আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, কিন্তু কেমন যেন ঠিক বিশ্বাস হয় না, অবধূত খুব সম্ভব এরকম একটি লোকের সন্ধানে ঘুরে বেড়াচ্ছেন বা ঘুরে মরছেন। বিবেকানন্দ এ রকম লোক পাননি বরঞ্চ অন্যেরা, তিনি কিছু পেয়েছেন কি না, তার সন্ধানে লেগে যেত– এবং রামকৃষ্ণ মুক্ত পুরুষ হলেও এ ধরনের লোক নন। তিনি তো সর্বত্রই লোকচক্ষুর সম্মুখে বিরাজিত। তাঁর সন্ধানে বেরুনো নিষ্প্রয়োজন। কিন্তু তাকে নিয়ে তো আমাদের কাজ চলে না। তিনি জীবন্মুক্ত। ছেলেবেলা থেকেই ফার্স্ট ক্লাস ফাস্ট। আমরা খুঁজি এমন একজন, যিনি পঞ্চাশবার ফেল মারার পর ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়েছেন। আমরা ফেল করেছি আড়াইশো বার। তিনিই বুঝবেন আমাদের বেদনাটা কোন্খানে। যে সাধক সাধনার পথে খানা-খন্দে পড়ে হাড়-হাড়ি গুঁড়িয়েছেন তিনিই তো শুধু আমাদের খবরদার! হাফি! চিৎকার করে আগে-ভাগে হুশিয়ার করতে পারেন।
কিন্তু কেন এই না-হক্ক মানুষের সন্ধানে হয়রানি?
উত্তরে সর্বদেশের গুণীজ্ঞানী মান-অভিমানী তত্ত্ববিদের সেরা বলেন, ভগবানের মহত্তম সৃষ্টি মানুষ, অতএব মানুষের সন্ধানে বেরুতে হয়। চণ্ডীদাসও বলেছেন সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই। উত্তম প্রস্তাব। অবধূতও বলেছেন, এই বক্ষ্যমাণ নীলকণ্ঠেই– হিমালয়ের পথ ঘাট মঠ মন্দির নিয়ে বিস্তর লেখা হয়ে গেছে। সেইসব গ্রন্থ পাঠ করলে হিমালয় সম্বন্ধে জানতে বাকি থাকে না কিছুই। সুতরাং আর একবার হিমালয়ের পরিচয় দিয়ে লাভ কী! তার চেয়ে হিমালয়ের মানুষদের সম্বন্ধে কিছু বলে নিই আমি। অনেকের কাছে হিমালয়ের সব থেকে বড় আকর্ষণ হিমালয়বাসী সন্ন্যাসীরা। আমি চেষ্টা করছি এই সন্ন্যাসীদের সম্বন্ধে কিছু জানতে। (কারণ) অনেকের কাছে সন্ন্যাসীরা পরম পবিত্র রহস্যময় জীববিশেষ।* (এর পর অবধূত আরও তিনটি শব্দ দিয়ে একটি বাক্য রচনা করে মনে মনে প্রশ্ন শুধিয়েছেন বা বিস্ময় প্রকাশ করেছেন, কিংবা উভয়ই, কিন্তু সে-প্রশ্ন, সে বিস্ময় নিয়ে পরে আলোচনা করা যাবে। তিনটি শব্দ ব্যবহার করেছেন বটে, কিন্তু তাঁর মতো ভাষার জউরি প্রথম যে একটি শব্দ ব্যবহার করেছেন ওই দিয়েই তিনি কর্ম সমাধান করতে পারতেন, অথচ কেদার দ্রীর পথে গঙ্গা যমুনার এমনই হুহুঙ্কার যে নিদেন তিনটি বার চিৎকার না করলে মানুষ নিজের গলা নিজেই শুনতে পায় না)।
[*শ্রীশ্রীঠাকুরকে অবধূত সাতিশয় শ্রদ্ধা করেন, এ-কথা আমরা জানি কিন্তু ক্ষণে বিশ্বাসী, ক্ষণে agnositic ক্ষণে nihilist, ক্ষণে কী, ক্ষণে কী না– মা কালীই জানেন এই লোকটির ধোকা যায় না, ঠাকুরের সর্বনীতি বাবদে। বলছেন, শ্রীশ্রীঠাকুর বলেছেন, সব মতই মত সব পথই পথ। বিদুর বাবার পথটা কী জাতের পথ তা আমি দেখেছি। ও-পথে ভগবানকে পাওয়া যায় না, শয়তানকে পাওয়া যেতে পারে! নীলকণ্ঠে পৃ. ১৬৯/৭০।]
ফারসিতে একটি দোঁহা আছে :
কুনদ হম জিনস্ বৃহস্ পরওয়াজ
কবুতর ব কবুতর বাজ ব বাজ।
The same with same shall take its flight
The dove with dove and kite with kite
স্বজাতির সনে স্বজাতি উড়িবে মিলিত হয়ে
পায়রার সাথে পায়রা; শিকরে শিকরে লয়ে।
অতএব হিমালয়ের হোক বা পৃথিবীর অন্য যে কোনও স্থলেরই হোক, সাধু-সন্ন্যাসীদের চিনতে হলে তাদেরই একজন হতে হয়। অবধূত এ বাবদে তার একাধিক গ্রন্থে এ তত্ত্বটির উল্লেখ করেছেন। এই সর্বজনীন গণতন্ত্র আমাকেও আনন্দ দেয়। লন্ডনের এক প্রাতঃস্মরণীয়া সমাজসংস্কারিকা নারী যখন দেখলেন যে, পতিতাদের জন্য তিনি কোনও সেবাই করে উঠতে পারছেন না, তখন তিনি তাদেরই সমাজে প্রবেশ করলেন। (আশা করি কেউ অন্যায় সন্দেহ করবেন না, যে আমি সাধুসন্ন্যাসী, পীর-দরবেশ ও পতিতাদের একপর্যায়ে ফেলছি। এই অধমের পরিবারের মাত্র শতবর্ষ পূর্বেও রীতি ছিল যে সর্বকনিষ্ঠকে সন্ন্যাস গ্রহণ করে বনে চলে যেতে হত)। মহিলাটি শেষ পর্যন্ত সেখানে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করার পর সে-সমাজ ত্যাগ করে যে গ্রন্থ রচনা করেন সেটি অতুলনীয়, অমূল্য।
অবধূত মৌনব্রত, অজগরব্রত, পনছিব্রত* সবই করলেন।
[*অজগর আহার সংগ্রহের জন্য কোনও প্রচেষ্টাই করে না– এর বিরুদ্ধ মতবাদ আমি দক্ষিণ ভারতে শুনেছি। একাধিক গুণী বলেন, সে নাকি বড় মধুর শিষ দিয়ে পশুশাবক, এমনকি অত্যধিক কৌতূহলী বালকবালিকাকে আকর্ষণ করতে পারে।]
কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার ব্যামো সঠিক চিনতে পারলেন প্রজ্ঞানাথ। সার্থক তার নাম। প্রজ্ঞাবলে বলে দিলেন তোমার পথ আলাদা। হয় তুমি নিশ্চিত হয়ে ঘুমিয়ে থাকবে, নয়তো ছুটে বেড়াবে। আর যোগাভ্যাস বাবদে বললেন, তোমার জন্য ওই নাক-টেপাটেপি নয়, তোমার ধাতে সইবে না। দূর ছাই বলে ফেলে দিয়ে আবার ছুটে বেড়াবে।
সেই ভালো। নইলে তার অবস্থা বিশ্বকবি বর্ণিতঘোড়ার মতো হয়ে যেত। অন্য সকল প্রাণী কারণ উপস্থিত হলে দৌড়ায়; এ দৌড়ায় বিনা কারণে, যেন তার নিজেরই নিজের কাছ থেকে পালিয়ে যাবার একান্ত শখ। পালাতে পালাতে একেবারে বুঁদ হয়ে যাবে, ঝিম হয়ে যাবে, ভোঁ হয়ে যাবে, তার পর ‘না’ হয়ে যাবে।
‘না’ হয়ে গেলে (নতুং, নাহং, নায়ং লোকঃ) নীলকণ্ঠ লিখত কে!
কিন্তু আমরা ভুল করছি না তো?
স্পষ্ট দেখতে পারছি তিনটি অবধূত। যে অবধূতকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি, যে অবধূত বই লেখেন এবং যে অবধূত লাষ্ট্রর মতো চক্কর খায়। তিন জনাই কি একই ব্যক্তি? নিশ্চয়ই নয়। অন্তত তৃতীয় অবধূতকে দ্বিতীয় অবধূতের সঙ্গে গোবলেট করলে দু জনারই প্রতি ডাহা অবিচার করা হবে। বহু সার্থক লেখক প্রথম পুরুষে রসসৃষ্টি করেছেন; তাই বলে কি লেখক ও তাঁরআমি চরিত্র একই ব্যক্তি? ডি ফো আর রবিনসন, সুইফট আর গালিভার কি একই ব্যক্তি? এমনকি এই নীলকণ্ঠেই তিনি যে একাধিকবার আত্মচিন্তা করতে করতে নিজের পরিচয় দিচ্ছেন সে পরিচয়ের সঙ্গে লেখক অবধূতের কি সবসময় মিল আছে?