অতএব, এখন কাজকর্মে মন দিন। কর্তব্য কঠোরতর হল, সাহায্য কমে গেল। কিন্তু দয়াময় চরম সহায়।
আমি কর্মে উপস্থিত থাকার জন্য বৃহস্পতিবার কলকাতা আসার ব্যবস্থা করেছিলুম কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে পুনরায় দাঁত নিয়ে শয্যাশায়ী হলুম। কাল শেষ injection নিয়েছি। তবে আশা করি শীঘ্রই দেখা হবে।
—আপনার
সৈয়দ
শান্তিনিকেতন
.
(৩)
২১।২।৫৭
প্রিয়বরেষু,
আপনি-আমি একই সময়ে চিঠি লিখেছি; আশা করি আমারটা পেয়েছেন। সেটাতে বসুমতীতে কী কী বিষয় নিয়ে আলোচনা করার বাসনা রাখি তার কিঞ্চিৎ ইঙ্গিত ছিল।
লোহার ব্যবসাতে আপনাকে একদিন যেতে হবে সে-কথা আমি জানতুম কিন্তু এত শীঘ্র, সেটা ভাবিনি। এতে আপনি বিচলিত হবেন না। রবীন্দ্রনাথ যদি পাট্টা কবুলিয়ৎ এবং জ্যোতিরিন্দ্রনাথ কয়লা-বেলচা নিয়ে বছরের পর বছর কাটিয়ে থাকতে পারেন তবে আমরাই-বা এত নিরাশ হব কেন? তবে আপনার এই ব্যবসা থেকে একদিন বেরুনো আপনার পক্ষে হয়তো কঠিন হতে পারে। ভীষ্মদেব শান্তিপর্বে যুধিষ্ঠিরকে বলেছেন, যে ব্যক্তি বৃক্ষের উচ্চ শাখাতে আরোহণ করেছে তাকে অহরহ জাগ্রত থাকতে হয়। কাবুলিরা বলে; এ যেন সিংহের পিঠে চড়ার মতো। ঘুমাবার উপায় নেই। পড়ে গেলেই সিংহ খেয়ে ফেলবে। আমাদের গ্রাম্য কবিও বলেছেন,
এমন অনেক বন্ধু আছে, আশা গাছে দেয় রে তুলে,
ভালবেসে নামায় এসে এমন বন্ধু কজন মেলে?
কিন্তু জগদ্বন্ধু তো আছেন।
বসুমতীর জন্য হয়তো সুদক্ষ একজন কর্মচারীর প্রয়োজন হবে। তৈরি মাল নয়। খানিকটা কাঁচা। যে আপনার নির্দেশ নেবার মতো খানিকটা তালিম পেয়েছে কিন্তু স্বাধিকারপ্রমত্ত নয়। এখন থেকেই এবিষয়ে কিছু কিছু চিন্তা করে এদিক-ওদিক নজর ফেলবেন। সময় এলে আমিও দু-একজনের নাম উল্লেখ করব।
কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা এইবারে নিবেদন করি।
অরবিন্দ ঘোষ জেল থেকে খালাস পেয়ে উত্তরপাড়াতে বলেছিলেন, বিপ্লব কার্যে যুক্ত থাকার সময় প্রায়ই তিনি হৃদয়ঙ্গম করতেন, দেশকে তিনি কোন্ দিকে নিয়ে যাচ্ছেন, সে সম্বন্ধে তাঁর যেন সুস্পষ্ট ধারণা নেই–পদাতিক নাই-বা জানল তার লক্ষ্য কোথায়, কিন্তু সেনাপতিকে সে বিষয়ে স্থিরনিশ্চয় হতে হয়। অরবিন্দ তার পর বলেন, কিন্তু কাজের চাপে নির্জনে গিয়ে সে-বিষয়ে চিন্তা করার অবকাশ তিনি পাননি। তাই তিনি বাঙলার জনসাধারণ এবং কর্মীদের কাছ থেকে কিছুদিনের জন্য অনুপস্থিতি কামনা করেছিলেন। এ-সব খুব সম্ভব আপনার জানা কথা, এবং এটাও নিশ্চয় জানেন, তার পর চন্দননগর হয়ে পণ্ডিচেরি চলে যান।
লোহাতে ঢুকে আপনাকেও পরিষ্কার জানতে হবে লক্ষ্য আপনার কী। এখন ব্যবসাটির বিস্তৃতি ও পরিমাণ আপনি চিনে নেবেন। পরে কিন্তু আপনাকে একদিন নির্জনে গিয়ে চিন্তা করতে হবে আপনার লক্ষ্য কী, অর্থাৎ ব্যবস্থা সর্বাঙ্গসুন্দর হয় কী প্রকারে, কোন্ দিকে চললে মারের হাত থেকে যথাসম্ভব সুরক্ষিত হওয়া যাবে। কিছুদিন পর কিয়ালের জন্য এই নির্জনের সাধনাটি আপনি অবহেলা করবেন না। আমি আপনাকে কী উপদেশ দেব, কিন্তু আমার যদি দেবার মতো কিছু থাকে তবে এই একটিমাত্র উপদেশ।
বসুমতীতে প্রকাশিত নামের তালিকাতে আমার নাম দেবার প্রয়োজন ছিল না। কারণ আমার সঙ্গে আপনার ঈশুর পিতৃদেবের কোনও লৌকিকতার সম্পর্ক ছিল না। তবে বাদ দিলেও দুশ্চিন্তা হত– আপনারা আমার মনের খবর পেয়েছেন কি না তাই ভেবে।
ওই সময়টা আমি দৈঃ এবং মাঃ উভয় বসুমতীর প্রত্যেকটির ছত্র পড়েছি। যুগান্তর এবংস্টেটসম্যানও। আপনারা শোকাতুর ছিলেন বলে, কোনও জায়গাতেই পিতৃদেবের কোনও পাকা জীবনী বেরোয়নি। তার জন্য মনে মনে ব্যবস্থা করবেন। ইতোমধ্যে তাবৎ কাগজের কাটিং একটা জায়গায় রাখবেন। আমি আসছে বছর একটি ছোট প্রবন্ধ লিখব। (আমার প্রথম ইচ্ছে হয়েছিল, শ্রাদ্ধের দিনই লেখাটি প্রকাশ করার, কিন্তু মন তখন শোকাতুর ছিল, দেহের পীড়াও ছিল– লেখাতে সংযম থাকত না, এবং আমাদের পারস্পরিক সম্পর্ক সম্বন্ধে পাঁচজন অজ্ঞ বলে ভুল বুঝত)। ইতোমধ্যে কলকাতায় এলে কাগজপত্র নিজেই দেখে নেব। নতুবা সময় এলে আপনাকে পাঠিয়ে দেবার জন্য স্মরণ করিয়ে দেব।
আজ এখানে শেষ করি।
আপনার ভ্রাতা এবং ভগ্নীদের আমার প্রীতিসম্ভাষণ জানাবেন।
এ গৃহে শান্তি করুক বিরাজ মন্ত্রবচন-বলে,
পরম ঐক্যে থাকুক সকলে, ঘৃণা যাক দূরে চলে;
পুত্রে পুত্রে মাতা-দুহিতায় বিরোধ হউক দূর,
পত্নীপতির মধুর মিলন হোক্ আরো সুমধুর;
ভায়ে ভায়ে যদি দ্বন্দ্ব থাকে তা হোক আজি অবসান,
ভগিনী যেন গো ভগিনীর প্রাণে বেদনা না করে দান;
জনে জনে যেন কর্মে বচনে তোষে সকলের প্রাণ,
নানা যন্ত্রের আওয়াজ মিলিয়া উইক একটি গান।
— অথর্ববেদ
শান্তিনিকেতন
মুজতবা আলী
.
॥ শ্রীঅমলেন্দু সেনকে লিখিত পত্র ॥
(১৪৯/এ বকুলবাগান রোড, কলিকাতা-২৫)
(১)
২ জুলাই, ৫৩
শ্ৰদ্ধাস্পদেষু,
আমি শব্দতাত্ত্বিক নই, কাজেই আমার সাহায্য নিয়ে অভিধান নির্মাণ করা যুক্তিসঙ্গত হবে না। বিশেষত আমার কাছে ভালো অভিধান (আরবি, ফারসি, তুর্কি ভাষায়) নেই যে সেগুলো দেখে ত্রুটিবিহীন অভিমত দিতে পারি।
যদি অপরাধ না নেন তবে বলি, কিছুটা ফারসি শিখে নিন, যাতে করে অন্তত সে ভাষার অভিধান কাজে লাগাতে পারেন।