আমি যে অর্থগুলো দিলাম সেগুলো ভাসা ভাসা সাহিত্যিকের জন্য প্রশস্ত, শব্দতাত্ত্বিকের জন্য যথেষ্ট নয়। এগুলো আমার বরাতে ফেলে অভিধানে ব্যবহার অবিচার করা হবে।
শামী-কাবাব- শম (Syria) দেশে প্রচলিত এই অর্থে শামী-কাবাব। মাংস পিষে বড়ার মতো চেপ্টা করে ভাজা কাবাব।
সীনা কলীজহ— পাঁজরের মাংস টুকরো টুকরো করে তার সঙ্গে lever (আস্ত কিংবা টুকরো টুকরো করে মিশিয়ে শুকনো মাংসের ঝোল।
ফালুদা প্রায় ice-cream.
জরীন কলম– সোনার কলম।
জহ্নুধারা– জহ্নমুনির দেহ হইতে নির্গত (ধারা) কণা— জাহ্নবী অর্থে।
চাটিম চাটিম– তবলার বোলের অনুকরণে।
শব্দ– cf. সেতারের পিড়িং পিড়িং। Onomatopoeic.
পেতলে নিয়ে পাতলা করে নিয়ে। পেতলে নিয়ে অচলিত slang.
কানজোখা– কান পর্যন্ত উঁচু।
হাঁসুলি বাঁক–হাঁসুলির মতো বাঁকা।
শুদ্ধরণিক– যা ইচ্ছা লিখুন।
আশা করি কুশলে আছেন।
—মুজতবা আলী
.
(২)
১৮।৭।৫৪
শ্ৰদ্ধাস্পদে,
আপনার প্রথম চিঠির উত্তর তখন ভালো করে দিতে পারিনি। চাকরির চাপ কখন যে জগদ্দল পাথরের মতো নেমে আসে আর কখন যে হঠাৎ হাল্কা হয়ে যায় তার হদিস পাওয়ার চেষ্টা আবহাওয়া দপ্তরের ভবিষ্যদ্বাণী করার মতো। না হলে তখনই আপনাকে অনেক ধন্যবাদ জানানো উচিত ছিল, আপনি যে অশেষ পরিশ্রম স্বীকার করে আমার বইখানার ভুলত্রুটি ধরে দিয়েছেন তার জন্য। সংস্কৃতের ওপর (কথা যখন উঠল তখন বলি, কোনও ভাষার ওপরই) আমার যথেষ্ট দখল নেই বলে নানা রকমের বালসুলভ ভুল করে থাকি। তার ওপর বিশ্ববিদ্যালয় আইন করেছেন, মূল ভাষাতে যে রকম বানান থাকবে অর্থাৎ দীর্ঘ হ্রস্ব, স শ– বাংলাতে তার-ই কাছে আসবার চেষ্টা করবে। এরও ব্যত্যয় বিশ্ববিদ্যালয় দিয়েছেন– যদি বানানটি চালু হয়ে গিয়ে থাকে তবে পুরনো বানানই চলবে। আমি এই ব্যত্যয় মেনেই লিখেছিলুম সাবাস। সে দিন হঠাৎ দেখি রবিঠাকুর তাঁর অতি শেষদিকের লেখাতে লিখেছেন শাবাস (কথাটা শাদ [আনন্দ), যার থেকে শাদী, বিয়ে অর্থে ব্যবহার হয়, বাশথাকা–খুব সম্ভব সংস্কৃতবস ধাতু) কিংবা শাহ–রাজা, বাশ থেকে হবে। যা-ই হোক না কেন, শ, স নয়) কাজেই আবার বানান বদলাতে হল। এখন বলুন তো বাংলা লিখি কী প্রকারে।
আরবি, ফারসি, তুর্কি (তুর্কিস্থানের জগতাই তুর্কি ভাষা ও এশিয়া মাইনরের ওসমানলি তুর্কি ভাষাতে তফাত বাংলা অভিধানে এখনও করা হয়নি), উর্দু, সংস্কৃত, পর্তুগিজ আর অনেক ভাষা থেকে শব্দ এসেছে। এসব তাবৎ ভাষা শিখে, তাদের বানানের হ্রস্ব-দীর্ঘ জেনে তবে বাংলা লিখতে হবে। উত্তর হতে পারে অভিধান দেখো। কোন অভিধান? রাজশেখরবাবুর বইখানা অতি উত্তম কিন্তু তিনিও তো ওই কর্মটি করতে অক্ষম। জ্ঞানবাবুর অভিধান আরও বঢ়িয়া কিন্তু তিনি মেলা গ্রাম্য অথচ চালু কথা দেননি, এবং বানানের হ্যাপা সেখানেই তো বেশি। তবে?
ওয়াকিফহাল না লিখে আমিওকিব-হাল লিখেছিলুম, পাছে বাঙালি পাঠক এর ছদ্মবেশ বর্জিত চেহারা চিনতে না পারে। বিশ্বভারতীর পুলিন সেন প্রথম কয়েক অধ্যায় প্রুফ দেখার সময় (সেগুলোর সমাস জোড়া, বানান consistency চমৎকার হয়েছে) ওটাকেওয়াকিফহাল করে দেন। তা হলে হেস্তনেস্তকেহনীস্ত এবং অকুস্থলকেওয়াকেয়াস্থল লিখতে হবে। সুচতুর পাঠক কিংবা/এবং আপনার মতো দিকসুন্দরী-বল্লভ (আমার সরসিকা সবচেয়ে চিংড়ি ছোট-বোন ডিকশনারির নাম দিয়েছেদিকসুন্দরী –অর্থাৎ সে সুন্দরী বানানের গোলকধাঁধায় দিক বাতলে দেন, তার পর ফিক করে হেসে বলেছিল, অবশ্য বাংলাতে ওনারা দিক দেখান না, দিক্ করেন বেশি। প্রভাত মুখো দিক্করী–যে দিক করে রমণী অর্থে ব্যবহার করেছেন। তাঁর কুচঁশেখর তুখাঞ্জন… এবং খট্টে খট্টে দিক্রিগণ পদ্য পড়েছেন কি? অপূর্ব!) পূর্বপর (context –পূর্বপর ঠিক প্রতিশব্দ কি না জানি না আপনাকে চিঠি লেখা এক গব্বযন্তনা) বিবেচনা করে মানে ধরতে পারবে ঠিকই কিন্তু সাধারণ পাঠকের ওপর এই শব্দতত্ত্বের গর্দিশ কাঁপানো নিশ্চয়ই আর্য-আচরণ নয়।
কিন্তু যে প্রশ্ন মনে নিয়ে এ-পত্র লিখতে আরম্ভ করি সেটি আপনার দিকসুন্দরী কতদূর এগুলো? ইতোমধ্যে ওদুদ সাহেবের বইখানা বেরিয়েছে। দেখেছেন নিশ্চয়ই। ওটি কিন্তু অতি সাবধানে ব্যবহার করবেন। (১) শিলওয়ার, শওয়ার ইত্যাদি। জিন্দেগী, জিন্দগী। পশতু, পুশতু। আরবি-ফারসি-উর্দুতে (জগতাই ওসমানলি তুর্কিতে এবং সিন্ধি-মপলা ভাষাতেও– বিবেচনা করি আরবি হরফে লেখা সব ভাষাতেই) vowel points অর্থাৎ জের-জবর-পেশ দেওয়া হয় না। তাই লেখা হবে জন-দ-গী (দীর্ঘ vowel points দেওয়া হয়)। সেই ভাবে প-শ-ত-উ। প্রথম vowel points নিয়েই বেশিরভাগ মতভেদ হয়। তার কারণ ওটা সাধারণত তাড়াতাড়িতে বলা হয়। তাই ওটাকে vague indistict vowel বলা হয়। ইংরেজিতে about, polite, er-এও এই vague indistict vowel. এই vague indistinct থেকে পৃথিবীর যাবতীয় অন্যান্য vowel-এর সৃষ্টি। (Daniel Jones-এর An English Pronouncing Dictionary-র প্রথম পৃষ্ঠায় এর একটি উত্তম ছবি দেওয়া হয়েছে। (আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস প্রাচীন যুগে ঋ-এর উচ্চারণ ছিল এই vague indistinct vowel + a trill)। কাজেই শুনতে পাবেন– যদিও তাড়াতাড়ি বলা হয় বলে ঠিক ধরা যায় না- শিলওয়ার, ও…শ… etc। তাই আরবি ইলম* = জ্ঞান বাংলায় এলেম; তাই ম-হ-অ-ম-দ বাংলায় মুহম্মদ, মোহম্মদ, মহম্মদ, মামদো! (ঋষি আর্য, মহম্মদ মামদো!) অ-হ্সান (আরবি), ফারসি ইহসান, উর্দু– এহসান, বাংলা– আসান (মুশকিল আসান)। ইংরেজ লেখে Peshwar : পাঠান বলে পি, কিংবা পশার।