হিন্দু তীর্থের প্রতি মুসলমানের কোনও কৌতূহল থাকার কথা নয়, কিন্তু এই গ্রন্থ পড়ে পূর্ব পাকিস্তানি একটি মুসলমান তরুণ আমাকে বলে, সে নিশ্চয়ই হিংলাজ দেখতে যাবে– সে তখন করাচিতে চাকরি করে, তার পক্ষে যাওয়া সুকঠিন ছিল না। আমি শঙ্কিত হয়ে বললুম, অমন কর্মটি করো না। আর্টিস্টের মডেলের সন্ধানে কেউ কখনও বেরোয়! যে ভিখারিণী ছবি তুমি পশুদিন একশো টাকা দিয়ে কিনলে তুমি কি সে ভিখারিণীর সন্ধানে বেরোও, যাকে মডেলরূপে সামনে খাড়া রেখে আর্টিস্ট ছবি এঁকেছিল? বরঞ্চ বলব, তার সঙ্গে দৈবাৎ রাস্তায় দেখা হলে তুমি তো উল্টো ফুটে চলে যাও! কারণ, সে তো তোমার হৃদয়ে কোনও ইথেটিক আনন্দ দিতে পারে না। আমার মনে কোনও সন্দেহ নেই, অবধূত-মহারাজ সাধু ব্যক্তি; সে সাধুতা তিনি লেখক হিসেবেও রক্ষা করেছেন এবং তাঁর পুস্তকে তিনি অতিরঞ্জিত করেননি। কোনও কোনও সাধু-বাবাজি বড় তামাক সেবন করেন; অবধূত কখনও করেছেন কি না বলা কঠিন– অন্তত তাঁর ডেরাতে সে খুশবাই আমি পাইনি কিন্তু একথা বরহক সত্য, তাঁর সৃষ্টিতে গঞ্জিকা-বিলাস বিলকুল নদারদ। কাজেই হিংলাজে গিয়ে তুমি টায়-টায় তাই পাবে, দফে দফে সে-সব জিনিসই পাবে যার বয়ান অবধূত ইমানসে দিয়াছেন, তাঁর ইভেনট্রিতে ফাঁকি পাবে না। এবং পাবে না এবং সেইটেই সবচেয়ে বড় কথা– তাঁর বই পড়ে যে কাব্যরস, যে কলা-সৃষ্টিরস, যে ইসথেটিক ডিলাইট পেয়েছিলে সেই অনবদ্য অমৃত। তার শেষ প্রমাণ, সূর্যোদয় তো আমরা নিত্য নিত্যি দেখি; তবে সূর্যোদয়ের ছবি কিনি কেন?
তা হলে প্রশ্ন, অবধূত কি খাঁটি রিয়ালিস্টিক লেখক?
অবধূত কি বাস্তব জগৎ ছাড়িয়ে যেতে পারেন না? কল্পনার ডানা জুড়ে দিয়ে তিনি যদি আমাদের নভেলকে উড্ডীয়মান না করতে পারেন তবে বাস্তবের কাদায় গড়াগড়ি দিয়ে কী এমন চরম মোক্ষ লাভ!*
[*যেখানে মানুষের আত্মপ্রকাশে অশ্রদ্ধা সেখানে মানুষ আপনাকে হারায়। তাকে বাস্তব নাম দিতে পারি, কিন্তু মানুষ নিছক বাস্তব নয়। তার অনেকখানি অবাস্তব, অর্থাৎ তা সত্য। রবীন্দ্রনাথ, রচনাবলী, ২৭ খণ্ড, পৃ. ২৮৫।]
এর উত্তর অতিশয় সরল। অবধূত যদি তার কল্পনা, তাঁর সৃজনীশক্তি, তাঁর স্পর্শকাতরতা মরুতীর্থের পাতায় পাতায় ঢেলে না দিয়ে থাকতেন তবে পুস্তকটি রসকষহীন মরুই থেকে যেত। বড়জোর সেটা হত গাইড বুক। গাইড বুক, বড়ই প্রয়োজনীয় বস্তু, কিন্তু স্বয়ং রবীন্দ্রনাথই বলেছেন, আর্ট আরম্ভ হয় ঠিক সেই জায়গা থেকে যেখানে প্রয়োজন শেষ হয়ে যায়। রাধু মালী কেনেস্তারায় করে নাইবার জন্য যে-জল এনে দেয় তাতে প্রয়োজন মেটে বটে, কিন্তু নন্দলাল কর্তৃক বহুবর্ণে বিচিত্রিত কুম্ভ মস্তকে ধারণ করে যখন তনুঙ্গী মরাল গমনে জল নিয়ে আসে তখন সঙ্গে সঙ্গে আসে আর্টের উপাদান, সেই জলের সঙ্গে সঙ্গে আসে কল্পনার উৎস, সৃষ্টির অনুপ্রেরণা– সেই পুণ্যবারিই মরুতীর্থকে শ্যামল সুন্দর করে তোলে, সে তখন দেয় তৃষ্ণা-হরা সুধাভরা সঙ্গসুধা এবং কে না জানে সঙ্গ ওসাহিত্য বড় কাছাকাছি বাস করে।
কিন্তু ওই মরুতীর্থই তো অবধূতের একমাত্র বা সর্বশ্রেষ্ঠ রসসৃষ্টি নয় যে সুদুমাত্র এইটে বিশ্লেষণ করেই আমরা পুস্তক ও লেখকের প্রকৃত পরিচয় পেয়ে যাব, এবং প্রশ্ন, রসের হাটে ভ্রমণকাহিনী কোন কাতারে বসার হক্ক ধরে, বাজারের বৈচিত্র্য নির্মাণে তার সেবা কতখানি, সে পাবে কোন্ শিরোপা? বিশেষত বাংলা সাহিত্যে? লোকে বলে ঘরমুখো বাঙালি; কাজেই তার কাছ থেকে আর সবকিছুই আশা করা যেতে পারে, শুধু ভ্রমণকাহিনীটি মাফ করে দিতে হয়। তাই যদি হয়, তবে বলব, পালামৌ-র পরই মরুতীর্থ। এবং তার পরও তাকে কেউ আসনচ্যুত করতে পারেনি। বলা বাহুল্য, এসব আলোচনায় আমরা গুরু রবীন্দ্রনাথকে বাদ দিই।
তবে কি অবধূত শুধু ভ্রমণকাহিনীর কীর্তনিয়া পার এসেলাস?
অধীন সমালোচক নয়, বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপকও নয়। তার প্রধান পরিচয়– সে যা মনে করে পাঠকরূপে। সে বই পড়তে ভালোবাসে এবং যদ্যপি ঈশ্বরেচ্ছায়, বা নসিবের গর্দিশে, যাই বলুন, সে ভিন্ন ভিন্ন দেশে যাওয়ার ফলে বাংলা ছাড়াও দু-একটি অতিশয় ধনী তথা খানদানি ভাষার সঙ্গে কিঞ্চিৎ পরিচিত হয়েছে, তথাপি সে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে আপন মাতৃভাষা বাংলাতেই বই পড়তে। এবং কোনও বই পড়ে– বিশেষ করে সে বইয়ের লেখক যদি অখ্যাতনামা হয়, তাকে যদি নববধূর মতো লজ্জিত শঙ্কিত পদে বাংলা বাসরে প্রবেশ করতে দেখে তবে আঙ্গিনা যেতে তার কল্যাণ কামনা করে, বয়েস ছোট হলে আশীর্বাদ জানায়। আবার বলছি, পাঠক হিসেবে। অবধূত শংকর আদিকে আমি উদ্বাহু হয়ে অযাচিত অভিনন্দন জানাই, বাংলা সাহিত্যে তাঁদের প্রবেশলগ্নেই। পরবর্তীকালে কেউ কেউ আমাকে আরও আশাতীত আনন্দ দিয়েছেন, কেউ কেউ দেননি, কিন্তু সে নিয়ে আমার ক্ষোভ নেই, কারণ এ-দুজনা আমাকে নিরাশ করেননি।
অবধূতের বয়স হয়েছে, তিনি ভগ্নস্বাস্থ্য। আমিও তদ্বৎ। পূর্বেই নিবেদন করেছি, আমি সমালোচক বা অধ্যাপক নই, তার রচনা সম্বন্ধে আমার লিখবার যেটুকু হক্ক আছে সে শুধু, তিনি লেখক পারু-এসেলাস, আমি তার অসংখ্য গুণমুগ্ধ পাঠকদের ভিতর পাঠক পার একসেলাস, পাঠকোত্তম। আমি উদ্ধারণপুরের কাছেই বাস করি, এর সঙ্গে আমার আবাল্য পরিচয়। এ ঘাট দিয়ে উভয়ে একসঙ্গে না গেলেও শীঘ্রই আমরাওপারে মিলিত হব। সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকে সৃষ্টির চরম রহস্য জেনে নেবার পূর্বেই অবধূতের সৃষ্টি সম্বন্ধে আমার বিস্ময় প্রকাশ করে যাই।