আমার পরিচিত কোনও কোনও কনিষ্ঠের ধারণা– যার উল্লেখ এইমাত্র করলুম যে, অবধূত আসলে ভ্রমণকাহিনী লেখক। বাইরের দিক দিয়ে দেখতে গেলে এ ধারণা ভুল না-ও হতে পারে। কারণ বিশ্বস্তসূত্রে অবগত হয়েছি, গেরুয়াধারীকে সরাসরি প্রশ্ন শুধানো অনুচিত– তিনি দীর্ঘকাল সন্ন্যাসী-শ্ৰমণজনোচিত স্থান পরিবর্তন বা পর্যটন করেছেন, এবং সে-কারণে তাঁর রচনাতে সবসময়ই অল্পবিস্তর আনাগোনা থাকে, এবং পরোক্ষভাবে সেটাকে ডাইনামিক করে তোলে। এটা সদ্গুণ, কিন্তু এটা অবধূতের একমাত্র গুণ তো নয়ই, প্রধানতম গুণও নিশ্চয়ই নয়।
আবার, কোনও কোনও কনিষ্ঠের ধারণা– এরা সাধারণত আমার সমুখে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে অবধূত প্রধানত সন্ন্যাসীদের মধ্যে যে ফঞ্চুড়ি ধাপ্পাবাজি আছে সেটার নিরতিশয় নগ্নরূপ আমাদের সামনে সার্থকভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। এটাও পূর্বেকার মতো আংশিক সত্য, সম্পূর্ণ সত্য নয়। ফকুড়ি, ধাপ্পাবাজি, বুজরুকি,* –এরই মোলায়েম নামধরাধরি বাতদৃবির (অবধূতের ভাষায়ও বোধহয় আছে, বসুন্ধরা পূর্বে বীরভোগ্যা ছিলেন; অধুনা তদবিরভোগ্যা)– এসব তো সর্বত্রই আছে, এবং এ-বাবদে সন্ন্যাসীদের নিদারুণ ঢিঢ দিতে পারে হালফিলের গৃহীরা, এবং কলকাতায় তাদের সন্ধানে বিস্তর তলিফ বরদাস্ত করতে হয় না; বস্তুত তাদের অনাহারে প্রাণ অতিষ্ঠ। হাট-বাজারে, মেলা-মজলিশে, সাহিত্য-বিদ্যালয়ে, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে যেখানে বিজ্ঞান, বিশ্বপ্রেম সেখানেই তো বিশ্ব ফকুড়ি- এ তো পাড়ার পদিপিসিও জানে। তার দাওয়াই কী, সে-ও তো অজানা নয়। শুধু অজানা– এ-খাটাশের গলায় ঘন্টা বাধবে কে? অবধূত সমাজ-সংস্কারক নন– ডন কুইটের মতো নাঙ্গা তলওয়ার দিয়ে বেপরওয়া বায়ুযন্ত্র (উউন্ডি-মিল) আক্রমণ করা তারধর্মে নেই। লোকটি বড়ই শান্তিপ্রিয়। শুধু যেখানে বর্বর পশুবল অত্যাচার করতে আসে, এবং সে পশুবল ফঞ্চুড়িতেও সিদ্ধহস্ত সেখানে অবধূত, ফড়ির মুষ্টিযোগ ফড়ি ছাড়া নানাপন্থা বিদ্যতে বিলক্ষণ জানেন বলেই সেটা বীভৎস রূদ্ররূপে দেখাতে জানেন। কিন্তু এটা তাঁর ব্যক্তিগত চরিত্র, শীলের দিক। লেখক হিসেবে এটা তার নগণ্যতম পরিচয়। কারণ লেখক হিসেবে হীরো রূপে তিনি কস্মিনকালেও আত্মপ্রকাশ করতে চাননি।
[*বুজরুকি শব্দটি এসেছে ফারসি বুজরুগ থেকে– অর্থ অতি ভদ্র; মুরকী, সাধুজন, উচ্চ-স্থানীয়; সেইটার অভিনয়, বাংলায় ভণ্ডামি।]
আর্ট ও জীবন নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনা করেছেন কবিরাজ গ্যোটে। সে আলোচনা বহুস্থলে এতই সূক্ষ্ম যে আপনার-আমার মতো সাধারণ পাঠক দিশেহারা হয়ে যেতে বাধ্য। তবে সে আলোচনার ভিতর না গিয়ে সরাসরি আর্টের ভিতর জীবন ও কোনও কোনও স্থলে লেখকের জীবনীরও অনুসন্ধান করা যায়। কিন্তু দ্বিতীয়টি সংকট-সঙ্কুল। একটি দৃষ্টান্তই এস্থলে যথেষ্ট। বাঙলা দেশে কেন, পৃথিবীর হাস্যরসিকদের ভিতর পরশুরামের স্থান অতি উচ্চে। অথচ যেসব সৌভাগ্যবান তাকে ব্যক্তিগতভাবে চেনবার সুযোগ পেয়েছেন তারাই জানেন হাস্যরস ঠাট্টা মস্করা দিয়ে তিনি মজলিশ না জমিয়ে বরঞ্চ সুযোগ দিতেন আমাদের মতো রামা-শ্যামাকে। একবার তাঁকে আমি একখানা চিঠিতে লিখি, তাঁর বাড়ির ও পাড়ার ছেলেদের সামনে আমি ম্যাজিক দেখাব, তবে তিনি সে-স্থলে সশরীর উপস্থিত না থাকলেই ভালো। তিনি কাতর কণ্ঠে উত্তর লেখেন, আমাকে গুমড়োমুখো দেখে ভাববেন না, আমার রসবোধ নেই। অবধূতের বেলা ঠিক তার উল্টো। তার লেখাতে ব্যঙ্গ আছে, বিদ্রূপ আছে, যেন হাসতে হাসতে তিনি বুজরুকির মুখোশ একটার পর একটা ছিঁড়ে ফেলছেন; কোনও কোনও স্থলে সেই সুবাদে তিনি বিকট বীভৎস রসেরও অবতারণা করেছেন কিন্তু অকারণে হাস্যরস অবতারণা করতে তাঁকে বড় একটা দেখা যায় না। অথচ অন্তরঙ্গজনের মধ্যে অবধূতের অন্য রূপ। সেখানে তিনি অভিনয়সহ যে বিশুদ্ধ হাস্যরস উপস্থিত করেন সে যে কী স্বচ্ছ, কী চটুল। যেন পার্বত্য নিঝরিণী আপন বেগে পাথর হতে পাথরে লাফাতে লাফাতে এগিয়ে চলেছে তারাই শুধু জানেন যারা তার সঙ্গে অন্তরঙ্গ। তার একটি অভিনয় এমনই অনবদ্য যে সেটি টেলিভিশনে দেখানো উচিত। কুঁচড়ো চন্নগর অঞ্চলে এক বিশেষ সম্প্রদায়ে নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে গিয়ে ভোজন করা অভদ্রতার চূড়ান্ত। নিমন্ত্রণকারী সোনার থালার চতুর্দিকে পঞ্চাশ ব্যঞ্জন সাজিয়ে নিমন্ত্রিতের সামনে গলবস্ত্র হয়ে, হাত কচলাতে কচলাতে প্রায় কাঁদো কাঁদো গলায় বার বার শুধু ফরিয়াদ জানাবেন, তিনি অতিশয় দরিদ্র, সামান্যতম অনুব্যঞ্জনের ব্যবস্থা করতেও সম্পূর্ণ অক্ষম; এবং নিমন্ত্রিতজনও অতি-বড়-গাওয়াইয়ার মতো তালের আড়ির সঙ্গে কুআড়ি লাগিয়ে ইস্টিকের উপর ভর করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই থালার সামনের পিড়িতে বসাটাও নাকি পবিত্র, যুগ যুগ সঞ্চিত সর্ব ঐতিহ্যভঞ্জনকারী সৎ বেয়াদবির চূড়ান্ত– বলবেন, প্রায় চোখের জল ফেলে, যে, এরকম অত্যুত্তম ব্যবস্থা তার চতুর্দশ পুরুষের কেউ কখনও দেখেনি, এ বাড়ির গৃহিণী রন্ধনে সাক্ষাৎ দ্রৌপদী, আর হবেই-বা না কেন, এরা যে পুরুষানুক্রমে দেশের অভিজাত সম্প্রদায়ের গৌরীশঙ্কর, নীলকণ্ঠ! এহেন রসময় চাপান-ওতর বাস্তবে কতক্ষণ ধরে চলত বা এখনও চলে সে অভিজ্ঞতা আমার নেই, কিন্তু অবধূত মৌজে থাকলে নিদেন আধঘণ্টা, এবং উভয়পক্ষের সেই নিছক কথার তুবড়িবাজি ফুলঝুরি শুধু লেখাতে প্রকাশ করা আমার পক্ষে অসম্ভব। কারণ একা অবধূতই দুটি পার্ট একসঙ্গে প্লে করে যান। ক্ষণে গল-বস্ত্র কাঁদো-কাঁদো কাতর নিমন্ত্রণকারী, ক্ষণে চরম আপ্যায়িত, কৃতজ্ঞতার ভারে আজানুজ, আনন্দাশ্রুতে চক্ষুদ্বয়সিক্ত নিমন্ত্রিত।