এবং এখানে এসে সত্যই অবধূতকে জোব্বার খুঁট দিয়ে চোখ মুছতে হয়!
অথচ আমি যেন স্পষ্ট দেখতে পেলুম, গেরুয়ার খুঁট না, শৌখিন নিমন্ত্রিতের জেব থেকে বেরিয়ে এল ফুলকাটা-লেস লাগানো হাওড়া-তোড়-হাল্কাসে-হাল্কা বেডশিট সাইজের রুমাল! বিশাস করবেন না, আমি পেলুম ভুরভুরে আতরের খুশবাই। বলা বাহুল্য, নিমন্ত্রিতজন কণামাত্র খাদ্য স্পর্শ করবেন না– ভাবখানা এই, আমাদের কারওরই বাড়িতে অন্নাভাব নেই, তদুপরি খানদানি নবাব মাত্রই ডায়াটে থাকেন।
এই অভিনয় করার পরিপূর্ণ বিধিদত্ত দক্ষতা ছিল অতি বাল্যকাল থেকেই আরেকটি লেখকের– চেখফ। পাঠশালে যাবার সময় থেকেই তিনি বাপ-কাকা পাড়া-প্রতিবেশী সক্কলের অনুকরণ করে অভিনয় করতে পারতেন– কেউ কেউ খুশি হয়ে তাঁকে লেবেনচুস লার্ভুটা উপহারও দিতেন।
এই অভিনয়দক্ষতা আপন কলমে স্থানান্তরিত করতে পারলেই লেখকের সকলং হস্ততলং –লেখা তখনই হয় convincing; তার বিগলিতাৰ্থ অভিনয় করার সময় যেরকম প্রত্যেকের আপন আপন ভাষায় বৈশিষ্ট্য রক্ষা করা অপরিহার্য, লেখার বেলাও তাই। এখানে কর্মটি কঠিনতর। কারণ এখানে অঙ্গভঙ্গি করতে পারবেন না, চোখের জল ফেলে দেখাতে পারবেন না। অর্থাৎ টকি-সিনেমার কাজ গ্রামোফোন রেকর্ড দিয়ে সারতে হচ্ছে। আসলে তার চেয়েও কঠিন, কারণ, কণ্ঠস্বর দিয়ে বহুৎ বেশি ভেল্কিবাজি দেখানো যায়। অনেকের অনেক রকম ভাষা–কেউ-বা স্ল্যাঙ ব্যবহার করে, কারও-বা ইডিয়ম জোরদার, কেউ কথায় কথায় প্রবাদ ছাড়ে, কেউ বলে ভাযের মতো সংস্কৃত-ঘাষা ভাষা, কেউ কিঞ্চিৎ যাবনিক– এ সব-কটা করায়ত্ত না থাকলে ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণির লোকের কথাবার্তা convincing ধরনে প্রকাশ করা যায় না। এ বাবদে বাঙলা দেশের সর্বশ্রেষ্ঠ উদাহরণ : মধুসূদনেরবুড়ো শালিকের ঘাড়ে রো। আমি এ-বিষয় নিয়ে অন্যত্র দীর্ঘ আলোচনা করেছি; এ-স্থলে বলি, এ যেন একটা মিরা। মাইকেল বাল্যাবস্থায় যশোর ছাড়েন, তার পর সেখানে আর কখনও যাননি। তদুপরি অনেক কাল কাটালেন বাঙলার বাইরে। অথচ পরিণত বয়সে এই নাটকে, অর্ধশিক্ষিত, হিন্দু কর্মচারী, তার অশিক্ষিত হিন্দু চাকর, অশিক্ষিত মুসলমান চাষা, তার চেয়েও অগা তার বউ, এবং আরও চার-পাঁচজন সবাই মিলে অন্তত সাত-আট রকমের কথা বলে খুঁটির চেয়েও খাঁটি মধুর যশোরি ভাষায়, কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন শেডে।
আলাল, হুতোম, পরশুরাম পেরিয়ে এ-যুগে এলে পাচ্ছি দু জন লেখক যাদের কলকাতা ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের উপভাষার সঙ্গে নিবিড় পরিচয় আছে। অবধূত জানেন খাস কলকাত্তাই কিন্তু এ-কলকাত্তাই হুতোমের কলকাত্তাই নয়, কারণ এর থেকে বহু আরবি-ফারসি শব্দ উধাও হয়ে গিয়েছে, ইংরেজি ও হিন্দি ঢুকেছে এবং অভাব-অনটনের ভিন্ন জীবন প্যাটার্ন নির্মিত হওয়ার ফলে এত নতুন ইডিয়ম সৃষ্ট হচ্ছে এবং গজেন্দ্র মিত্র জানেন কলকাতার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের মধ্যবিত্ত শ্রেণির ঘরোয়া মেয়েলি ভাষা। যত দিন সাধুভাষা চালু ছিল ততদিন এ দুটোর অল্পই কদর ছিল, কিন্তু চলতি ভাষা– সে-ও প্রধানত কলকাতা ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের ভাষা– কলুকে পেয়ে আসর জমানোর সঙ্গে সঙ্গে এগুলোর চাহিদা বাড়বেই। জনগণের কথ্য ভাষার শিকড় দিয়ে লিখিত ভাষা যদি নিত্য নিত্য প্রাণরস আহরণ না করে তবে সে একদিন শুকিয়ে গিয়েডেড ল্যান্গুই হয়ে যায়- সংস্কৃত, লাতিনের বেলা যা হয়েছিল, এ-দেশের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের যা হয়েছে। তাই বাংলা থেকে সাধুভাষা বর্জন করে আমরা ভালোই করেছি। ভাষাটির কাঠামো ছিল ঢাকার কিন্তু সবচেয়ে বেশি প্রচলন হল মেট্রপলিস্ কলকাতায়। রামমোহন, ঈশ্বরচন্দ্র, বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, নজরুল ইসলাম এঁদের সকলেই রাঢ়ি ও কর্মভূমি কলকাতায়। এঁরা ঢাকার শব্দ, ইডিয়ম, প্রবাদ, বচন-ভঙ্গি আমদানি করতে পারেন না, আবার কলকাতা ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের এসব মাল–পূর্বে যাকে বলেছি শিকড় দিয়ে প্রাণরস আহরণ করা–সাধুভাষার সঙ্গে ঠিক জুৎসই লাগসই হয় না, ফিট করে না। এখন সে অসুবিধা ঘুচেছে। (ঢাকা মেট্রপলিস্ হতে চলল– সেখানকার লেখকরা যদি সাধুভাষাতে প্রাণরস সঞ্চার করতে পারেন তবে সে-ও নবীন পত্র-পুষ্পে পল্লবিত হবে)।
কিন্তু এহ বাহ্য।
অবধূতের আনাগোনা বাঙলা দেশের বাইরেও বটে। বক্ষ্যমাণ নীলকণ্ঠে যাদের সঙ্গে আমাদের ভবঘুরে প্রতিনিয়ত কথা বলছেন তারা বাঙালি নয়, অথচ বাংলার মারফতেই তাদের চরিত্র convincing করতে হবে। সে আরও কঠিন কর্ম। কিন্তু লেখক যে রকম গোড়ার মজুমদার রায়সাহেবের ঘোড়ার পিঠে চড়া, সুবাসী দিদি কলকাত্তাইদের ফুটিয়ে তুলেছেন, ঠিক তেমনি অবাঙালি অমরনাথজুলিমেম এবং আরও গণ্ডায় গণ্ডায়। ভাষা করায়ত্ত থাকলে হাতিকেও বাংলা বলানো যায়।
অবধূতের প্রতিটি গ্রন্থ পড়ে আমার মনে প্রশ্ন জেগেছে, এ-লোকটি কিসের সন্ধানে দুনিয়াটা চষে বেড়ায়? তার পায়ে চক্কর আছে সে তো বুঝি, এবং বলা উচিত কি না জানিনে– তাঁর সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে পরিচিত হয়ে খবরটা পেয়েছি যে, তিনি তন্ত্রে বিশ্বাস করেন। তন্ত্রশাস্ত্রে যে তাঁর গভীর জ্ঞান আছে সে-তত্ত্ব আবিষ্কার করতে বেশিক্ষণ সময় লাগে না। কিন্তু তান্ত্রিক একবার পথ পেয়ে গেলে তো ঘুরে বেড়ায় না! গ্যোটে বলেছেন, চরিত্রবল বাড়াতে হলে জনসমাজে যাও; জিনিয়াসের সাধনা করতে হলে নির্জনে, একাগ্র মনে। আমার মনে তখনই প্রশ্ন জেগেছে, আর যারা সাধু-সন্ন্যাসীর পিছনে পিছনে ঘোরে?বরদার মহারাজ আমাকে বলেন শ্রীঅরবিন্দ তার সঙ্গে কাজ করার সময় প্রতি শনিবারের সন্ধ্যা থেকে সোমের সকাল অবধি সাধু-সন্ন্যাসীর সন্ধানে নর্মদার পারে পারে (হিমালয়ের পরেই নাকি সেখানে ওঁদের পরিক্রমা-ভূমি) ঘুরে ঘুরে বেড়াতেন। তিনি একজন সিদ্ধপুরুষ পেয়েও ছিলেন। সেই সন্ন্যাসীর করুণ কাহিনী পাঠক উপেন বাঁড়ুয্যের অদ্বিতীয় পুস্তক নির্বাসিতের আত্মকথায় পাবেন। একে আনা হয়েছিল বারীন-উল্লাস-উপেনদের চরিত্রবল গড়ে দেবার জন্য। কিছুদিন এঁদের সঙ্গে থাকার পর ইনি প্রত্যেককে সনির্বন্ধ অনুনয়-বিনয় করেন, বিপ্লবীদের ভয়াবহ পন্থা পরিত্যাগ করতে। এঁরা যখন কিছুতেই সম্মত হলেন না তখন তিনি, সেই মুক্ত পুরুষ, শব্দার্থে সজল নয়নে বাগানবাড়ি ছেড়ে চলে যান। যাবার সময় অতিশয় দুঃখের সঙ্গে যে ভবিষ্যদ্বাণী করে যান সেটা আন্দামানে অক্ষরে অক্ষরে ফলে।