আঁদ্রে জিদ একবার কম্যুনিস্টদের সমালোচনা করে বেধড়ক মার খান। উপরে বর্ণিত ঝানু সাহিত্যিকরা সেই তত্ত্বটি জানেন, এবং ফ্যাসিস্ট নামে পরিচিত হতে চান না।
Obscurantism-এর বিরুদ্ধে লেখা দুটি প্রবন্ধ আমার জীবনকে richer করেছে। একটি আনাতোল ফ্রাসের Life and Letters-এ আছে, দ্বিতীয়টি Edmand Wilson-এর লেখা এলিয়টের সমালোচনা। ফ্রাসের সেই আপ্তবাক্য পুনরায় স্মরণ করি : I have passed the age when one loves what one does not understand, I love light. নমস্কার জানবেন।
কাগজ খতম।
—গুণমুগ্ধ
সৈ, মু. আলী
শান্তিনিকেতন।
পু. বড়বাবু (দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর) বলতেন, to imitate-এর বাংলা অনুকরণ, to ape এর বাংলা হনুকরণ। এ দেশে বিলিতির হনুকরণ হচ্ছে।
.
(২)
২৩।১০।৬২
শ্ৰদ্ধাস্পদে,
আপনার পত্রের সর্বশেষে আছে, আপনাদের প্রতিষ্ঠা কি এতই ঠুনকো জিনিস যে পাঁচজন অর্বাচীনের হাততালি না পেলেই তার বনেদ ধ্বসে যাবে।
এতে প্রথম ইঙ্গিত আছে, আমি সাহিত্যিক (এটা উপস্থিত আমি মেনে নিলুম), (২) আমার প্রতিষ্ঠা আছে, (৩) সেটা বাঁচাবার জন্যে আমি অর্বাচীনদের হাততালি খুঁজে বেড়াই। এই তিন নম্বরের ইঙ্গিতটা হে সৌম্য, ভালো করে না জেনে কি করা উচিত?
এখন বক্তব্য, আপনি চান, সাহিত্যিকেরা স্পষ্ট ভাষায় বলুন যে অধুনা সর্বসাহিত্যে যে Obscurantism চলছে সেটা সাহিত্য নয়, ও পথে চললে সাহিত্যের সর্বনাশ হবে। এই তো? আশা করি আমি আপনার মুখে এমন কোনও কথা চাপাইনি যেটা আপনার বক্তব্য নয়।
অর্থাৎ আপনি চান, সাহিত্যিকরাই সাহিত্যের গতি নির্দেশ করুন।
তা হলে নিবেদন, সাহিত্যে থাকে রস, এবং সেই গোড়ার জিনিস নিয়ে আলোচনা করেন, আলঙ্কারিকেরা। তারা বলে দেন কোটা উত্তম রস, উত্তম সাহিত্য, আর কোন্টাই-বা অধম।
আলঙ্কারিক ভরত থেকে আরম্ভ করে অভিনব গুপ্ত ইত্যাদি– এঁরা কি সাহিত্যিক ছিলেন? এঁরা কি কাব্য, নাট্য, আখ্যান, উপাখ্যান, মহাকাব্য ইত্যাদি প্রথম লিখে নিয়ে নাম করে ফেলে তবে সাহিত্যের গতি নির্দেশে হাটে নেমেছিলেন? আমার যতদূর জানা, এঁরা সাহিত্য সৃষ্টি করেননি। (Creative মাল)। অবশ্য এদের কারও কারও লেখা সরস, কিন্তু তবু তাঁদের সাহিত্যিক বলি না, বলি আলঙ্কারিক। সুরেশ সমাজপতি, অতুল গুপ্ত এরা সাহিত্য সৃষ্টি (Creative সাহিত্য) করেছেন বলে জানিনে।
ইয়োরোপীয় সাহিত্যগুলোর ইতিহাস তথা ইউরোপীয় আলঙ্কারিকদের কথা আমি বড় একটা জানিনে (আমি সমস্ত জীবন ধর্ম, দর্শন, শব্দতত্ত্ব নিয়ে কাটিয়েছি)। কিন্তু আপনি বলতে পারবেন, প্লেটো থেকে আরম্ভ করে ক্রোচে পর্যন্ত, এঁদের ক-জন Creative literature সৃষ্টি করে, সাহিত্যিক নামে প্রখ্যাত হওয়ার পর, অর্বাচীনদের হাততালি উপেক্ষা করে সাহিত্যের গতি নির্দেশ করে গেছেন।
আব্দুল করীম খান, ফৈয়াজ খান ইত্যাদি বড় বড় গাওয়াইরা যে ফিলমি গানার বিরুদ্ধে প্রবন্ধ লেখেন নি, কিংবা বক্তৃতার কেম্পেন করেননি সে কিঅর্বাচীনের হাততালি থেকে বঞ্চিত হওয়ার ভয়ে? পাঠান মোগল আমলেও দেখতে পাই, চিত্র-স্থাপত্য সম্বন্ধে আলোচনা করেছেন তাদের ইতিহাস-লেখকরা, এরা এমারৎ বানাতেন না।
মাইকেল আঞ্জেলো, রাফায়েল ইত্যাদি বড় বড় ভাস্কর চিত্রকারদের ক-জন বাতলে দিয়েছেন ওইসব কলা কোন্ পথ দিয়ে যাবে। সব যুগেই নিকৃষ্ট আর্ট, নিকৃষ্ট movement in art থাকে। এরা কি তখন পোলেমিক লিখেছিলেন।
এবারে একটি অতি নিকৃষ্ট উদাহরণ দেই– পাঁচক এবং ভোজনরসিক কি একই ব্যক্তি? আমার অগ্রজের মতো ভোজনরসিক (তিনি খান অতি অল্প, বলেন, আমি পেটুক নই- এটা অবশ্য এস্থলে অবান্তর) আমি ত্রিজগতে দেখিনি। তিনি ডিম সেদ্ধ করতেও জানেন না। আমার মা অতিশয় নিপুণা পাচিকা ছিলেন। হালের চপ-কাটলিস, পুডিং-মাডিঙের বিরুদ্ধে তিনি প্রবন্ধ লেখেন নি।
বস্তুত এ সম্বন্ধে আমার কোনও সুস্পষ্ট ধারণা নেই, কারণ পূর্বেই নিবেদন করেছি, সাহিত্যের তথা লিটারারি ক্রিটিসিজম এবং এসথেটিকসের সঙ্গে আমার পরিচয় অতি অল্প। আবছা আবছা মনে হয়; যারা সাহিত্য সৃষ্টি করেন তারা জানা-অজানাতে আপন আপন স্কুলের সমর্থন করে সাহিত্যের গতি নির্দেশ করতে বাধ্য, অর্থাৎ নিরপেক্ষ থাকতে পারবেন না। পক্ষান্তরে যারা সাহিত্য সৃষ্টি করেন না, কিন্তু সাহিত্যরস আস্বাদন করেন তারাই এ-কাজের উপযুক্ত আমার আবছা-আবছা বিশ্বাস ইতিহাসের হেথা-হোথা ব্যত্যয় থাকলেও প্রধানত সাহিত্য-রসিকরাই সাহিত্যের গতি নির্দেশ করার চেষ্টা করেছেন (তাতে কোনও ফল হয়েছে কি না তা-ও জানিনে)। আপনি একটু চিন্তা করে জানাবেন। ইতোমধ্যে অতিশয় অনিচ্ছায় সবিনয় নিবেদন, আল্লা সামনে, আমি সস্তা-দামি কোনও হাততালির জন্য কখনও লিখিনি। তবে একথা নিশ্চয়ই সত্য, আমি পণ্ডিতজনদের জন্য লিখেছি অতি অল্পই। প্রধানত লিখেছি সেই ম্যান ইন দি স্ট্রিটের জন্য, যে হয়তো সামান্য ইংরেজি জানে, বাংলাটা মোটামুটি বুঝতে পারে এবং সিরিয়স বই পড়তে নারাজ। হঠাৎ মনে পড়ল দশম শতাব্দীর কবি আব্দুর রহমান (অদহমান) তাঁর কাব্য, অভ্রংশে লেখা সন্দেশ রাসকে বলেছেন, পণ্ডিতজন কুকবিতার সঙ্গে সম্বন্ধ রাখেন না, আর অজ্ঞজন অজ্ঞতাবশত কবিতায় প্রবেশ করে না। এজন্য যে মূর্খ নয়, এবং পণ্ডিতও নয়, অর্থাৎ মধ্যম শ্রেণির, আমার এ কাব্য তার জন্য।