ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলছি- আমার অভিজ্ঞতা কলেজের অধ্যাপক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষকরূপে অর্জিত যে পশ্চিম ভারতের কার্ভে স্ত্রী-মহাবিদ্যালয়ের ছাত্রীরা যদিও দু-এক দিক দিয়ে বোম্বাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের চেয়ে পশ্চাৎপদ তবু স্বাধীনভাবে চিন্তা করার ক্ষমতা যেমন তাদের বেশি তেমনি প্রকাশক্ষমতা, আত্মপরিচয় দানের নৈপুণ্য তাদের অনেক বেশি। তার একমাত্র কারণ কার্ভে স্ত্রী-মহাবিদ্যালয়ের ছাত্রীরা আপন আপন মাতৃভাষায় মাধ্যমিকে লেখাপড়া করে আর বোম্বাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেরা লেখাপড়া শেখে ইংরেজির মাধ্যমিকে। কার্ভের মেয়েরা সেই কারণে আপন মাতৃভাষায় নিঃসঙ্কোচ অবাধ গতিতে আপন বক্তব্য বলতে পারে; বোম্বাই, কলিকাতা, ঢাকার ছেলেরা না পারে বাংলা শিখতে, না জানে ইংরেজি পড়তে।
এ কাহিনীর শেষ নেই কিন্তু আমাকে প্রবন্ধ শেষ করতে হবে। তাই পাঠককে সবিনয় অনুরোধ করি তিনি যেন শিক্ষাবিভাগের কোনও পদস্থ ব্যক্তিকে এ সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করেন। শ্রীহট্টের খ্যাতনামা আলিম মৌলানা সখাওতুল আম্বিয়া প্রমুখ গুণীগণ আমার সম্মুখে বহুবার স্বীকার করেছেন যে মাদ্রাসাতে যদি বাংলাভাষা সর্বপ্রকার বিষয় শিক্ষার মাধ্যমিক হত তবে আমাদের আরবি-ফারসির চর্চা এতদূর পশ্চাৎপদ হত না। এবং কৌতুকের বিষয় এই যে, যে উর্দুওয়ালারা বাংলাকে এত ইনকার-নফরৎ, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেন তাদেরও অনেকেই কঠিন বিষয়বস্তু যখন উর্দুতে বোঝাতে গিয়ে হিমশিম খেয়ে যান তখন নোয়াখালি, সিলেটের গ্রাম্য উপভাষারই শরণাপন্ন হন।
এত সরল জিনিস উর্দুওয়ালাদের কী করে বোঝাই? কী করে বোঝাই যে পারস্যের লোক যখন ফারসির মাধ্যমিকে আরবি (এবং অন্যান্য তাবৎ বিষয়) শেখে, তুর্কির লোক যখন তুর্কি ভাষার মাধ্যমিকে আরবি শেখে, তখন বাংলার লোক আরবি (এবং অন্যান্য তাবৎ বিষয়) শিখবে উর্দুর মাধ্যমিকে কোন আজগুবি কাণ্ডজ্ঞানহীনতার তাড়নায়?
এ প্রসঙ্গের উপসংহারে শেষ কথা নিবেদন করি, মাতৃভাষাকে শিক্ষার মাধ্যমিক না করলে সে ভাষা কখনও সমৃদ্ধিশালী হবার সুযোগ পায় না।
স্বরাজ এল পাকিস্তান হল কিন্তু হায়, গোস্বামী খাসলত (মনোবৃত্তি ও আচার-ব্যবহার) যাবার কোনও লক্ষণ তো দেখতে পাচ্ছিনে। এতদিন করতুম ইংরেজির গোলামি, এখন স্বেচ্ছায় বরণ করে নিচ্ছি উর্দুর গোলামি। খতম আল্লাহু আলা কুপুবিহিম ইত্যাদি। খুদাতালা তাদের বুকের উপর সিল এঁটে দিয়েছেন। (কুরান থেকে এ অংশটুকু এখানে উদ্ধৃত করার কোনও প্রয়োজন হত না, যদি কোনও কোনও মৌলানা বাংলা ভাষার সমর্থকদের কাফির হয়ে যাওয়ার ফতোয়া না দিতেন)।
এইবার দেখা যাক, বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয়, সরকারি ও সাংস্কৃতিক ভাষারূপে গ্রহণ করতে উর্দুওয়ালাদের আপত্তিটা কী?
তাদের প্রধান আপত্তি, বাংলা হেঁদুয়ানি ভাষা। বাংলাভাষায় আছে হিন্দু ঐতিহ্য, হিন্দু কৃষ্টির রূপ। পূর্ব পাকিস্তানি যদি সে ভাষা তার রাষ্ট্র ও কৃষ্টির জন্য গ্রহণ করে তবে সে হিন্দুভাবাপন্ন হয়ে যাবে।
উত্তরে নিবেদন, বাংলাভাষা হিন্দু ঐতিহ্য ধারণ করে সত্য, কিন্তু এইটেই শেষ কথা নয়। বাংলাভাষার জন্ম হয়েছে হিন্দুধর্মের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে।
বুদ্ধদেব যেরকম একদিন বৈদিক ধর্ম ও তার বাহন সংস্কৃতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে তৎকালীন দেশজ ভাষায় (পরে পালি নামে পরিচিত) আপন ধর্ম প্রচার করেন, ঠিক সেইরকম বাংলাভাষার লিখিত রূপ আরম্ভ হয় বৌদ্ধ চর্যাপদ দিয়ে। পরবর্তী যুগে বাংলা সাহিত্যরূপ নেয় বৈষ্ণব পদাবলির ভিতর দিয়ে। আজ পদাবলি সাহিত্যকে হিন্দুধর্মের অংশ হিসেবে গণ্য করা হয় কিন্তু যে যুগে বৈষ্ণবধর্ম প্রচারিত সে যুগে তাকে বিদ্রোহের অস্ত্র ধারণ করেই বেরুতে হয়েছিল। তাই শ্রীচৈতন্য প্রচলিত ধর্ম সংস্কৃতে লেখা হয়নি, লেখা হয়েছিল বাংলায়। সঙ্গে সঙ্গে রামায়ণ-মহাভারতের যে অনুবাদ বাংলায় প্রকাশিত হয় তার পেছনে ছিলেন মুসলমান নবাবগোষ্ঠী। কেচ্ছা-সাহিত্যেরই সম্মান আমরা দিই– হিন্দুরা দেন না এবং সে সাহিত্য হিন্দু ঐতিহ্যে গড়া নয়। এর পর ঊনবিংশ শতাব্দীতে যে বাংলাগদ্যের পত্তন হয় তার অনুপ্রেরণা খ্রিস্টান সভ্যতা থেকে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ নিজেকে হিন্দু বলে স্বীকার করেন কি না, সেকথা অবান্তর– তাঁর অবদান যে উপনিষদ-সংস্কৃতি ও ইয়োরোপীয় প্রভাবের ফলে গঠিত সেকথা অনস্বীকার্য। শ্রীরামকৃষ্ণদেব প্রচলিত নতুন ধারাকে বৈদিক কিংবা সনাতন বলা ভুল, সে ধারা গণ-উপাসনার উৎস থেকে প্রবাহিত হয়েছে এবং সে উৎসকে গোঁড়া হিন্দুরা কখনও শ্রদ্ধার চক্ষে দেখেননি। স্বামী বিবেকানন্দের জাতীয়তাবাদের মূল বেদ উপনিষদ নয়।
উর্দুওয়ালারা বলবেন, এসব খাঁটি হিন্দু না হতে পারে, কিন্তু আর যাই হোক না কেন, ইসলামি নয়।
আমরা বলি, ইসলামি নয় সত্য কিন্তু এর ভেতরে যে ইনকিলাব মনোবৃত্তি আছে সেটি যেন চোখের আড়ালে না যায়। এই বিদ্রোহ ভাব বাংলায় ছিল বলে কাজী নজরুল ইসলাম একদিন আপনবিদ্রোহী দিয়ে রবীন্দ্রনাথের তথাকথিত মরমিয়াপনার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করতে পেরেছিলেন। পূর্ব পাকিস্তানে যে নবীন কৃষ্টি গঠিত হবে সেটা এই বিদ্রোহ দিয়েই আপন বিজয় অভিযান আরম্ভ করবে।