ইজ টুথ? এবং খ্রিস্ট কোনও উত্তর দেবার পূর্বেই (উত্তর পাবেন কি না তার প্রতীক্ষা না করেই) কেউ কেউ বলেন, স্মিতহাস্য করে বিচারালয় ত্যাগ করলেন।*
[*আসলে পিলাটুস উচ্চশিক্ষিত খানদানি রোমবাসী, ইংরেজ ভাইসরয়দের মতো পরাধীন ইহুদিদের ওপর শাসন করতে এসেছেন জেরুজালেমে। তাবৎ গ্রিকদর্শন তার নখাগ্রদর্শনে এবং সোক্রাতেস যখন প্রশ্নে প্রশ্নে তথাকথিত পণ্ডিতজনকে না-জবাব করে দিতেন এবং পণ্ডিত শেষটায় বিভ্রান্ত হয়ে শুধাত, তা হলে তুমিই বল সত্য কী?–সোক্রাতেস তখন মৃদুহাস্য করে চলে যেতেন বা বলতেন আম্মা জানিনে! এ-সব তত্ত্ব পিলাটুস জানতেন, এবং আরও ভালো করেই জানতেন, ইহুদিদের ভিতর দর্শনের কোনও চর্চা নেই। তাই সত্য-এর স্বরূপ নির্ণয় তিনি রাসৃটিক, সরল-বিশ্বাসী খ্রিস্টের কাছ থেকে চাননি।]
এখানেও তাই। অবধূত শুধোচ্ছেন বা/এবং বিস্ময় প্রকাশ করে বলছেন, সত্যি? এবং ওইখানেই দিলেন খতম করে। কিংবা মুলতুবি সিনে ডাইই। কেন?
আবার তা হলে গুরুপদপ্রান্তে বসি। তিনি প্রবলেম ও তস্য পাণ্ডিত্যপূর্ণ, আকছারই দম্ভে প্রকম্পিত সলুশন্-বিজড়িত কাব্য উপন্যাসাদি সম্বন্ধে বলছেন, মেঘদূত কাব্য থেকে একটা তত্ত্ব বের করা যেতে পারে, আমিও এমন কাজ করেছি, কিন্তু সে তত্ত্ব অদৃশ্যভাবে গৌণ।… কাব্য হিসেবে কুমারসম্ভবের যেখানে থামা উচিত সেখানেই ও থেমে গেছে, কিন্তু লজিক হিসেবে প্রবলেম হিসেবে (আমার সমস্যা হিসেবে) ওখানে থামা চলে না। কার্তিক জনুগ্রহণের পর স্বর্গ উদ্ধার করলে তবেই প্রবলেমের শান্তি হয়। কিন্তু আর্টে দরকার নেই প্রবৃলেমকে ঠাণ্ডা করা, নিজের রূপটিকেই সম্পূর্ণ করা তার কাজ। প্রবলেমের গ্রন্থিমোচন ইটেলেটের বাহাদুরি, কিন্তু রূপকে সম্পূর্ণতা দেওয়া সৃষ্টিশক্তিমতী কল্পনার কাজ। আর্ট এই কল্পনার এলেকায় থাকে, লজিকের এলেকায় নয়।* অবধূত এ তত্ত্বটি হৃদয়ঙ্গম করেছেন। নীলকণ্ঠ তার প্রকৃষ্টতম নিদর্শন।