বিশেষ করে আমি একটি বিষয়ের দিকে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করি। ফারসি অলঙ্কারশাস্ত্রে আছে– সার্থক রস-সৃষ্টি করতে হলে চাই শনাখৃত-ই-হদ্দ-হচি। অর্থাৎ শনাক্ত করতে পারা (শনাখৃত) প্রত্যেক বস্তুর (হচিজ) সীমা (হদ্দ)* তার বিগলিতাৰ্থ; প্রচণ্ডতম আত্মসংযম। বার বার ভুলে যাই আমরা সব কিছু বলতে গেলে কিছুই বলা হয় না; বার বার প্রলোভন** আসে, আরও একটুখানি বলে নিই; তা হলে কেচ্ছাটার আরও জেল্লাই বাড়বে। শৈলী ভাষা বাবদে পার্ফেক্ট আর্টিস্ট হাইনে পর্যন্ত প্রথম যৌবনে এ-প্রলোভন থেকে মুক্ত ছিলেন না। তিনি তাঁর শুরু, সংস্কৃতে সুপণ্ডিত, আলঙ্কারিক বারন (ব্যারন্) ফন্ শ্লেগেলের কাছে তার প্রথম কবিতাগুচ্ছ নিয়ে গেলে তিনি বলেছিলেন, এ কী! তোমার বল্লভার গালে অতগুলো তিল দিয়েছ কেন? হায়, আমরা বার বার হদ্দ শনাক্ত করতে পারিনে, ভাবি তিল যখন সৌন্দর্য বৃদ্ধি*** করে তখন এঁকে দিই মানসসুন্দরীর গণ্ডদেশে গণ্ডাদশেক তিল!
[*রসের সৃষ্টিতে সর্বত্রই অত্যুক্তির স্থান আছে, কিন্তু সে অত্যুক্তিও জীবনের পরিমাণ রক্ষা করে তবে নিষ্কৃতি পায়। রবীন্দ্রনাথ, রচনাবলী, ২৭ খণ্ড, পৃ. ২৮৪। পুনরায়, প্রাণের ধর্ম সুমিতি, আর্টের ধর্মও তাই। সমপুস্তক, পৃ. ২৬০।
** লোভ পরিমিতিকে লঙ্ঘন করে, আপন আতিশয্যের সীমা দেখতে পায় না। পৃ. ২৬০।
*** হে শিরাজী, হে সুন্দরী, হে তরুণী সাকী/এমনই হৃদয় মুগ্ধ করিয়াছ তুমি।
তব কপোলের ঐ ক্ষুদ্র তিল লাগি/বোখারা সমরকন্দ দিতে পারি আমি।]
পূর্বে লিখিত কোনও কোনও অনবদ্য গ্রন্থেও অবধূত মাঝে-মধ্যে ভুলে যেতেনস্ট ইটিং হোয়াইল ইট ইজ টেস্টিং!- অর্থাৎ খাঁটি বাঙালির কৃত্রিম উচ্ছ্বাস থেকে তিনি সবসময় নিজেকে মুক্ত রাখতে পারেননি– বস্তুত তাঁর সবচেয়ে মশহুর কেতাবেই সবচেয়ে বেশি চন্দ্রশেখরীয় উদ্ভ্রান্ত উচ্ছ্বাস–কিন্তু নীলকণ্ঠে তিনি যে পার্ফেক্ট ক্যাডেনস্ অব্ রেস্ট্রেনস দেখিয়েছেন, সেটি আজকের দিনের কোনও বাঙালি লেখকই দেখাতে পারবেন না। এবং এই হদ্দ শনাক্ত করাটা তিনি নীলকণ্ঠে করেছেন অবহেলে, অক্লেশে। যেন ভানুমতী কড়ে আঙুল দিয়ে লৌহ ত্রিপিটক অদৃশ্য করে দিলেন– ছাতি না ফুলিয়ে, মাসল না বাগিয়ে, ঘেমে নেয়ে কাঁই হয়ে। এই এফর্টলেসনেস পৃথিবীর সর্বকর্মক্ষেত্রেই চরমতম কাম্য।
হেঁটমুণ্ডে শূন্যে ঝুলে আছেন যোগীবর, আরেক উলঙ্গ যোগী গড়াগড়ি দিচ্ছেন বরফের উপর, নায়ক স্বয়ং পেরিয়ে গেলেন মারাত্মক ধস, তার পর সেই স্বর্গীয় সঙ্গীত পাঠক সর্বক্ষণ শুধোচ্ছে কী করে হল, তার পর কী হল? নো রিপ্লাই? সে কি মিসি বাবা! এমনকি কলির কেষ্ট ঠাকুর– অ! কন্ কী করতা? আমাগো লাঙ্গুলবারিয়ায় জিতেন সাধুর নামডাও শোনেন নাই কানে পোড়াকপাল–বসমতী যশোবতী গুজরাতি (জাতে পরেখ—বাংলা পরখ, পরশপাথর থেকে ঠিক পরখ করে চিনে নিয়েছে সচ্চা মাল) ফরাসিতে যাদের বলেভোরাইওর এস্থলেমাজোকিট ভোয়াইওর–* একমাত্র প্যারিসেই যাঁরা অজ্ঞাতবাসে ঘাপটি মেরে থাকেন, তাদেরই এক মহাপ্রভু দৈবযোগে হয়ে গেছেন নীলকণ্ঠে এসে মঠের মোহান্ত– ইনিই তা হলে নীলকণ্ঠের নীল গরল এবং গণ্ডায় গণ্ডায় কত সাধু কত চোট্টা কত সাধারণ জন, কত মাছি কত পিসু। আমাকে ব্যক্তিগতভাবে স্পর্শ করেছে কেদারনাথ দর্শনাভিলাষিনী পুণ্যশীলা মেমসায়েব জুলি আর তার স্বামী এডেন্। আমি হিন্দু নই, কেদারবদ্রী দর্শন করলে আমার অশেষ পুণ্য হবে, এ-ফতোয়া আমার তরে নয়, কিন্তু মনে করুন, আমি যদি কেদার যাবার জন্য স্বপ্নদেশ পাই, আর ত্রিযুগীনারায়ণ পেরিয়ে গৌরীকুণ্ডে পৌঁছনো মাত্রই ঝাড়া তিন দিন ধরে চলে ঝড়, বজ্রপাত– তাঁবু পর্যন্ত উড়ে চলে যায় হাজার হাজার দৈত্য রে-রে করে চতুর্দিক থেকে ছুটে আসছে যেন-কী! বিধর্মী চলেছে মহামহিম (লর্ড)** কেদারনাথকে দর্শন করতে, এতখানি স্পর্ধা বুঝি নীলকণ্ঠের সহ্য হচ্ছে না।– এবং সর্বশেষেবিরাট এক ধস্ নেমে কেদারনাথের তিন মাইল আগের রামওয়াড়া চটি লোপাট করে নিয়ে গিয়েছে– তখন আমার মনের অবস্থা কী হয়! বেচারি বিদেশিনী যবনী মেমসায়েব জুলির জীবনে এই দুর্দৈবই ঘটেছিল। একেবারে মুষড়ে গিয়ে ভেঙে পড়ে স্বামীকে বললে, চলো ফিরে যাই। তার স্বামী অবধূতকে বলছেন, জুলি মনে করছে, লর্ড কেদারনাথকে দর্শন করতে হলে যতটা পবিত্র হওয়া উচিত, ততটা পবিত্র আমি (স্বামী) নই।
[*সব দেশেই এক রকম লোক আছে যারা পাপাচারের এমনকি অনৈসর্গিক পাপাচারের নিষ্ক্রিয় দর্শকরূপে আপন কাম চরিতার্থ করে। ফরাসিতেদেখা=ভোয়ার, দর্শকভোয়াইওর (আমরা দৃশ থেকেদ্রষ্টা, ইংরেজ to see থেকে seer ভবিষ্যদ্রষ্টা মুনি ঋষির জন্য ব্যবহার করি, ফরাসিতেও সেরকমভোয়ার থেকেভোয়াইওর সদর্থে ব্যবহার হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু হয়নি– সেখানে Vovant = ভূতভবিষ্যৎ দ্রষ্টা এবং Clairvoyant=clear-seer সমস্যাটিও আমরা চিনি। ফরাসি ভাষায় বাঙালি পড়ুয়া যেন দুম্ করে কোনও ভবিষ্যৎ-দ্রষ্টা মহাজনকেভোরাইওর না বলে বসে! Romain Rolland, on, Cest un grand voyeur! বলে এক গুজরাতি নিরীহ সজ্জন প্যারিসের ফরাসি সমাজকে প্রথমটায় স্তম্ভিত করে দেন। পরে তারা ব্যাপারটা বুঝতে পেরে ঠাঠা করে অট্টহাস্য তোলেন এবং এই সম্প্রদায়ের কামনা–শব্দার্থে– পূর্ণ করার জন্য প্যারিসের অন্ধকার অংশে প্রচুর প্রতিষ্ঠান আছে, কিন্তু টিকিট এতই আক্রা যে অধীন সরেজমিন তদন্ত করতে পারেনি। এদের অন্যতম প্রোগ্রামে একজন আরেকজনকে বেধড়ক চাবুকও কষায়, পেরেকওয়ালা জুতো দিয়ে লাথি মারে, এবং নানাবিধ দুঃসহ যন্ত্রণা দেয়। এর গাহককে মাজাকিসই ভোয়াইওর বলা হয় এবং একদা আরব ছোঁড়ারা প্রোগ্রামে প্রধান অংশ নিত বলে হয়তো ভোয়াইয়ু শব্দের অর্থ– স্ট্রিট আরব।